গাইঞ্জা মঈনুল-মাসুদা এবং হাওর প্রীতি

কামাল মেহেদী

এক.
বাঙালী পাড়া হোয়াইটচ্যাপল রোডসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে কফি শপের এখন অভাব নেই। রৌদ্রজ্জল আবহাওয়ায় এসব কফিশপগুলোর বাইরে ফুটপাতের কিছু অংশ নিয়ে চেয়ার টেবিলও পাতা হয়। বলা বাহুল্য, এসব কফিশপের মালিক ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অবাঙালীদের সাথে কিছু বাঙালীও আছেন।
ইস্ট লন্ডনে টাওয়ার হ্যামলেটসের কেনন স্ট্রীটে ক্যাফে ইতালি নামে একটি ক্যাফে আছে। এক সকালে, আনুমানিক ১০টার দিকে গাড়ি চালিয়ে কমার্শিয়াল রোডে উঠবো। সামনে প্রচন্ড জ্যাম। রেড-গ্রীন লাইটের ফাঁকে একটা কি দু’টা গাড়ি পার হয়। খানিক দূর থেকেই এই ক্যাফের দিকে আমার লক্ষ্য। ইতালি থেকে আসা এক ভাই এই ক্যাফে করেছেন এবং বেশ ভালো চলছে। এখানে ইতাল-বৃটিশ প্রবাসীদের বেশ আড্ডা জমে। এই খবরটি আমি আগেই শুনেছি।

রেড লাইটে পড়ে একদম ক্যাফের সামনে আটকে আছি। গাড়ির জানালা দিয়ে থাকিয়ে দেখলাম, ক্যাফের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক। কেউ স্যুটেড উইথ ট্রেইনার। কারো হাতে অফিসিয়াল ব্যাগ। কেউ সিগার টানছেন এবং একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছেন।
এ সময় লম্বা দাড়িওয়ালা এক তরুন, সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় তাদের কাছে মাত্র ১টা পাউন্ডের জন্যে আকুতি করছে। তার পরনে লম্বা হাতের সাদা রংয়ের রো ফ্লরেন টি শার্ট এবং নাইকের শর্ট। পায়ে নাইকের চকচকা নতুন দামী ট্রেইনার। তাকে বেশ পশ দেখাচ্ছে। কতোক্ষন ধরে একটা পাউন্ডের জন্যে আকুতি-মিনতি করছে তা জানি না।
: দিলাওরেবা! দিলাও। এখটা পাউন্ড।
এভাবে বার কয়েক একে একে তিন চার জনের কাছে মিনতি করল সে। এরমধ্যে একজন খুব ঠান্ডা গলায় ভদ্রভাবে তাকে বললেন
: তুমি কাজ করনো না কেন? কাজে যাও।
আবারো সে ভদ্রলোককে তার ভাষায় অনুরোধ করল। বিফল তরুনটি তখন অশ্রাব্য দু’একটি শব্দ ব্যবহার করে তার ইমপ্লয়িকে গালি দিয়ে জানাল, গতকাল তাকে ছাটাই করা হয়েছে। আরো কতো কিছু বলে, হতাশ হয়ে সে কমার্শিয়াল রোড ক্রস করে ভ্যালান্স রোডের দিকে হাটতে থাকে।
আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আশা করি বুঝতে পারছেন এই তরুনের সমস্যা কোথায়! গাজা তিলে তিলে গিলে খাচ্ছে আমাদের তরুন-কিশোরদের।

