করোনায় টোরির যতো বিতর্কিত কান্ড এবং লকডাউন আইনের প্রতি রাণীর শ্রদ্ধা

কামাল মেহেদী ।। করোনা মহামারীতে ২০২০ সালের ২৩শে মার্চ প্রথম লকডাউনে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত করোনা নিয়ে একের পর এক বিতর্ক সামাল দিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। আউলা-চুলা, কমেডিয়ান, বাফুন প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রীতিমতো অবাক করেছে সবাইকে। করোনা ভ্যাকসিনের সাফল্যের কারণে আপাতত বাহবাও পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। কিন্তু বিতর্ক যেনো তাঁর পিছু ছাড়ছে না। একটা সামাল দেনতো আরেকটা এসে হাজির হয়। সর্বশেষ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরনের লবিং বির্তকের অবসান হয়নি এরিমধ্যে হেলথ সেক্রেটারী মেট হ্যানকককে জড়িয়ে আরেক জঞ্জালের কথা বেরিয়েছে সংবাদ মাধ্যমে।
লন্ডনে গ্রিনসীল ক্যাপিটাল নামে একটি ফাইনান্সিয়াল কোম্পানীকে করোনা আর্থিক সহযোগিতার জন্যে কোম্পানীর পক্ষ থেকে হেলথ সেক্রেটারী এবং চ্যান্সেলারসহ চারজন ক্যাবিনেট সদস্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন দলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরন। এই কোম্পানীর মালিক ল্যাক্স গ্রীনসিল সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ট মানুষ। রাজনীতি ছাড়ার পর বন্ধুর কোম্পানীতে একজন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন ডেভিড ক্যামরন। ২০১৯ সালে ডেভিড ক্যামরনের উদ্যোগে হেলথ সেক্রেটারী মেট হ্যানকক এবং ল্যাক্স গ্রীনসিল একসাথে পানাহারেও মিলিত হন। গ্রীনসিলকে এনএইচএসের কাজের কিছু চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্যে তদবির করেছিলেন ডেভিড ক্যামরন। এরপর করোনাকালে কোম্পানীটি অর্থনৈতিক সংকটে বিধ্বস্তের মুখে পড়লে করোনাকালীন বিশেষ লোন দেওয়ার জন্যে চ্যান্সেলারকে সরাসরি ট্যাক্সট করেন ডেভিড ক্যামরন। বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয়। ইস্যুটি নিয়ে ১৪ এপ্রিল, বুধবার পার্লামেন্টে এমপিদের মুখোমুখি হন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর লবিংয়ের ইস্যুটি নিয়ে সংসদীয় তদন্তের দাবী করেছেন লেবার লিডার স্যার কিয়ার স্টারমার। কিন্তু সংসদে এমপিদের ভোটাভুটিতে ৩৫৭ জন এমপি লেবারের দাবীর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। তবে এই লবিং নিয়ে সাতটি তদন্ত এরিমধ্যে শুরু হয়েছে। এরমধ্যে তিনটি তদন্ত শুরু করেছে পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটি। এই আলোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই ১৬ এপ্রিল, শুক্রবার হেলথ সেক্রেটারীকে জড়িয়ে নতুন খবর প্রকাশিত হল সংবাদ মাধ্যমে। খবরে বলা হয়েছে, এনএইচএস ওয়েলসের সাথে ডকুমেন্ট সংরক্ষন, ¯্র্যাডিং (ডকুমেন্ট ধ্বংস করা) এবং স্ক্যানিংয়ের জন্যে টপউড লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির বছরে ৩শ হাজার পাউন্ডের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এই কোম্পানীটি হেলথ সেক্রেটারী মেট হেনককের বোনের নামে রেজিষ্টার করা হলেও এতে মেট হেনকক অংশিদার বলে জানা গেছে। যদিও চলতি বছরের মার্চে হেলথ সেক্রেটারী এমপিদের জানিয়েছেন, টপউড লিমিটেড নামে একটি কোম্পানীতে তিনি ১৫ শতাংশ অংশিদার রয়েছেন। কিন্তু পাবলিক কন্ট্রাক্টের রেকর্ডের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে মেট হেনকক হেলথ সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর টপউড কোম্পানীটি রেজিষ্ট্রার হয় এবং এনএইচএসের সাপ্লায়ার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। দেখা যাক এ নিয়ে তর্ক কত দূর যায়। তবে করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি নিয়ে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে রয়েছেন হেলথ সেক্রেটারী। সরকারী নিয়ম অনুযায়ী, ১০ হাজার পাউন্ডের উপরে যে কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ৩০ দিনের ভেতরে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু করোনা মহামারী শুরুর পর পিপিই সরবরাহসহ বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন কোম্পানীর সঙ্গে সম্পাদিত প্রায় ১০ বিলিয়ন পাউন্ডের চুক্তির তথ্য নির্ধারিত সময়ের ভেতরে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে হেলথ ডিপার্টমেন্ট। অনেক চুক্তির কোনো কাগজপত্রই নেই! করোনাকালে চুক্তি নিয়ে যে লঙ্কাকান্ড হয়েছে এ কারণে আদালত থেকেও বলা হয়েছে, করোনা চুক্তি সম্পাদনে হেলথ সেক্রেটারী বেআইনি কাজ করেছেন। চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন মানা হয়নি বলে দ্যা ডিপার্টমেন্ট ফর হ্যাল্থ এন্ড সোসাল কেয়ার সংক্ষেপে (ডিএইচএসসি) এর বিরুদ্ধে আইনী চ্যালেঞ্জ করেছে ক্যাম্পেইন গ্রুপ দ্যা গুড ল প্রজেক্ট এবং লেবার দলীয় এমপি ডেবি আব্রাহমস, গ্রিন ক্যারোলাইন লোকাস এবং লিবমের এমপি লায়লা মোরান।
তবে এসবের আগে প্রথম যখন লকডাউন শুরু হয়েছিল তার কিছুদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ডমিনিক কামিংসের লকডাউন আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি নিশ্চয় সবার মনে আছে!
২০২০ সালের এপ্রিলে লকডাউন আইন লঙ্ঘন করে ৪ বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডন থেকে ২৬০ মাইল দূরে ডারহ্যামে বাবা-মায়ের কাছে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ডমিকিন কামিংস। এ নিয়ে তুমুল বিতর্কের মুখে প্রধানমন্ত্রী একটুও নড়েননি। যদিও সেই সময় দলের বিপুল সংখ্যক এমপি ডমিনিকের পদত্যাগ দাবী করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টার লকডাউন আইন লঙ্ঘনের প্রতিবাদে একই বছরের মে মাসে কেবিনেট থেকে পদত্যাগ করেন স্কটল্যান্ড অফিস মিনিষ্টার ডগলাস রোজ। এরপর টেস্ট এন্ড ট্রেইসিংয়ের প্রধান হিসেবে ব্যারোনেস দিদো হার্ডিংয়ের নিয়োগও সবচাইতে বেশি আলোচিত ছিল করোনাকালে। এই দিদো হার্ডিংয়ের নিয়োগের পেছনেও নাকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরুনের ভূমিকা রয়েছে।
তবে কোনো বিতর্কই বরিসকে নড়াতে পারেনি। এই বিষয়গুলোকে সাধারণ মানুষ কিভাবে নিয়েছে বা নিচ্ছে এবং লেবার পার্টি এই ইস্যুগুলোতে তৃণমূলে কিভাবে কাজে লাগাবে তা দেখা যাবে আগামী ৬ মে’র নির্বাচনে। এদিন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচন না হলেও স্কটিশ এবং ওয়েলস পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে। এছাড়া লন্ডন মেয়রসহ ইংল্যান্ডের ১শ ৪৩টি স্থানীয় কাউন্সিল নির্বাচন হবে।

