গ্রানাইট শহরে একদিন

:শাফি নেওয়াজ শিপু:

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় সময় এই প্রশ্নটি দেখা যায়- গ্রানাইটের শহর কোন সিটিকে বলা হয়?
প্রশ্নটির উত্তর হয়তো অনেকেরই জানা, কিন্তু কী কারণে বলে ও এর পেছনে কী কারণ, তা এই গ্রানাইট সিটিতে না গেলে কখনোই জানা হতো না।

স্কটল্যান্ড এমন একটি দেশ যেখানে প্রত্যেকটি শহরকে কেন্দ্র করে এক একটি ইতিহাস রচিত।

এডিনবারাহ থেকে শুরু করে ইনভারনেস পর্যন্ত, প্রত্যেকটি শহর কোনো না কোনো কিছুর জন্য বিখ্যাত।

প্রমাণ পেলাম গ্রানাইটের শহর এবারডিনে গিয়ে।
হুট করে পরিকল্পনা ছাড়াই এবারডিনের উদ্দেশ্যে লন্ডন থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম।

দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা বাস ভ্রমণ করে যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছালাম, কেনো জানি এক সেকেন্ডের মধ্যে সমস্ত ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়ে।

শহরটির মনোমুগ্ধকর মনোরম পরিবেশ প্রশান্তি নিয়ে এলো মনে।
প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম এবারডিনের বাড়িঘর ও দালানকোঠা দেখে।

কারণ তখন ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো, আমি কোনো ধূসর বা সিলভার শহরে আছি, যেখানে সাদা রঙ বা অন্য কোনো রঙের খেলা নেই। আর মনে করার পেছনে শুধু একটাই কারণ, এখনকার প্রত্যেকটি বাড়িঘর ধূসর রঙের গ্রানাইট পাথরের তৈরি।

শুধু যে ধূসর রং তা নয়, সাথে সিলভার রঙ-ও মিশ্রিত, যার কারণে এই শহরকে গ্রানাইট শহর বলা হয়।
তাছাড়া এখানকার বাড়িঘরগুলো এতো সুন্দর সারিবদ্ধভাবে সাজানো, দেখে মনে হয় কল্পনার রাজ্য। এখানে আসার পর অনেকের কাছে জানতে পারলাম, এবারডিনকে অনেকেই অন্য একটি নামে চেনে, সেই নামটি হলো ‘গ্রানাইট সিটি’।

বাড়িঘরের রঙ দেখে যতো না অবাক হয়েছি, তার থেকে আরও বেশি অবাক হয়েছি পুরো শহর জুড়ে বড় বড় জাহাজ দেখে।
ততোক্ষণ পর্যন্ত কোনো ধারণা ছিলো না, কেন শহরটির মাঝখানে এতো বড় আকৃতির জাহাজ।

তারপর গাইডের মাধ্যমে জানতে পারলাম, এই এবারডিন মূলত স্কটল্যান্ডের বন্দর নগর এবং স্কটল্যান্ডের তৃতীয় জনবহুল শহর। এছাড়াও সেই সাথে এটি ‘এনার্জি ক্যাপিটেল অফ দ্যা সিটি’ নামেও পরিচিত।
এই শহরের সাথে যে সমুদ্রের অনেক দিনের সম্পর্ক, তা জানার জন্য সবাইকে ‘এবারডিন মেরিটাইম মিউজিয়াম’ দর্শন করা উচিত। এই মিউজিয়াম হাউজের অনন্য কালেকশনগুলো হচ্ছে: শিপবিল্ডিং, ফাস্ট সেইলিং শিপস্, ফিসিং ও পোর্ট ইতিহাস।

এছাড়াও রয়েছে নর্থ সমুদ্র তেল ও গ্যাস শিল্পের ইতিহাস।
যেকোনো সময় এই মিউজিয়ামে দর্শন করা যাবে। সোমবার থেকে শনিবার পর্যন্ত সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আর রোববারে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকে পর্যটকদের জন্য।

