এরদোয়ানের জন্য একটি সতর্কসংকেত

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: একটি রাজনৈতিক ভূমিকম্প হয়ে গেল তুরস্কে। দেশটির বড় শহরগুলোর মেয়র নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দলের পরাজয়ে এই ভূকম্পনের সৃষ্টি। যখন মনে করা হচ্ছিল যে তুরস্কের গণতন্ত্রের একেবারে মৃত্যু ঘটেছে, তখন দেশটির জনগণ কর্তৃত্বপরায়ণ প্রেসিডেন্টের দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে তা ভুল প্রমাণিত করেছে।

দেশটির মেয়র নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলে এটা স্পষ্ট যে এরদোয়ান ও তাঁর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) রাজধানী আঙ্কারা এবং এরদোয়ানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার যেখান থেকে শুরু, সেই বাণিজ্যিক কেন্দ্র ইস্তাম্বুলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এটা এরদোয়ানের জন্য একটি সতর্কবার্তা বলা যায়। যদিও এরদোয়ানের দল এখনো পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটি এই প্রথম খুব বাজেভাবে কোনো নির্বাচনে পরাজিত হলো। গত বছর এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন এবং ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটে প্রেসিডেন্টের দল একে পার্টি কম ব্যবধানে হলেও জয় পেয়েছিল। ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল দলটির পক্ষে। ওই গণভোটে প্রেসিডেন্ট শাসিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বাতিল হয়ে যায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।

মেয়র নির্বাচনের আগের দুই মাস ধরে নিরলস নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন এরদোয়ান। স্থানীয় এ নির্বাচনকে তুরস্কের জন্য ‘বাঁচা-মরার নির্বাচন’ বলে অভিহিত করেছিলেন তিনি। কিন্তু এ নির্বাচনেই রাজধানী হাতছাড়া হয়ে গেল তাঁর দলের। ইস্তাম্বুলেও কর্তৃত্ব ধরে রাখার মতো ফলাফলও করতে পারেনি একে পার্টি। এবারের নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীরা এরদোয়ানের দমনপীড়ন ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে সৃষ্ট জন–অসন্তোষকে কাজে লাগিয়েছে। নির্বাচনের এই ফলাফল আভাস দিয়েছে যে যদি বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তা এরদোয়ানের জন্য সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। প্রেসিডেন্টের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি ও তার মিত্ররা মেয়র নির্বাচনের প্রচারণায় রাজনৈতিক পরিবর্তন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উন্নত শিক্ষা এবং উন্নত সামাজিক পরিষেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বিরোধী দলগুলোর সদস্যরা সতর্কতার সঙ্গে ভোট গণনা করেন, এমনকি তাঁরা গণনা করা ভোটের বস্তাগুলোর ওপর রাতভর ঘুমিয়ে থেকেছেন, যাতে এরদোয়ানের অনুগতরা কোনো ধরনের ঝামেলা করতে না পারে। রিপাবলিকান পিপলস পার্টির প্রার্থীদের সমর্থন করার জন্য কুর্দিপন্থী পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির শৃঙ্খলাবদ্ধ চেষ্টার কারণেই সম্ভবত ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারায় বিরোধীরা জয় পেয়েছে।

এক দশকের বেশি সময় ধরে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তুরস্ককে শাসন করছেন, তবে প্রতিপক্ষ হিসেবে যাদের দেখছেন, তাদের নির্মমভাবে দমন করছেন। তিনি দেশ শাসনের নামে জনগণের মৌলিক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছেন। দেশটির সেনাবাহিনী তাঁর নিয়ন্ত্রণে। গণমাধ্যমও তাঁর নিয়ন্ত্রণে। এখানে স্বাধীন সাংবাদিকতা বলে কিছু নেই। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় এখন তুরস্কের কারাগারে সাংবাদিকের সংখ্যা অনেক বেশি। এরদোয়ান এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নিজেকে সরাসরি জড়িয়ে ফেলেছিলেন। ইস্তাম্বুলের মেয়র পদে দীর্ঘদিনের মিত্র বিনালি ইলদ্রিমকে এবং আঙ্কারার মেয়র পদে একজন সাবেক মন্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে দেন। তাঁদের পরাজয় নিঃসন্দেহে এরদোয়ানের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।

এক দিনে আটটি রাজনৈতিক সমাবেশে উপস্থিত হয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আক্রমণাত্মক নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনি বিরোধী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়াসহ নানা অভিযোগ এনেছিলেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। নির্বাচনে তাঁর দলেরই পরাজয় হয়েছে।

এটা খুব বিস্ময়কর নয় যে ভোটাররা এই মেয়র নির্বাচনকে এরদোয়ানের শাসনের ওপর গণভোট হিসেবে দেখছে। বহু বছর ধরে ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধির পর তুরস্কের অর্থনীতি গত মার্চ মাসে ব্যাপক মন্দার মধ্যে পড়ে। দেশটিতে বেকারত্বের হার এখন ১০ শতাংশের বেশি এবং তরুণদের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তুর্কি মুদ্রা লিরার ২৮ শতাংশ দরপতন হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির হার ২০ শতাংশ।

ভোটাররা, বিশেষ করে তরুণ ভোটাররা এরদোয়ানের পরিবারের সদস্যদের ও তাঁর সহযোগীদের দুর্নীতির বিষয়েও উদ্বিগ্ন। এরদোয়ানের দল ভোট গণনাকে চ্যালেঞ্জ করছে, কিন্তু তারা আবার বলছে তারা নির্বাচনের ফলকে সম্মান জানাবে।

একটা উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সিরিয়ায় আমেরিকার কুর্দি জোটের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক অভিযান পরিচালনা করে দেশের ভেতরে সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু তাঁর এমন উদ্যোগ উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে, যদি অভিযান দুর্বলভাবে পরিচালনা করা হয়। বিশেষ করে এখন যখন তুরস্কের রাজনৈতিক বিরোধীরা দেখিয়েছে যে তারা এখনো বেঁচে আছে এবং কাউকে ঠেলে ফেলে দিতে সক্ষম।

Advertisement