কোকা–কোলার দুনিয়ায়

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: গোলাকার ঘর। চারদিকে বেশ কয়েকটি বাঁকানো দেয়াল। আসলে এলইডি পর্দা। সেগুলোর উচ্চতা মাথা ছাড়িয়ে। পুরো ঘরে যেন পার্টির আবহ। সুরের মূর্ছনার সঙ্গে এলইডি পর্দায় নানা দেশের নানা মানুষের উচ্ছ্বাস। লাল রঙের ছড়াছড়ি। সময় যত গড়াচ্ছে, শব্দ-ছবিতে উত্তেজনা তত বাড়ছে। সামনের দুটি দেয়াল সরে যেতে থাকল। উত্তেজনা চরমে। লাল লেজার রশ্মি আলো-আঁধারির মধ্যে খেলা করছে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে এল বিশালাকার ধাতব এক কাঠামো। বড়সড় এক সিন্দুক। ভল্ট। পটভূমিতে গুরুগম্ভীর এক কণ্ঠ বলছে ‘দ্য সিক্রেট ফর্মুলা অব কোকা-কোলা ইজ হিয়ার।…’

গত ১৩ মে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় বাসে করে যখন সিএনএন টাওয়ারের দিকে যাচ্ছিলাম, তখনই চোখে পড়ে ‘ওয়ার্ল্ড অব কোকা-কোলা’। দালানের সামনে বড় একটা কোকা-কোলার বোতল, সবুজ লতাপাতায় ঢাকা। বাসে আমরা মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে আসা বেশ কজন সাংবাদিক, নানা দেশের। জানালা দিয়ে কোকের বড় বোতল দেখে অনেকেই বলে উঠলেন, সিক্রেট রেসিপি, সিক্রেট রেসিপি—এখানেই আছে। সেদিন আর সিক্রেট ফর্মুলার স্থানটি দেখা হয়নি। সেখানে যাওয়া হলো ১৫ মে।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টায়, যেখানে ওয়ার্ল্ড অব কোকা-কোলা, মানে বিশ্বখ্যাত এই কোমল পানীয়ের জাদুঘর, তার আশপাশে দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। কোকা-কোলার পাশেই জর্জিয়া অ্যাকুয়ারিয়াম। রাস্তা পেরোলে আটলান্টায় অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের শতবর্ষ উপলক্ষে তৈরি ‘অলিম্পিক সেন্টিনিয়াল পার্ক’। পার্কের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলে ওপারে সিএনএন টাওয়ার।

জাদুঘরে সব সময়ই থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়বাস এমন জায়গায় নামাল—এক দিকে অ্যাকুরিয়াম, আরেক দিকে ওয়ার্ল্ড অব কোকা-কোলা। সঙ্গে জ্যামাইকার টিভি সাংবাদিক জিওভানি ড্যানিস। তিনি আবার বাংলাদেশের ক্রিকেটার তামিম ইকবালের ভক্ত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ-বাংলাদেশের কোনো একটা ম্যাচে দেখেছেন তামিমের খেলা। জিওভানি বললেন, ‘বাণিজ্যিক একটা কোম্পানির জাদুঘর দেখতে হবে, তা-ও আবার গাঁটের পয়সা খরচ করে?’ বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবলাম দুজনেই। তবে কয়েক মিনিট পর আমরা এগোলাম ওয়ার্ল্ড অব কোকা-কোলার দিকে।

কংক্রিট আর ইটের হাঁটাপথ। পাশে সাজানো বাগান। এরই মাঝে ‘ড্রিংক কোকা-কোলা’ লেখা গ্লাস উঁচু করে হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ড. জন এস পেমবারটন, মানে তাঁর ধাতব ভাস্কর্য। ফলকে লেখা ১৮৮৬ সালে ড. জন এস পেমবারটন কোকা-কোলা উদ্ভাবন করেন। ১২১ বেকার স্ট্রিট এনডব্লিউ ঠিকানার এ জায়গার নামও পেমবারটন প্লেস। জাদুঘরের প্রবেশদ্বারের উল্টো দিকে কোকের বোতলের ধাতব মুখাটার বড়সড় এক নমুনা, ছাতা হয়ে আটকে আছে ওপেনারে। এটা তথ্যকেন্দ্র।

১৮ ডলারের টিকিট কেটে ঢুকলাম কোকা-কোলার দুনিয়ায়। শুরুতেই অভ্যর্থনা—বিনা মূল্যে কোক পান। সবুজ রঙের ক্যান কোক আগে দেখিনি। ওটাই নিলাম। এরপর মাঝারি এক প্রেক্ষাগৃহে মিনিট পাঁচেকের তথ্যচিত্র। এটায় মূলত তুলে ধরা হয়েছে গোটা পৃথিবীতে কোকা-কোলা কীভাবে মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে মিশে গেছে।

আরেকটা ঘর। আবার সেই গোপন সূত্রের আবহ। পোস্টারে লেখা, বিজ্ঞান কি এই সূত্রের গোপনীয়তা ভাঙতে পারে? কোকা-কোলার দাবি অনুযায়ী পারে না। কারণ, ‘গ্যাস ক্রোম্যাটোগ্রাফি’ পরীক্ষাও কোক প্রস্তুত-প্রণালির রহস্য ভেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এরপর একের পর এক গ্যালারি—শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোকা-কোলার বোতলের বিবর্তন, প্রচারণা, পোস্টার ইত্যাদির প্রদর্শনী। দোতলায় বড় একটা জায়গায় যেন কোমল পানীয় চেখে দেখার উৎসব। এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা—পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে স্প্রাইট, ফান্টা, থাম্বস-আপ, কিনলেসহ কোকা-কোলার যেসব পণ্য রয়েছে, সেসব ছোট গ্লাসে পান করার ব্যবস্থা রয়েছে।

জাদুঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় চোখে পড়ল বড় বড় কোকা-কোলার বোতল। আটলান্টার ১০ জন শিল্পী তাঁদের মতো করে বানিয়েছেন বোতল। প্রতিটিই হয়ে উঠেছে একেকটি শিল্পকর্ম।

২০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এই জাদুঘর উদ্বোধন হয়েছিল ২০০৭ সালের ২৪ মে। যদিও ওয়ার্ল্ড অব কোকা-কোলার যাত্রা শুরু ১৯৯০ সালে। আটলান্টারই অন্য ঠিকানায় ছিল সেটা। আটলান্টায় দর্শনীয় যত স্থান বা জাদুঘর রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কোকের এই দুনিয়াতেই দর্শক বেশি হতো। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম চালুর পর এটি দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে।

ওয়ার্ল্ড অব কোকা-কোলার নানা আয়োজন দেখে সহজেই বোঝা যায় কোমল পানীয় পান করা হয়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ। তা না হলে ‘একটা “কুক” দেন তো’ বললেই বিক্রেতা কেন নির্দিষ্ট কোমল পানীয় ক্রেতার হাতে তুল দেন!

Advertisement