তবে টিকিটের সিস্টেম নেই বলে সব শ্রেণির মানুষের জন্য সুবিধা হয়েছে এই বন্দর সিটির ইতিহাস জানার। এমনকি এর ভেতরে আর্ট গ্যালারি আছে, যার মাধ্যমে পুরো ইতিহাস আপনার চোখের সামনে ফুটে উঠবে।
‘এবারডিন মেরিটাইম মিউজিয়াম’ হচ্ছে মূলত মেরিটাইম জাদুঘর, যা স্কটল্যান্ডের বন্দর সিটি এবারডিনেই অবস্থিত। এখানে থেকে হারবার কাছে।

এই জাদুঘরে যে কালেকশনগুলো আছে, সেগুলো হচ্ছে শিপবিল্ডার্স এবারডিন, যেখানে অন্তভুক্ত করা হয়েছে হাল, রাসেল অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, আলেকজান্ডার হাল এন্ড সান, দ্যুতি এন্ড জন লুইস কোম্পানি লিমিটেড এবং ওয়ালটার হুড অ্যান্ড কোম্পানি।
এছাড়াও আছে শিপ ও ওয়েল রিগ মডেলস, পেইন্টিং, ক্লিপার শিপ অ্যান্ড নর্থ বটস যন্ত্রপাতি, ফিসিং, কর্মাশিয়াল ট্রলার, নর্থ সি ওয়েল কারখানা এবং সাথে আছে মেরিন পরিবেশ।
এই মিউজিয়ামের মাধ্যমে জানা হলো শহরটির সাথে দীর্ঘদিনের সামুদ্রিক সম্পর্কের পুরো ইতিহাস ও ঐতিহ্য, যা দেখে এবারডিন সিটিকে আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায়।
এরপর আমরা সবাই মিলে পরিকল্পনা করলাম, যেহেতু একটি নতুন শহরে এসেছি, সুতরাং তাদের স্থানীয় খাবারের স্বাদ নেওয়া উচিত। তারপর আর দেরি না করে আবার বেরিয়ে পড়লাম।

দুপুরের খাবারের পর আবার বেরিয়ে পড়লাম এখানকার সমুদ্রসৈকত উপভোগ করার জন্য।
এবারডিন সমুদ্রসৈকত সিটি সেন্টার থেকে খুব একটা বেশি দূরে নয়।

বাস বা ক্যাবে করে খুব সহজে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। এবারডিন সি-বিচটির পুরো নাম হচ্ছে ‘এবারডিন বিচ অ্যান্ড কুইন্স লিংক’। এটি বিখ্যাত তার গোল্ডেন স্যান্ড বা বালি ও কার্ভ আকৃতির জন্য। এই বিচটি খুব জনপ্রিয় সার্ফার, ওয়ার্কারস ও উইন্ডসারফার্সের জন্য।
সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি আমাকে আর্কষণ করেছে, তা হলো এই বিচটির আশেপাশে রয়েছে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, রেস্টুরেন্ট, পাব, সিনেমা হল ও একটি লেজার সেন্টার, যেখানে সুইমিং পুল, আইচ রিংক এবং ইনডোর স্পোর্টস হল আছে। হয়তো এই সমস্ত সুবিধার কারণে পর্যটকরা বার বার ফিরে আসতে চায় এই সমুদ্রসৈকতে।


এমনকি আপনি লোকাল বাসে ডে-টিকেটের মাধ্যমে পুরো শহরকে এক পলকে দেখে ফেলতে পারবেন। টিকেটের মূল্য যে খুব একটা বেশি তা নয়, মাত্র ৪ পাউন্ড।

এরপর লোকাল বাসে ভ্রমণের মাধ্যমে দেখা হয়ে গেল আশেপাশের টুরিস্ট স্পট, সাথে এবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ও।
তবে অল্পদিনের ভ্রমণ হওয়াতে অনেক কিছু দেখা থেকে বাদ পড়ে গেলো।

তারপরও লন্ডনের ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে পেয়েছি এই গ্রানাইটের শহরে এসে।

লেখক:সাবেক গণমাধ্যম কর্মী,কন্ট্রিবিউটর ব্রিট বাংলা 

ই-মেইল: topu1212@yahoo.com

Advertisement