ঘুষ-দুর্নীতির অক্টোপাস এবং আশায় ঘর বাঁধা

এ কে এম শাহনাওয়াজ

আমার এক সহকর্মী অধ্যাপক বিস্মিত করে জানালেন, তাঁর বাসায় কোনো খবরের কাগজ রাখেন না। নিজে পড়েন না, চেষ্টা করেন ছেলে-মেয়েরা যাতে বিরত থাকে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও টেলিভিশন থেকে বিরত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আতঙ্ক থেকে মুক্তি নেই আত্মভোলা এই বিজ্ঞানীর। তাঁর দৃষ্টিতে ভালো কোনো খবর থাকে না পত্রিকায়। সন্ত্রাস, খুনোখুনি, দুর্ঘটনা, ঘুষ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ঝগড়া—এসব নেতিবাচক বিষয় পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে। ভালো কথা লেখার সুযোগই যেন নেই। অধ্যাপক মহোদয়ের শঙ্কা এসব পড়ে আর শুনে প্রজন্মের এখন বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষাটিই মরে যাবে। রাজনীতি ঘরানার ক্ষমতাবান নেতা-নেত্রীরা যে ভাষা, শব্দ চয়ন ও দেহভঙ্গিতে কথা বলেন টেলিভিশনের পর্দায়, তা দেখে প্রজন্মের স্বপ্নভঙ্গ হবে। আমার এই সহকর্মী সেদিন খুব চমকে গিয়েছিলেন। সদ্য কলেজে পড়ুয়া ছোট ছেলে বিশেষজ্ঞের মতামত দিয়ে বলল, চোর, ডাকাত, খুনিদের নিজ পেশা ঠিক রাখতে রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিত। অবশ্যই সরকারি বা ভবিষ্যতে সরকারি দল হবে তেমন দলে। কারণ চুরি, ডাকাতি বা খুনখারাবি করে ধরা পড়লে জেলে গেলে ক্ষতি নেই। দল ক্ষমতায় থাকলে বা ক্ষমতায় গেলে এগুলো রাজনৈতিক মামলা বলে চিহ্নিত হবে। দেশের আদালত নয়—রাজনীতিবিদদের গড়া আদালত থেকে এক কলমের খোঁচায় মুক্তি পেয়ে যাবে এই অপরাধীরা। আমাদের অধ্যাপক মহোদয় এমন অন্যায়ের অক্টোপাস থেকে মুক্তি পেতে চান বলেই চলমান সময়টি নিয়ে তাঁর হতাশা। তার পরও মনের ভেতর প্রত্যাশা লুকিয়ে রাখেন ‘আবার সুনীতির সঙ্গে দেখা হবে আমাদের।’

রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির সঙ্গে আমাদের কমবেশি বসবাস বহুকাল থেকেই। যদি খুব বেশি পেছনে না যেতে চাই তবে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্ব থেকে দৃষ্টি বুলাতে পারি। এই সত্যটি মানতেই হবে, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে দুর্নীতি রাহুর মতো আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে। তবে ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যেভাবে রাজনৈতিক দুর্নীতির খেরোখাতা উন্মোচিত হয়েছিল, তা সেই সময়ের বিচারে অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। সাধারণের কাছে রাজনীতি আর দুর্নীতি সমান্তরালে এসে দাঁড়িয়েছিল। ব্যক্তি-দুর্নীতি বরাবরই ছিল। তবে সাম্প্রতিককালের মতো এত বাড়বাড়ন্ত হয়তো ছিল না। প্রশাসনিক দুর্নীতি হিসেবে ঘুষ শব্দটির সঙ্গেই মানুষের জানাশোনা ছিল বেশি। সুযোগ থাকলেও ঘুষ সব পেশাজীবী খেত না। যারা ঘুষ খেত সমাজে তারা খুব মাথা উঁচু করে চলত না। নিন্দনীয় বলে ‘ঘুষখোর’ শব্দটির জন্ম হয়েছিল। এখন ঘুষের পরিধি অনেক বেড়েছে। ঘুষখোরের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। নানা নামে ঘুষ শাখা-প্রশাখা মেলেছে। যা সাধারণ শব্দে ব্র্যাকেটবন্দি করা হয় ‘দুর্নীতি’ নামে। এখন নাগরিক জীবনের নানা সেবা খাতে কমিশন বা পারিতোষিক, চাকরি বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ব্যাংকের টাকার হরিলুট, অসৎ উদ্দেশ্যে ঋণখেলাপি হওয়া এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায় নানা আইনের ফাঁক তৈরি করে সব হজম করে ফেলা, টেন্ডারবাজি—ইত্যাকার নানা নামে দুর্নীতির দাপুটে অবস্থান। দুর্নীতিবাজরা সমাজে বুক ফুলিয়ে চলে। কারণ রাজনীতির গুরুরা তাদের আশ্রয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে নানা রকম সম্পর্ক থাকে। বিচারব্যবস্থায়ও নাকি তাদের হাত ক্রমপ্রসারিত হয়। শোনা যায় ঘুষ বা কমিশনবাজদের আয়ের ওপর আবার ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলের কমিশন আছে। এভাবে রাজনীতি এখন লাভজনক চাকরিতে পরিণত হয়েছে। তাই দুর্নীতির গোড়াঘর এখন অনেকটাই ক্ষমতাধর রাজনীতি।