দুই.
ইস্ট লন্ডনে বাঙালীদের প্রাণকেন্দ্র এক সময় ছিল ব্রিকলেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বাঙালীদের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠছে এখন হোয়াইটচ্যাপল। কাপড়, কাচামাল, গ্রোসারী, রেষ্টুরেন্ট, ক্যাফেসহ সবধরনের ব্যবসায় এখন হোয়াইটচ্যাপলে বাঙালীদের আধিপত্য। এটা কতোদিন থাকবে কে জানে!
এখানে বাংলাদেশী কায়দায় ব্যবসা হয়! অনেক ব্যবসায়ী আছেন বিশাল অংকের পাউন্ড বিনিয়োগ করে ব্যবসা খুলে বসে আছেন কিন্তু মানসম্মত কাস্টমার সার্ভিসের কোনো বালাই নাই তাদের মধ্যে! হোয়াইটচ্যাপলে বাঙালী কায়দায় চা-নাস্তা, আড্ডা হয়। মারা হয় উজির-নাজির। সরব আলোচনায় থাকে বাংলাদেশের রাজনীতিও।
হোয়াইটচ্যাল রোডের উপর দিয়ে প্রায়ই যাওয়া-আসা হয়। তবে সেদিন গিয়েছিলাম স্ত্রীর সঙ্গে কেনাকাটায়। টার্গেট ছিল কাপড়ের দোকানগুলো। পছন্দ এবং দর কষাকষিতে সমর্থন দেওয়া ছাড়া আমার বিশেষ কোনো কাজ ছিল না। বাঙালীদের ব্যবসার একটি ধরন দেখে হতাশ হলাম! হোয়াইটচ্যাপলে বাঙালী মালিকানাধীন কোনো গার্মেন্টস দোকানে মহিলাদের জন্যে ট্রায়াল রুম নেই! শুধু নন-বাঙালী মালিকানাধীন একটি গার্মেন্টস দোকানে সেই সুযোগটি আছে। শুধু হোয়াইটচ্যাপল নয়, বেথনালগ্রীন এবং গ্রীনস্ট্রীটে বাঙালী মালিকানাধীন শাড়ি এবং সেলোয়ার কামিজের দোকানগুলোতে একই অবস্থা! দু’একটিতে থাকলে থাকতেও পারে। তবে প্রায় নিরানব্বই শতাংশেই সেই সুযোগ নেই। কিন্তু নন-বাঙালী মালিকানাধীন বেশির ভাগ দোকানেই সেটি রয়েছে।
এবার আসি অন্য কথায়। আমার স্ত্রী একটি শাড়ির দোকানে প্রবেশ করেছেন। আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আর পাশেই একটি ক্যাফের সামনে দাঁড়িয়ে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছেন দু’জন। কথা হচ্ছে ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন এবং সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে নিয়ে। আমাকে দেখে তাদের কথার মধ্যে উত্তেজনার মাত্রা একটু বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। তাদের সঙ্গে স্টল থেকে এসে আরেকজন যোগ দিলেন। তিনিও আমাকে চেনেন। চোখ ইশারা হল। তিনি গিয়ে বললেন,
: কিতাবা খারে মাররায়? খারে নিয়া জাবর খাটরায়?
: মাসুদারে!
: খয়েখ বছর আগেউ … ওবায় আটিয়া গেছে বহুতবার! হও সময় যদি বুঝতাম রে বেটা…।
: কিতা যে খঔ রেবা। খালি গাইঞ্জাকুরের লাখানি মাতলে অইত নায়।
এভাবে মাসুদা ভাট্টির উপর চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। মাঝে মাঝে টেনে আনা হচ্ছে তসলিমা নাসরিন আর আব্দুল গাফফার চৌধুরীকেও। সামাজিক মাধ্যমের সুবাধে সাধারণ মানুষের নখ দর্পনে এখন সব কিছু। আমি বেশিক্ষণ মনোযোগ দিতে পারিনি। কতোক্ষন চলেছে জানি না।


