চতুর্থ প্রজন্মের কার্যক্রম ও বাংলাদেশ

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: আজ আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী দিবস। সমগ্র বিশ্বের শান্তিরক্ষী বাহিনী, বিশেষ করে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী এবং যাঁরা এ মহৎ কাজে শাহাদতবরণ করেছেন, তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সারা বিশ্বের নানা সংঘাতকবলিত অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য ও ভূমিকা রয়েছে। কোন দেশের মোট কতজন সৈন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত, সেই সংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশ প্রথম তিনটি দেশের মধ্যে রয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ বাংলাদেশের ৭ হাজার ২৪৬ জন সৈন্য ও পুলিশ সারা বিশ্বে ১০টি মিশনে কর্মরত। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা মোট ৪০টি দেশের ৫৪টি শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৩২ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বিভিন্ন সংঘাতকবলিত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে। আমরা শুধু শান্তি বজায় রাখি না, শান্তি রপ্তানিও করি।

‘জাতিসংঘ চার্টার’ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা কেমন হবে, সেটার জন্য দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সারা বিশ্বে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শান্তিরক্ষা মিশনগুলোর ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। সংঘাত ও সহিংসতার ধরনে যেমন বিবর্তন ঘটেছে, সেটাকে ঠিকমতো মোকাবিলা করার জন্য শান্তিরক্ষা মিশনগুলোর ধরনেও সংস্কার আনতে হয়েছে। গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে শান্তিরক্ষা মিশনগুলোর মোট চারটি ধাপ পরিলক্ষিত হয়, যেগুলোকে বিভিন্ন প্রজন্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।

শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের প্রথম প্রজন্মের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষী বাহিনী দুটি সংঘাতময় পক্ষকে নিরস্ত্র করার লক্ষ্যে সরাসরি তাদের মাঝখানে অবস্থান করে। উদাহরণ হিসেবে ইউনাইটেড নেশনস ইনটারিম ফোর্স ইন লেবাননের (ইউএনআইএফআইএল) নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এই শান্তিরক্ষী বাহিনী সরাসরি লেবানন ও ইসরায়েলি বাহিনীর মুখোমুখি হয়। এই ধরনের মিশনে শান্তিরক্ষীদের সক্ষমতা অনেক সীমিত থাকে। তাঁদের ভারী অস্ত্র ব্যবহার করার সুযোগ থাকে না। তা ছাড়া এই প্রজন্মের শান্তিরক্ষীদের সংঘাত নিরসনের বাইরে অন্য কোনো কাজ, যেমন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।

প্রথম প্রজন্মের মিশনগুলোর সীমাবদ্ধতা এবং মিশন ম্যানডেট ও অপারেশনাল রিকয়ারমেন্টের কারণে দ্বিতীয় প্রজন্মের উদ্ভব ঘটে; সেটা ‘বহুমাত্রিক মিশন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই প্রজন্মের শান্তিরক্ষীরা কেবল যে শান্তি রক্ষার জন্য কাজ করেন তা-ই নয়, বরং নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও অনুষ্ঠান, মাইন উত্তোলন ইত্যাদি কাজেও নিয়োজিত হন। যেমন ইউনাইটেড নেশনস ট্রানজিশনাল অথরিটি ইন কম্বোডিয়া (ইউএনটিএসি), এটা কম্বোডিয়ার দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য গঠন করা হয়েছিল। এই শান্তিরক্ষী বাহিনী পুরো কম্বোডিয়ার প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নিয়েছিল, নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছিল এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। শান্তিরক্ষা মিশনের বিবর্তনের ক্ষেত্রে এটাই জাতিসংঘের প্রথম সারির বহুমাত্রিক অপারেশন ছিল। এর ধারাবাহিকতায় শান্তি টেকসই করার জন্য পরবর্তীকালে ইউনাইটেড নেশনস মিলিটারি লিয়াজোঁ টিম (ইউএনএমএলটি) নামে একটি স্থিতিশীলতা পর্যবেক্ষণ মিশনের জন্ম নেয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিযুক্তির সিদ্ধান্ত অনুসারে এই অপারেশনের মিশনপ্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়ার আমার সুযোগ হয়েছিল বলে এসব মিশনের কার্যক্রম খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করতে পেরেছিলাম।

এরই ধারাবাহিকতায় সংঘাতের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি শান্তিরক্ষা প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটে, যেটাকে শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এই প্রজন্মের মিশনগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে জাতিসংঘ চার্টারের সপ্তম ধারার প্রয়োগ ঘটিয়ে শান্তিরক্ষী বাহিনী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে যদি প্রয়োজন হয়, ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে যুদ্ধের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই মিশনগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরালো ও শক্ত হাতে পরিচালনা করা হয়।

শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের বিবর্তনের মধ্যে সর্বশেষ স্তর হচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম। এটা বিশদ বিশ্লেষণের দাবি রাখে এবং এটা বাংলাদেশের জন্য বেশ তাত্পর্যপূর্ণ। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ প্রজন্ম আগের প্রজন্মগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা। প্রথম সারির সৈন্য সরবরাহকারী দেশ হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত রাখার জন্য বাংলাদেশকে এখন থেকেই চতুর্থ প্রজন্মের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে ভালোমতো অনুসন্ধান এবং সে অনুসারে নিজেকে তৈরি করতে হবে। এ প্রজন্মের শান্তিরক্ষা মিশনগুলোর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।