আমার এক বন্ধু তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। বললেন তাঁর মতো ৯৯ জন ভুক্তভোগীর একই অভিজ্ঞতা। পৈতৃক সূত্রে ঢাকায় একখণ্ড জমি ছিল তাঁর। নিজের সংগতি নেই তাই ডেভেলপারের হাতে তুলে দিয়েছেন জমিটি। ডেভেলপার কম্পানির এমডি বললেন, আপনি কাছে থেকে লক্ষ করুন হাড়গিলারা কিভাবে হাঁ করে থাকে। প্ল্যান পাস করাতে রাজউকের মুখে ঢালতে হলো লক্ষাধিক টাকা। এরপর গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স, ফ্ল্যাট মালিকদের নামজারি, খারিজ ইত্যাদি সব বিষয়ে যেভাবে ঘুষ দিতে হলো, তা দেখে বন্ধুটি বললেন, স্বাধীন দেশে নাগরিকদের জিম্মিদশা চলছে। ঘুষখোরদের ঘুষ যেন অধিকার। প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ নেই। না হলে কাজ বন্ধ হয়ে থাকবে। আর এই দুর্নীতিবাজদের এমন প্রকাশ্য দাপট কেন? কারণ ঘুষখোরদের ওপর চাঁদা আরোপিত আছে ক্ষমতার রাজনীতিক আর দলের। তাই রাজনৈতিক দুর্নীতির ছাতার নিচেই তাদের অবস্থান।

নীতিহীনতা আর অন্যায় নীতিই তো দুর্নীতি। ক্ষমতার রাজনীতির বিধায়করা কি শির উঁচু করে বলতে পারবেন যে তাঁরা পরিশীলিত রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন? নিজেদের ব্যক্তিতন্ত্র আর গোষ্ঠীতন্ত্রের বাইরে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন? ‘লীগ’ আর ‘দল’ যা-ই বলি না কেন, শ্রমিক সংগঠনসহ সব পেশাজীবী সংগঠনকে কি দুর্নীতিগ্রস্ত আর চাঁদাবাজে পরিণত করেনি রাজনৈতিক দলগুলো? ছাত্ররাজনীতির নামে কি এই রাজনীতিকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কলুষিত করেননি? শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরির বদলে রাজনীতির নামে ছাত্রশক্তিকে কি লাঠিয়াল বানাননি? অস্ত্র আর অর্থ প্রাপ্তির পথ কি তাঁরা শিখিয়ে দেননি? একজন মেধাবী ছাত্রকে চাঁদাবাজ আর সন্ত্রাসী বানাতে কি তাঁরা প্রশ্রয় দেননি? শিক্ষক রাজনীতির ক্ষমতাবানরা কি স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে ক্যাম্পাসকে অন্ধকারে ঠেলে দেন না?

বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশে যেসব রাজনৈতিক দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে, এর বেশির ভাগের উৎসই হচ্ছে নির্বাচনে টাকার খেলা। এ জন্য চলে নানা চেহারার চাঁদাবাজি। এসব চাঁদাবাজি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহারের জন্য করা হয় না, হয় দল পরিচালনা ও নির্বাচনী ফান্ড তৈরি করতে। এ ধরনের চাঁদাবাজিকে এতটাই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয় যে তা এই প্রতিযোগিতায় থাকা সব পক্ষের জন্য হয়ে পড়ে গা সওয়া। সব পক্ষই যখন এক ঘাটের জল খায় তখন এসব নিয়ে প্রশ্ন আর কে তুলবে! ক্ষমতায় তো হয় আমি আসব, নয় তুমি আসবে। এ ধরনের সরল ভাবনাই হয়তো পেয়ে বসেছে সবাইকে।

