চীনের রাবিয়া কাদির

আলতাফ পারভেজ :: চীন বিষয়ে সংবাদ মানেই ‘সফলতা’র খবর। সাগরে ৩৪ মাইল লম্বা ব্রিজ, অতিকায় যাত্রী পরিবহন বিমান তৈরি, চাঁদের অপর পিঠে অবতরণ ইত্যাদি। রাবিয়া কাদিরের ‘গল্প’ এ তালিকায় বেমানান। ১৪১ কোটি জনসংখ্যার চীনে রাবিয়া মাত্র সোয়া কোটি উইঘুরের প্রতিনিধি। চীনে তো নয়ই, চীনের বন্ধুদেশগুলোর প্রচারমাধ্যমও তাঁর সংবাদ এড়িয়ে চলে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। রাবিয়া থাকেনও চীন ছেড়ে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে। তারপরও তিনি চীনের এক প্রবল প্রতীকী প্রতিদ্বন্দ্বী। দেশটির অবিশ্বাস্য সফলতার দীপ্তি রাবিয়া কাদিররা অনেকাংশে ম্লান করে দেন।

অনন্য সমাজবিজ্ঞানী মার্ক্স ধর্মকে বলেছিলেন ‘নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস—হৃদয়হীন বিশ্বের হৃদয়’। তবে অজ্ঞাত কারণে আধুনিক ‘সমাজতন্ত্রী’রা ধর্মপ্রশ্ন মোকাবিলায় খেই হারিয়ে ফেলেন। চীন তা পুনঃপ্রমাণ করছে। চীন কতটা সমাজতন্ত্রী, তা নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস আছে। কিন্তু দেশটিতে ধর্মীয় স্বাধীনতার সংকট নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য খবর মিলছে। রাবিয়া কাদির ও উইঘুর সমাজ তার বড় দৃষ্টান্ত।

নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে চীন জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তারা ‘ইসলামের চীনাকরণ’ (চিনিসাইজ অব ইসলাম) সম্পন্ন করতে পারবে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে মুসলমানপ্রধান জিনজিয়াংয়ে মসজিদ থেকে রেস্টুরেন্ট—সর্বত্র নজরদারি বাড়াতে হচ্ছে। ২০১৭ সালে এই এলাকার ‘নিরাপত্তা’য় খরচ হয় প্রায় ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, যা সেখানে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের দ্বিগুণ। পরের বছরও এই ধারা বজায় ছিল।

বিশ্বে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অন্যতম বধ্যভূমি আজকের জিনজিয়াং। তবে চীন বলছে, তারা সেখানে লড়ছে ‘উগ্রবাদ’ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’-এর বিরুদ্ধে। পূর্ব তুর্কিস্তানজুড়ে সন্ত্রাসী আক্রমণগুলো চীনের বক্তব্যকে সমর্থন করে। তবে সেটা এ সত্যও বলে, অহিংস পথে হয়তো উইঘুরদের কথা বলার সুযোগ নেই আর। জিনজিয়াংজুড়ে নিরাপত্তা কড়াকড়ি ছাড়াও চীনের হ্যাকাররা উইঘুরদের অনলাইন কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে। রাবিয়া কাদিরকে নিয়ে তৈরি ৫৪ মিনিটের ‘টেন কন্ডিশন অব লাভ’ তথ্যচিত্রটি প্রদর্শন করতে গিয়েও বিশ্বের অনেক চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ বাধার মুখে পড়েছে। রাবিয়া নিজেও এখন অনেক দেশে ভিসা পান না। শক্তিশালী চীনের সঙ্গে কোনো দেশ আর সম্পর্ক খারাপ করতে চাইছে না!

খনিজ সম্পদ যখন অভিশাপ

জিনজিয়াং শব্দের অর্থ ‘নতুন এলাকা’। এই অর্থে দখলের ইঙ্গিত মেলে। তবে উইঘুররা জিনজিয়াংকে ‘পূর্ব তুর্কিস্তান’ বলে। চীনের সবচেয়ে বড় বিভাগ এটা। বাংলাদেশের ১২ গুণ বড়। এখানে মূল বাসিন্দা মুসলমান উইঘুররা—ভাষায় তুর্কি। সংস্কৃতিতে মিল মধ্য এশিয়ার সঙ্গে। এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে চীনা সরকারের বনিবনা হচ্ছে না বহুকাল। উইঘুরদের প্রতি নজরদারিতে বাড়ি বাড়ি প্রশাসনিক পরিদর্শন কায়েম করেছে চীন। এই কর্মসূচির দাপ্তরিক নাম অবশ্য ‘হানদের সঙ্গে উইঘুরদের পুনর্মিলন উদ্যোগ’!

জিনজিয়াংয়ে ২ কোটি ২০ লাখের মতো জনসংখ্যা। তার মধ্যে উইঘুররা অর্ধেক। প্রচারমাধ্যম বলছে, এদের প্রায় ১০ লাখই আছে ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ হিসেবে ডিটেনশন সেন্টারে। অনেককে পাঠানো হচ্ছে ‘পুনঃ শিক্ষাকেন্দ্রে’—রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সংশোধন করতে। বিশেষ করে ‘কমিউনিস্ট পার্টি’র প্রতি ভালোবাসা শেখাতে। জাতিসংঘের ‘বৈষম্যবিরোধী’ একটি কমিটির সহসভাপতি গে ম্যাকডোগাল জেনেভায় গত বছরের আগস্টে এসব তথ্য জানান তাঁদের ‘নির্ভরযোগ্য’ প্রতিবেদন সূত্রে। পীড়নের মুখে প্রচুর উইঘুর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এখন প্রবাসী। স্বদেশে ফিরলে এঁদের অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে আটক হচ্ছেন। এ রকম অভিযোগ শত শত। চীন অনেক বন্ধুদেশকে চাপে রেখেছে উইঘুরদের ফেরত পাঠাতে।

জিনজিয়াংয়ের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতবদল হয়েছে বহুবার। ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে দুই দফায় অঞ্চলটি স্বাধীন ছিল। রুশ সমাজতন্ত্রী স্তালিন সে সময় উইঘুরদের সহায়তা দিতেন। তবে ১৯৪৯ সাল থেকে চীনের কঠোর নিয়ন্ত্রণের রয়েছে পূর্ব তুর্কিস্তান। এলাকায় হানদের সংখ্যা বাড়ছে তখন থেকে। উইঘুরদের দাবি, ১৯৪৯ সালের আগে জিনজিয়াংয়ে চীনের ‘হান’রা ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ৪০ শতাংশ। এলাকাটি মধ্য এশিয়ায় চীনের প্রবেশদ্বার। ‘সিল্ক রুট’-এর একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। চীনের কয়লার ৪০ ভাগ, তরল জ্বালানির ২২ ভাগ এবং গ্যাসের ২৮ ভাগ রয়েছে এখানকার মাটির নিচে।

খনিজ সম্পদে ন্যায্য হিস্যার ঘাটতিও অসন্তোষের এক উপাদান। তবে চীন উইঘুরদের অর্থনৈতিক বৈষম্য কিংবা ধর্মীয় ও জাতিগত বিচ্ছিন্নতাকে ‘জঙ্গিবাদ’ হিসেবে দেখাতেই আগ্রহী। অনেক ভূরাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেন, পূর্ব তুর্কিস্তানের খনিজ সম্পদই তার জন্য অভিশাপ। হয়তো এ কারণেই তারা গণতন্ত্র উপভোগ করতে পারবে না—হানদের ‘উন্নয়ন’ কর্মসূচিই তাদের নিয়তি।

‘উন্নতি’র বিনিময়ে ‘স্বাধীনতা’ খর্ব

চীনের বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র উইঘুরদের প্রতি সহানুভূতিশীল। সেটা যতটা চীনকে বিব্রত করতে, ততটা নয় উইঘুরদের স্বার্থে। প্রচুর উইঘুর রাজনৈতিক কর্মী যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয়ে আছেন। ১১ সন্তানের জননী রাবিয়া কাদিরও তাঁদের একজন। ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশে কারাভোগ শেষে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন তিনি। ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ব উইঘুর কাউন্সিলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অনেকে তাঁকে মুসলমানদের ‘দালাই লামা’ বলেন। তবে তিব্বতের দালাই লামার মতো রাবিয়াকে নিয়ে পশ্চিমে উচ্ছ্বাস নেই। ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘তিব্বত স্টাডিজ’ নিয়ে যতটা আগ্রহী, উইঘুররা তার ছিটেফোঁটা মনোযোগও পায় না। এর কারণ অস্পষ্ট নয়। রাবিয়ারা মুসলমান। আবার চীনের প্রভাবে মুসলিম ‘উম্মাহ’ও উইঘুরদের সমর্থনে সোচ্চার নয় কখনো।

উইঘুরদের নিজেদের মধ্যেও প্রতিবাদের আদর্শিক ধরন নিয়ে বিবাদ আছে। কেউ তুর্কি জাতীয়তাবাদী, কেউ উইঘুর জাতীয়তাবাদী, কেউবা চাইছেন ধর্ম-ভাষা-ভৌগোলিক স্বাতন্ত্র্যের মিশেল ঘটিয়ে নতুন রাজনীতি দাঁড় করাতে। সব ধারাই চীনা শাসনকে প্রতিপক্ষ ভাবে।

উইঘুরদের নির্যাতনের খবরকে চীন বরাবর ‘গুজব’ বলে মনে করে। রাবিয়া কাদিরও দেশটির কাছে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী মাত্র। তিনি কারাগারের বাইরে থাকতে পারলেও জিনজিয়াংয়ে এ মুহূর্তে আটক আছেন তাঁর দুই সন্তান, চার নাতিসহ প্রায় ৩০ নিকটাত্মীয়। এসবের বার্তাটি স্পষ্ট। চীনের মুসলমানদের বিদ্যমান ‘চীনা ধাঁচের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা’র সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। এর জন্য ধর্মীয় সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ হতে হবে।

পাশাপাশি বেইজিং ধর্মীয় স্বাধীনতার বিপরীতে জোর দিচ্ছে জিনজিয়াংয়ের অর্থনৈতিক ‘উন্নতি’র ওপর। চীনের এই নীতি সুপরিচিত। কেবল দেশে নয়, বিশ্বের অন্যত্রও বন্ধু সরকারগুলোকে একই মডেলে উৎসাহ জোগায় তারা। কোনো দেশে শাসকেরা অবকাঠামোগত উন্নতির বিনিময়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতাকে খর্ব করতে চাইলে, চীনের তাতে আপত্তি তোলে না।

চীনের উইঘুরনীতি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে পার্টি নেতা শেন কোয়াংওকে তিব্বত থেকে জিনজিয়াং বদলিতে। জিনজিয়াংয়ের বর্তমান পার্টি সেক্রেটারি শেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন তিব্বতে একই পদে। তিব্বতে তাঁর সৃষ্ট ত্রিমাত্রিক এক নিরাপত্তাব্যবস্থায় স্থানীয় অসন্তোষ কমানো গেছে। চীনে বর্তমানে সবচেয়ে প্রভাবশালী ২৫ জন পার্টি কর্মকর্তার একজন শেন। ২০২৩ সালে পার্টির সর্বোচ্চ পরিষদ সাত সদস্যের ‘স্ট্যান্ডিং কমিটি’তে জায়গা করে নিতে পারবেন বলেও মনে করা হয়। তার আগে উইঘুরদের পুরোপুরি ‘শান্ত’ হতে হবে!

শান্ত জিনজিয়াং চীনের বিদেশনীতিরও এক চুম্বক লক্ষ্য। উইঘুরদের আশপাশের দেশের সহানুভূতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে সচেষ্ট চীন। তুরস্ক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, কাজাখস্তানসহ পার্শ্ববর্তী সব দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ এক দিক উইঘুর প্রসঙ্গ। তালেবানদের সঙ্গে চীনের উদীয়মান বন্ধুত্বও এই কূটনীতির অংশ।

এ রকম বহুমুখী প্রতিকূলতায় উইঘুরদের সামনে ভবিষ্যতের কোনো স্পষ্ট ছবি নেই। তাদের চাওয়া-পাওয়ার ইতিবাচক পরিণতি জড়িয়ে আছে চীনের মূল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বাধীনতার ভবিষ্যতের সঙ্গে। ৭২ বয়সী রাবিয়া কাদির কি তা দেখে যেতে পারবেন? এর উত্তর তাঁর জানা নেই। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দমবন্ধ জনপদের মতোই তাঁরও ভরসা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর।

Advertisement