HAMPSHIRE, ENGLAND – UNDATED: In this image, made available November 18, 2007, HM The Queen Elizabeth II and Prince Philip, The Duke of Edinburgh re-visit Broadlands, to mark their Diamond Wedding Anniversary on November 20. The royals spent their wedding night at Broadlands in Hampshire in November 1947, the former home of Prince Philip’s uncle, Earl Mountbatten. (Photo by Tim Graham/Getty Images)

রাজনীতি হয়তো রাজনীতির মতোই চলতে থাকবে। রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র হয়তো এমনই বিতর্কে ঘেরা থাকবে। কিন্তু এক নজর তাকিয়ে দেখুন ব্রিটিশ রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের দিকে! ক্ষমতার কিসের কমতি তাঁর? কিন্তু স্বামী প্রিন্স ফিলিপের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে করোনা বিধি-নিষেধের একটুও লঙ্ঘন হোক সেটা চাচ্ছেন না রাণী। স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে ৭৩ বছরের সংসার ছিল। কিন্তু তাঁকে শেষ বিদায় জানাবেন একা একা বসে। ৯৯ বছর বয়সী ডিউক অব এডেনবারার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন মাত্র ৩৫ জন অতিথি। প্রিন্স ফিলিপের মরদেহ প্যালেস থেকে হেঁটে চ্যাপেলে যখন নিয়ে যাওয়া হবে তখন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং প্রিন্স ফিলিপের চার সন্তান এবং দুই নাতী প্রিন্স উইলিয়াম এবং হ্যারি সঙ্গে থাকবেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। আর চ্যাপেলের ভেতরে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে করোনা বিধি-নিষেধ মেনে উপস্থিত থাকবেন ৩৫ জন অতিথি। লকডাউন আইন অনুযায়ী, ইংল্যান্ডে এখনো ফিউনারেলে ৩৫ জনের বেশি উপস্থিত হওয়া যাবে না। সেই নিয়ম এবং আইন মেনেই রাণী তাঁর স্বামীর শেষ কৃত্য অনুষ্ঠান করছেন। অতিথিরা বসবনেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। নিজে একা একা বসে স্বামীকে শেষ বিদায় জানাবেন! অথচ রাণী চাইলে কি না করতে পারতেন। এরিমধ্যে অতিথিদের তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। তালিকায় নাম নেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং লেবার লিডার স্যার কিয়ার স্টারমারের। লকডাউন আইন মেনে পারিবারিকভাবেই ১৭ এপ্রিল, শনিবার বিকেলে হবে প্রিন্স ফিলিপের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান।
জাতির অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রের আইনের প্রতি রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ যে শ্রদ্ধার নিদর্শন স্থাপন করলেন তা থেকে আমাদের সবার কিছুটা হলেও শিক্ষা নেওয়া উচিত।

লেখক : সম্পাদক, ব্রিটবাংলা এবং হেড অব নিউজ, চ্যানেল এস।

Advertisement