বড় দলগুলোর নির্বাচনে ব্যয়ের ক্ষেত্র অনেক সম্প্রসারিত হয় প্রতিবারেই। যেমন একটি ব্যয় পরিচালনা করতে হয় দলীয়ভাবে, আরেকটি ব্যয় করতে হয় প্রার্থীকে। এ ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে পরবর্তী সময় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে প্রস্তুতি ও খরচ এক রকম, আবার বিরোধী দলে থেকে নির্বাচন মোকাবেলার প্রস্তুতি ও খরচ অন্য রকম। নির্বাচনী ফল নিজ দলের পক্ষে রাখার জন্য ক্ষমতায় থাকতেই দলীয় লোক বসাতে হবে উপযুক্ত জায়গাগুলোতে। এসবের জন্য প্রয়োজন শত-সহস্র কোটি মুদ্রা। আর তা নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্তিশালী সেল চাই। এসবের জন্যই দুর্নীতির প্রতীক হয়ে যাওয়া হাওয়া ভবনের মতো ভবনগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। এমন জটিল কার্যক্রম সফল করার জন্য বিপুল অর্থের চাঁদা যাদের ওপর আরোপ করা হয়, বিনিময়ে তাদের প্রভূত সুবিধা দিতে হয় রাষ্ট্রের ও প্রশাসনের বারোটা বাজিয়ে। এ কারণেই শত শত কোটি টাকার ঋণখেলাপিরা ঋণের টাকা নিজেরাই যেন তামাদি ঘোষণা করে মাথা উঁচু করে চলেন, আবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে এমপিও হন। ভবনগুলোর সবুজ সংকেতে সরকারি খাস জমিগুলোকে নিজেদের তালুক বানিয়ে ফেলেন। লাখ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা নিজ এবং পরিজনদের নামে দেশ এবং বিদেশের ব্যাংকে তুলে রাখেন। টেন্ডারবাজি, লাইসেন্সবাজিতে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় এগিয়ে থাকেন।

বিরোধী দলও চেষ্টা করে টাকা সংগ্রহে এগিয়ে থাকতে। কখনো টেক্কা দিতে চায় সরকারি ষড়যন্ত্রকে। নির্বাচনী ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, একদা সরকারি দলের ফিট করা নির্বাচন কমিশন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানকে ‘সূক্ষ্মভাবে’ গোপন নিলামে উচ্চ দরে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে বিরোধী পক্ষ। সফল হলে হোঁচট খাওয়া পক্ষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে।

অন্যদিকে দলের আশীর্বাদ নিয়ে প্রার্থীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন নির্বাচনী খরচ জোগাতে। ব্যবসায়ী আমলা জোগাড় করে যে যার কায়দা মতো। বণিক বুদ্ধি মুনাফা খোঁজে। অর্থ দেওয়ার বিনিময়ে ভবিষ্যতে তা বহুগুণে ফিরে পাওয়ার অঙ্গীকার আদায় করে নেয়। এমনও শোনা যায়, অনেক অর্থলগ্নিকারী বণিকগোষ্ঠী আছে যারা কোনো ঝুঁকিতে থাকতে চায় না। ক্ষমতার সিঁড়িতে পা রাখা দুই পক্ষকেই টাকা বিলিয়ে যায়। কারণ ক্ষমতায় যে-ই আসুক বণিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা যাবে না।

এসবের পরও প্রতিযোগিতার নির্বাচনে আরো অর্থের দরকার পড়ে। তখন শুরু হয় মনোনয়ন বিক্রি। কোটি কোটি টাকা দলীয় ফান্ডে দিয়ে দীর্ঘদিন মাঠপর্যায়ে রাজনীতি করা ত্যাগী নেতাকে কনুইয়ের গুঁতোয় ঠেলে ফেলে ভুঁইফোড় বণিক আর অর্থবাজ আমলা নির্বাচনের টিকিট পেয়ে যান। স্বাভাবিকভাবেই এই এমপিদের চোখে দেখার সৌভাগ্য এলাকাবাসীর প্রায়ই হয় না। এই বণিক-রাজনীতিকরা সংসদ সদস্যের টিকিট বুক পকেটে রেখে নির্বাচনে লগ্নি করা টাকা বহুগুণে ফেরত আনার নানা তদবিরে ব্যস্ত থাকেন।

তবুও মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে। বিগত দিনেও এ দেশের মুক্তচিন্তার মানুষ লক্ষ করেছে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা নির্বাচনী অঙ্গীকার রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এবার নির্বাচনী অঙ্গীকারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। গত ২৫ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি তাঁদের এই অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে তাঁর সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। এরই মধ্যে দুদকের কিছু কিছু তৎপরতা আমাদের নজরে পড়ছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অসুস্থ কাঠামোর ভেতর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কতটা সহযোগিতা পাবেন—এ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তবে আমরা আশা করি চারপাশটি একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি। তাঁর গঠিত নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেতে সরকারি সৎপদক্ষেপে সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সহযোগিতা পাবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এই শাসনপর্বে তিনি যদি দুর্নীতি মুক্তির পথে ৫০ শতাংশ সাফল্যও দেখাতে পারেন, তবে পাঁচ বছর পর আওয়ামী লীগকে আর পেছনে তাকাতে হবে না। একটি বড় প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ এখন অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে নতুন সরকারের দিকে।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement