উল্টো পথে চলেছে পৃথ্বী

:: আবু সাঈদ খান ::

আমরা যারা ষাটের দশকে বেড়ে উঠেছি, তারা পেয়েছিলাম সত্য, শুভ ও সুন্দরের পথে চলমান পৃথিবী। তখনও সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের দাপট ছিল; তবে তা ক্ষীয়মাণ। তখন মার্কিনি আধিপত্য থেকে মুক্ত হতে অমিত তেজে লড়ছিল হো চি মিনের ভিয়েতনাম। সেখানে মার্কিনি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। তিনি কোপেনহেগেন ও স্টকহোমে আদালত গঠন করে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। করুণ পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে।

এমন বিপ্লব-স্পন্দিত সময়ে আমরা পাকিস্তানি শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট। তবে আশার আলো জ্বেলেছিল তারুণ্যের রাজপথ কাঁপানো স্লোগান- কেউ খাবে, কেউ খাবে না/ তা হবে না তা হবে না; সংগ্রামের অপর নাম/ ভিয়েতনাম; ফুরিয়ে গেছে তোমার দিন/ হাত গুটাও মার্কিন। সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের বুক চিরে প্রসারিত হচ্ছিল নতুন এক বিশ্ব-ব্যবস্থা; সমাজতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, পূর্ব ইউরোপ, কিউবায় তখন সমাজতান্ত্রিক সমাজ।

মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম বদলিয়ে দিয়েছিল ইউরোপকেও। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-উত্তর সেখানে রাজনীতির নিয়ামক হয়ে উঠেছিল সোশ্যাল ডেমোক্রাটরা। গড়ে উঠেছিল সামাজিক নিরাপত্তা জালে বেষ্টিত কল্যাণকর রাষ্ট্র। পরাধীন ভারতেই সমাজতান্ত্রিক ভাবনা অঙ্কুরিত হয়েছিল। তা ভারতের মূলধারায় পরিণত হয়নি। জওয়াহেরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসু সমাজতন্ত্রের মর্মবাণী ধারণ করেছিলেন। তবে কংগ্রেস ছিল করমচাঁদ ভেঙ্কট চাঁদ গান্ধীর ভাবাদর্শে পরিচালিত, মুসলিম লীগ ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুগামী। ভারত বিভাগ-উত্তর পাকিস্তান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত হলেও ভারত ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র। নেহরু, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, মিসরের জামাল আবদেল নাসের, শ্রীলংকার বন্দরনায়েকসহ তৃতীয় বিশ্বের নেতৃবৃন্দ মিলে গড়ে তুলেছিলেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ও সংগঠন। আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া ছোট ছোট জাতি ও জনগোষ্ঠী।

১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে উল্টো পথে হাঁটছে পৃথিবী। আর এই উল্টো পথের অগ্রপথিক পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম। তার মাথায় গণ্ডগোল আছে কি-না, তা পরীক্ষার কথা বলেছেন সে দেশের এক দল বিশিষ্ট চিকিৎসক। যদিও হোয়াইট হাউস এমন মন্তব্য উড়িয়ে দিয়েছে। তিনি পাগল- এমন ভাবার কারণ নেই। কারণ তিনি সাদা-কালো চিনেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সাদাদের দেশে পরিণত করতে চাইছেন। তার চক্ষুশূল কালোরা। মার্টিন লুথারের আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বর্ণবাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে পারেনি। এখনও একাংশের মানুষের মধ্যে বর্ণবাদ প্রবল। আর এই বর্ণবাদীরা ট্রাম্পের ভোটব্যাংক। আর বর্ণবাদী সমর্থন অটুট রাখতে তিনি আট মুসলিম দেশের নাগরিকদের ওপর ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। মেক্সিকানদের ধর্ষক ও মাদক পাচারকারী বলেছেন। বর্ণবাদীদের খুশি রাখতে হাইতিবাসীকে ‘জঘন্য’ (শিট হোল) বলেছেন। তিনি বোঝাতে চাইছেন, আফ্রিকা ও এশিয়ার অভিবাসীই মূল সমস্যা। আসলে সমস্যা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নীতি। যে নীতিতে মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে সম্পদ পুঞ্জীভূত। ব্যাপক মানুষ হয়েছে সম্পদহারা। ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনে দাবি ছিল- ৯৯ শতাংশের জন্য সম্পদ ১ শতাংশ, আর ১ শতাংশের কাছে ৯৯ শতাংশ সম্পদ রাখা চলবে না।