তিন.
হালে ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেইন এবং মাসুদা ভাট্টি-ই সর্বত্র। লন্ডন সফররত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের ডেপুটি এডিটর পীর হাবিবুর রহমানকে নিয়ে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠানেও ঘুরে ফিরে মাসুদা ভাট্টি-ব্যারিষ্টার মঈনুলের স্থানই ছিল অগ্রভাগে। ব্রিকলেনের আমার গাঁও রেষ্টুরেন্টের ছোট্ট পরিসরের অনুষ্ঠানের শেষভাগে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। কিন্তু আলোচনার রেশে যা বুঝলাম, সেখানে নির্বাচন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং মাসুদা ভাট্টি ছিলেন কেন্দ্র বিন্দুতে।
পীর হাবিব সুনামগঞ্জের অহঙ্কার। হাওরপাড়ের সন্তান। হাওরের সঙ্গে সখ্যতা আছে আমারও। আমি গ্রামের ছেলে। হাওরের চান-কপালি ঢেউ এখনো চোখের সামনে ভাসে। জীবনভর নানা-বাড়ি যাওয়া আসা করেছি নৌকায়। নানার বিখ্যাত সেই লাল নৌকা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পালের নৌকায় ইঞ্জিন লেগেছে এই যা, কিন্তু কোড়া আর লাল রং ছিল নানার নিত্যসঙ্গী।
সুনামগঞ্জের বিশাল এলাকাজুড়ে এখনো বর্ষায় পাও এবং হেমন্তে নাও-ই ভসরা। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির প্রয়াত দুই কিংবদন্তী নেতা বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং আব্দুস সামাদ আজাদের নির্বাচনী এলাকার কথাই বলছি। তবে এখন পরিবর্তন আর উন্নতির যে কিছু ছোঁয়া লেগেছে, স্বদিচ্ছা হলে দুই নেতা জীবদ্দশায় এর চাইতে আরো বেশি উন্নতি করতে পারতেন নিজ নিজ এলাকার। তারা ‘জাতীয় নেতা’ এই খেতাবেই কপাল পুড়েছিল এলাকার সাধারণ মানুষের।
তবে মনে হয় রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে নিজের নির্বাচনী এলাকা নিয়ে কিছুটা ভাবতে শুরু করেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ২০১১ সালের মার্চে লন্ডনের ডকল্যান্ডের এক বাসায় বসে বাবু সুরঞ্জিত সেন তাঁর ভাবনার কিছু কথা বলেছিলেন। লন্ডনে সবার প্রিয়, প্রয়াত শাহাব উদ্দিন বেলাল ভাইয়ের সহযোগিতায় সেদিন চ্যানেল এসের জন্যে একটি স্বাক্ষাতকার নিয়েছিলাম বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। তিনি যখন আমার ঠিকানা জানলেন, তখন আর যাই কই!
১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগে যোগ দেবার পর একই বছরের নির্বাচনে দিরাই-শাল্লায় পরাজিত হন সুরঞ্জিতন সেনগুপ্ত। আর একই বছর বানিয়াচং-আজমিরিগঞ্জের আওয়ামীলীগের এমপি এডভোকেট শরীফ উদ্দিন আহমেদ মারা যান। পরবর্তীতে সেন বাবু বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জের উপনির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হয়ে পাশ করেন। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, কুশিয়ারী-কালনীর মরামুখে একটি ব্রিজ করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। টুকচানপুরের কাছে বাঁধ দিয়ে কালনীর গতিপথ মেরে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। তবে হাওর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রসঙ্গটি তুলতেই কিছুটা ক্ষেপে যান তিনি। দীর্ঘদিন থেকে প্রকল্পটির কথা বলে যাচ্ছেন কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না! হাওর উন্নয়ন প্রকল্প এবং কালনী-কুশিয়ারা, সুরমা-বিবিয়ানা খনন করতে পারলে এই এলাকার সাধারণ মানুষের ভাগ্য পাল্টে যাবে। যদিও এখন চিত্র কিছুটা পাল্টে গেছে। নদী ও নৌপথ বলতে গেলে মরেই গেছে এখন। এই এলাকায় সবচাইতে দুর্দান্ত কুশিয়ারা এখন মৃত প্রায়। শেরপুর থেকে আজমীরিগঞ্জের নৌপথে এখন কালেভদ্রে লঞ্চ যাতায়াত করে। ইঞ্জিন নৌকার প্রভাবই এখন বেশি। আর স্থলপথে এখন নবীগঞ্জ-ইনাগঞ্জ হয়ে গাড়ি চলে আসে মার্কুলীবাজারে। অন্যদিকে রাণীগঞ্জ বাজারে কুশিয়ারা নদীর উপর তৈরী হচ্ছে বিশাল সেতু। যেটা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের জীবদ্দশা হওয়া উচিত ছিল বলে আমার বিশ্বাস। এখন হচ্ছে অর্থপ্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নানের প্রচেষ্টায়। এই ব্রিজের ফলে জগন্নাথপুরসহ সুনামগঞ্জের হাওর অঞলের মানুষের জন্যে ঢাকার পথ আরো সহজ হয়ে যাবে। অন্যদিকে এই এলাকার হাওর অঞ্চলের মানুষের জন্যে সিলেট না ছুঁয়ে সুনামগঞ্জ জেলা সদরে যাওয়ার রাস্তাও হয়েছে এখন। তারপরেও ভাটিবাংলার মানুষকে বর্ষার বঞ্চনা সইতে হয়। বর্ষার ভানে যখন হাওর ভাসে, তখন দূরে প্রবাসীদের চোখেও জল আসে।
ভাটি বাংলার হাওর পাড়ের মানুষ পীর হাবিব। শেষভাগে হাওরটাই উঠে আসে তার সঙ্গে আলোচনায়। যদিও মাসুদা-মঈনুল তোপের কাছে তা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। তবে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান হাওর পাড়ের মানুষের দু:খ দুর্দশাকেই গুরুত্ব দেন এবং আগামীতেও দিবেন। হাওর উন্নয়নের পাশাপাশি বাঁধ নির্মাণ দুর্নীতিতে  জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিতে তাঁর শানিত কলম সর্বদা সোচ্ছার থাকবে, হাওর পাড়ের মানুষের এটাই প্রত্যাশা তাঁর কাছে।

লেখক : সম্পাদক, ব্রিটবাংলা২৪.কম এবং চ্যানেল এসের বার্তা বিভাগের প্রধান।

Advertisement