চতুর্থ প্রজন্মের শান্তিরক্ষা মিশনগুলো প্রযুক্তিনির্ভর। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমকে সম্পূর্ণ সফল করার জন্য এতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটানো হয়েছে। সংঘাতকবলিত এলাকা অনুসন্ধান এবং যথাযথ পরিকল্পনা সাজানোর জন্য কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্য নেওয়া হয়। সংঘাতপূর্ণ এলাকা কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য ড্রোন ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া রোবট, সেনসর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগানো হয়। অর্থাৎ চতুর্থ প্রজন্মের শান্তিরক্ষা মিশনগুলোর প্রতিটা ক্ষেত্রে সর্বশেষ প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।

আগের প্রজন্মের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, কেবল সংঘাত নিরসন যথেষ্ট নয়, সেটা ধরে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। তাই চতুর্থ প্রজন্মের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষীদের দায়িত্ব কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠাতে সীমাবদ্ধ নয়, এটা কীভাবে টেকসই করা যায় সেদিকে, অর্থাৎ শান্তি নির্মাণের দিকেও নজর দেওয়া হয়। সংঘাত-উত্তর কোনো অঞ্চল থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনী চলে যাওয়ার পর সেখানে যেন আগের অবস্থা ফিরে না আসে, সেদিকে নজর দেওয়া হয়। অর্থাৎ শান্তি নির্মাণের দিকে জোর দেওয়া চতুর্থ প্রজন্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

চতুর্থ প্রজন্মের ক্ষেত্রে সামরিক কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসামরিক কার্যক্রমের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে এনজিও, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (সিএসও) ইত্যাদির ভূমিকা বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া এ প্রজন্মে নারীদের অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়। এ জন্য নারী সৈনিক, নারী পুলিশ ও অন্যান্য পেশায় নারীদের জোরালো অবস্থান নিশ্চিত করা হয়।

এ প্রজন্মে আঞ্চলিক সৈন্যদের ওপর জোর দেওয়া হয়। অর্থাৎ শান্তিরক্ষা মিশন যে দেশে পরিচালনা করা হয়, সে দেশ যে ভৌগোলিক অঞ্চলে অবস্থিত, সে ভৌগোলিক অঞ্চলের সৈনিকদের শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং তাদের তুলনামূলক অনুপাত যেন বেশি থাকে, সেদিকে নজর দেওয়া হয়। যেমন আফ্রিকার কোনো দেশের শান্তিরক্ষা মিশনে আফ্রিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশ থেকে প্রেরিত শান্তিরক্ষী বাহিনীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। একইভাবে শান্তিরক্ষী বাহিনী নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্থানীয় ভাষায় দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। যেমন যে দেশে ফরাসি ভাষা প্রচলিত, সে দেশের মিশনগুলোতে শান্তিরক্ষী বাহিনী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইংরেজি জানা সৈন্য নন, বরং ফরাসি জানেন, এমন সেনাদের প্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচন করা হবে।

যেহেতু চতুর্থ প্রজন্মের মিশনগুলোতে সর্বশেষ প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়া হবে, তাই শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ধরনে আমূল পরিবর্তন ঘটবে। লজিস্টিকস ব্যবহারের প্রচলিত পদ্ধতিগুলো অচল হয়ে যাবে এবং প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক যন্ত্রপাতি জায়গা করে নেবে। তা ছাড়া প্রযুক্তিনির্ভরতার কারণে আগের তুলনায় সৈন্যের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। মিশনের সংখ্যা ও সংঘাতের তীব্রতা হয়তো বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু শান্তিরক্ষীর সংখ্যা হ্রাস পাবে। সার্বিকভাবে বলা যায়, বর্তমানে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমগুলো ‘স্মার্ট অপারেশন’ বা ‘স্মার্ট শান্তিরক্ষা মিশন’-এর দিকে এগোচ্ছে, যা একধরনের নতুন ‘হাইব্রিড অপারেশন’-এর জন্ম দিচ্ছে।

শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে হলে আমাদের এখনই ভালোভাবে বিশ্লেষণ ও আত্মপর্যালোচনা করতে হবে। চতুর্থ প্রজন্মেও শান্তিরক্ষা মিশনের বৈশিষ্ট্যগুলো অনুধাবন করে আমাদের দুর্বলতাগুলো শনাক্ত করে সেগুলো কাটিয়ে নতুন প্রজন্মের শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য সৈন্যদের প্রস্তুত করতে হবে। সৈন্যদের বাস্তব শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে। সর্বশেষ প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সংঘাতকবলিত অঞ্চলের স্থানীয় ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সর্বোপরি বলা যায়, বাংলাদেশের সৈন্যদের ‘হাইব্রিড অপারেশন’-এর সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। তাহলেই বর্তমানে বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ যে অসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে, সেই বিশেষ স্থান ধরে রাখা সম্ভব হবে।

Advertisement