যুক্তরাষ্ট্র চায় অশান্ত বিশ্ব, যা তাদের অস্ত্র ব্যবসার প্রসার ঘটাবে। কারও অজানা নয়, সোভিয়েত জমানায় তারা মুসলিম উগ্রবাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল, তালেবান তৈরি করেছিল। বেছে নিয়েছিল আফগানিস্তান। লক্ষ্য ছিল সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত মধ্য এশিয়ার মুসলিম প্রধান দেশগুলো। সে লক্ষ্য হাসিল হয়েছে। ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর তাদের টার্গেট মধ্যপ্রাচ্য। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা মিথ্যা অভিযোগে সাদ্দাম ও গাদ্দাফিকে উৎখাত করেছে। তারপর তাদের সৃষ্ট আইএসের সঙ্গে কয়েক বছর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলেছে। এই অশান্ত পরিবেশে পানির দামে তেল কিনেছে আর অস্ত্র বেচেছে চড়া দামে। অতি সম্প্রতি শুধু সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র ১০০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি চুক্তি করেছে (যা হয়তো ব্যবহার করা হবে ভাগ্যহত ইয়েমেনবাসীর ওপর)। ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করেছেন, যা ইসরায়েলকে আরও বেপরোয়া করেছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে দীর্ঘ দিনে এগিয়ে আনা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়া। সাম্রাজ্যবাদের কুটিল চালে মধ্যপ্রাচ্য ভাগ হয়েছে শিয়া-সুন্নিতেও।

মানুষে মানুষে বিভাজনের খেলা শুধু মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইউরোপ ও আমেরিকাতে বর্ণবাদ প্রকট। এই বর্ণবাদী ভোটাররা দল বেঁধে ট্রাম্পকে জিতিয়েছে, যা আগেই উল্লেখ করেছি। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতেও আজ হিন্দুত্ববাদের উত্থান। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এখন ক্ষমতায়। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ‘বীর’-এর মর্যাদায় অভিষিক্ত! গোরক্ষার নামে মানূষ খুন করা হচ্ছে। বহুত্ববাদী ভারতকে আজ ‘হিন্দু ভারতে’ পরিণত করার সব রকম চেষ্টা হচ্ছে। মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে মোগল আমলের ইতিহাস ও কীর্তি। তাজমহলও হিন্দুত্ববাদীদের চক্ষুশূল। ভাবা যায় না, রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণেও বর্তমান ভারত সরকারের ধর্মীয় বিবেচনা কাজ করছে। প্রতিবেশী বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে যারা ভারতে শরণার্থী, তাদের মধ্য থেকে হিন্দু-বৌদ্ধদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আর মুসলমানদের বহিস্কার করা হবে। ব্যাপারটা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে যাওয়া চিহ্নিত শরণার্থীদের ক্ষেত্রেই নয় শুধু, যারা বংশপরম্পরায় ভারতে বাস করে আসছে তাদেরও নিশানা করা হচ্ছে। বিশেষ করে আসাম থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালি, যারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান; তাদেরকে বাংলাদেশি চিহ্নিত করে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র আঁটা হয়েছে। তবে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে বিবেকবান মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি বলেছেন, আসামের বাঙালি খেদানোর এ ষড়যন্ত্র মেনে নেবেন না; প্রয়োজনে পশ্চিমবঙ্গে তাদের স্থান দেবেন।

মহামতি বুদ্ধের অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পদস্খলন দেখছি। মিয়ানমারের রাখাইনের বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সামরিক জান্তা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রোহিঙ্গা নিধনে তৎপর। ১০ লাখ মিয়ানমারবাসীকে দেশছাড়া করেছে তারা। জাতিসংঘ বলেছে, এটি টেক্সট বুক এক্সাম্পল অব ইথনিং ক্লিনজিং। বর্মি বর্ণবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ এখানে একাকার।

ধর্মীয় উগ্রতা বাংলাদেশকে স্পর্শ করেনি- এমন দাবির সুযোগ নেই। হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলাসহ অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। ঈদের মাঠেও জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করেছে। পুলিশ-র‌্যাব দক্ষতার সঙ্গে এসব মোকাবেলা করছে। কিন্তু তা আদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মোকাবেলা হচ্ছে না। বড় দুর্ভাবনার জায়গা- সংখ্যালঘু ও আদিবাসীরা হামলার শিকার হচ্ছে। তা রুখে দিতে তৎপর নয় রাষ্ট্র ও সমাজ। অনেকের চোখে দেশটি এখন ‘মুসলমানের দেশ’। এমন ধারণা রাজনীতিতেও প্রোথিত। একদা রাজনৈতিক কর্মীরা দাঙ্গা রুখে দাঁড়াত। এখন কর্মীদের অনেককেই পাওয়া যায় হামলাকারীদের মিছিলে। কারও অজানা নয়, রাষ্ট্রধর্ম এখন সংবিধানের অংশ। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রেখে কি ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ গড়া আদৌ সম্ভব?

সমগ্র দুনিয়াই যেন পেছনে ফিরছে। দেশে দেশে প্রকৃতি বিধ্বংসী উন্নয়নের থাবা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত বিশ্বই প্রধানত দায়ী। তা মোকাবেলার মূল দায় তাদেরই। বৈশ্বিক তাপমাত্রা রোধে জাতিসংঘের নেতৃত্বে ২০১৫ সালে যে প্যারিস চুক্তি হয়েছিল, তার থেকে সমর্থনের হাত গুটিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ আলামতে আবহাওয়াবিদ ও বিজ্ঞানীরা শঙ্কিত। স্টিফেন হকিং বলেছেন, পৃথিবীর আয়ু বড়জোর ১শ’ বছর। এর আগেও পৃথিবী ধ্বংস হতে পারে নীতিবোধহীন রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির কারণেও। যার প্রকাশ দেখি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিমের মধ্যে কথা চালাচালিতে। ট্রাম্প প্রকাশ্যেই দেশটিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। কিম বলেন, পারমাণবিক অস্ত্রের বোতাম তার টেবিলে। জবাবে ট্রাম্প বলেন, তার অস্ত্র ও বোতাম দুই-ই বড়। এমন বাৎচিত তাদের জন্য কৌতূহলের ব্যাপার হতে পারে; তবে বিশ্ববাসীর জন্য ভয়ানক আতঙ্ক। আজ অর্থনৈতিক বৈষম্যও মোকাবেলার কোনো উদ্যোগ নেই। কেউ নেই অসহায়, অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়াবার মতো। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীনতাকামী দেশ ও জাতির পাশে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশ দাঁড়িয়েছিল। আর আজ রাশিয়া ও চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে দাঁড়িয়েছে নিপীড়ক মিয়ানমারের পাশে। নীতি নয়; বাণিজ্যই এর কারণ। বাণিজ্যের প্রত্যাশায় প্রতিবেশী ভারতও দিশেহারা। বাংলাদেশের পাশে না দাঁড়িয়ে দুই কূল রক্ষার নীতি অবলম্বন করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়া মিয়ানমারের বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু তারা নীরব ইয়েমেনে সংঘটিত সৌদি বর্বরতার বিরুদ্ধে। এটি বোধগম্য যে, পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ; তবে ন্যায়-অন্যায় ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে যাওয়া উচিত নয়। অতীতে রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে নীতিবোধ যতটা ছিল, আজ তা বিরল। আতঙ্ক এখানেই।

সাংবাদিক ও লেখক
ask_bangla71@yahoo.com

Advertisement