ছাত্র আন্দোলন আমাদের দরকার প্রাত্যহিক ন্যায়বিচার

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ১৯৫৩ সালের জুন মাসে সাবেক পূর্ব জার্মানিতে মজুরি কমানোর বিরুদ্ধে শ্রমিকবিক্ষোভ হয়েছিল। একই সঙ্গে রাজবন্দীদের মুক্তি এবং সরকারের পদত্যাগের দাবি উঠেছিল। শ্রমিকদের বিক্ষোভের যেমন ন্যায্য কারণ ছিল, তেমনি ছিল পশ্চিমের ভোগবাদী জীবনের হাতছানি। সরকারের সঙ্গে জনগণের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল। শাসকেরা বোঝেননি যে ডিক্রি জারি করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

জনতা আর পুলিশ হলো মুখোমুখি। পুলিশের সাহায্যে এগিয়ে এল সাঁজোয়া বাহিনী। পরিবহনশ্রমিকেরা ধর্মঘট করায় ট্রাম-ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা পাথর ছুড়ল, সেনাবাহিনী চালাল মেশিনগান। ঝরে গেল ১৬টি প্রাণ। সরকার যথারীতি দাবি করল, পশ্চিমারা উসকানি দিচ্ছে। খ্যাতিমান নাট্যকার বার্টল্ট ব্রেশ্‌ট (১৮৯৮-১৯৫৬) পার্টির নেতা উলব্রিখটকে চিঠি লিখে জার্মান সমাজতান্ত্রিক ঐক্যের পার্টির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য জানিয়ে বলেন, ‘উসকানিদাতাদের বিচ্ছিন্ন করা হোক; কিন্তু শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি যেন মেনে নেওয়া হয়।’ ব্রেশ্‌ট পত্রিকায় লিখলেন, ‘সংগঠিত ফ্যাসিবাদী শক্তি জনগণের অসন্তোষকে ব্যবহার করছে নিজেদের মতলব হাসিলের জন্য। কয়েক ঘণ্টা মনে হচ্ছিল, বার্লিনে বুঝি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবে। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর দ্রুত ও সময়োচিত হস্তক্ষেপে এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা সম্ভব হয়েছিল। সোভিয়েত সেনার কাজ শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে নয়, তাদের যারা খেপিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে।’

পত্রিকায় যখন ব্রেশ্‌ট এসব লিখছেন, তখন তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখছেন অন্য কথা। ডায়েরিতে লিখলেন:Eprothomalo

‘ন্যায্যতা হলো জনতার খাবার,

কখনো এর জোগান প্রচুর, কখনো মঙ্গা।

কখনো এটা স্বাদু, কখনো তেতো।

খাবারের অভাব হলে চারদিকে ক্ষুধা।

খাবার খারাপ হলে শুধুই ক্ষোভ।

প্রতিদিন যেমন খাদ্য দরকার

তেমনি দরকার প্রাত্যহিক ন্যায়বিচার।

এমনকি এটা দিনে কয়েকবার দরকার।’

কমিউনিস্ট শাসনামলে উন্নয়নের পারদ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু মানুষের আত্মা ছিল ক্ষুধার্ত। উন্নয়নের ডামাডোলে মানুষের মনের আহাজারি রড-বালু-সিমেন্ট-পাথরের নিচে চাপা পড়ে যায়। একসময় তার বিস্ফোরণ ঘটে। এমনি এক বিস্ফোরণে বার্লিনের অলঙ্ঘনীয় দেয়াল ধসে পড়েছিল।

বাংলাদেশের গত এক সপ্তাহের ঘটনাগুলোর সংবাদ দেখে ও পড়ে ব্রেশ্‌টের কথা মনে পড়ল। ওই সময় ইন্টারনেট ও ফেসবুক ছিল না। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তেই সবকিছু জানাজানি হয়ে যায়। মানুষ নিজের বোধশক্তি দিয়ে বিবেচনা করে, কোনটা সত্য, কোনটা রাবিশ। কে উসকানিদাতা, কে স্টুপিড।

নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে দেশ উত্তপ্ত হলো। এটা যে একটি যৌক্তিক দাবি, এ নিয়ে ফুটপাতের হকার থেকে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই একমত। কোথায় থামতে হবে, কখন থামতে হবে এবং কীভাবে থামাতে হবে—এ নিয়ে আছে ভিন্নমত।

ঢাকার মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বলেছেন, ছাত্ররা পুলিশের নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে। এটা লাখ কথার এক কথা। আমি মনে করি, সাম্প্রতিক ‘ছাত্র আন্দোলনের’ এটাই প্রধান অর্জন। কিন্তু তার পরক্ষণেই পুলিশ আর সাদাপোশাকের হেলমেটধারীদের যৌথ আক্রমণে এবং বেধড়ক পিটুনিতে পরিস্থিতি মোড় নিল অন্যদিকে।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলছেন, আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে গেছে। সাধারণ মানুষ অনেক সময় পুলিশের তথ্য বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোট বিশ্বাস করে না। এই অবিশ্বাস কোনো নতুন প্রবণতা নয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে জারি হওয়া তাবৎ প্রেসনোটের ভাষা এক, ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিবৃত্ত করতে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ প্রথমে মৃদু লাঠিচার্জ ও পরে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।’ প্রেসনোটের ভাষা একটু এদিক-সেদিক করে দিলে যে বিশ্বাসযোগ্যতা কিঞ্চিৎ বাড়ে, এই বোধটুকুও এসব স্ক্রিপ্ট রাইটারের নেই।

বেশ কিছুদিন ধরে সরকার একটু বেকায়দায় ছিল। একের পর এক লোমহর্ষক সব সংবাদ ছাপা হচ্ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা চুরি তো এখন মধ্যযুগের ব্যাপার। এরপর একে একে ফাঁস হলো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার নামে টাকা লোপাট, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে সোনা গায়েব, বড়পুকুরিয়ার কয়লা উবে যাওয়া এবং লাখ লাখ টন পাথরের নিখোঁজ সংবাদ। কিন্তু নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের ভিড়ে সব চাপা পড়ে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যে হয়তো নতুন ইস্যু পয়দা হবে, তখন এটিও হারিয়ে যাবে।

আমার এত দিন ধারণা ছিল, দেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকেরা সরকার চালান। তা না হলে কীভাবে তাঁরা একের পর এক ইস্যু আড়ালে নিয়ে যান। নতুন ইস্যু নিয়ে আসেন সামনে। এটাও একসময় চাপা পড়ে যাবে। নতুন আইন হচ্ছে, এই আইনে সবই হবে, শুধু সমস্যার মূলে যাওয়া হবে না। অর্থাৎ আমজনতার জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী গণপরিবহনব্যবস্থা দৃশ্যমান হবে না। কয়েক বছর ধরে আমি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ইকবাল হাবিব ও প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের কথা শুনে আসছি গণমাধ্যমে। তাঁদের প্রস্তাবগুলো একেবারেই চাঁছাছোলা—সুনির্দিষ্ট। সোজা কথা হলো, জনবান্ধব ফুটপাত, বাসের জন্য আলাদা লেন এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট কোম্পানির মাধ্যমে বাসগুলো চালানো। আমি হলে আরও এগিয়ে গিয়ে বলতাম, বিআরটিসিকে পুনর্জন্ম দিন, পরিবহন মাফিয়াকে রাস্তা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করুন। এখন তো শুধু কথা চালাচালি হবে—শাস্তি পাঁচ বছর না সাত বছর, জরিমানা ৫০০ টাকা না ৫০ হাজার টাকা।

এ ধরনের সংকটে সরকার নাগরিক সমাজের সঙ্গে একটা সংলাপে বসতে পারত। কিন্তু সরকার ওই পথে হাঁটেনি। শুরু থেকেই দেখেছি ‘ব্লেম গেম’ বা দোষারোপের রাজনীতি। সবাই এ নিয়ে রাজনীতি করছেন। এর মধ্যে সরকারের নানা সংস্থাও ঢুকে গেছে। তারা টেলিফোনে আড়ি পাতছে। তারপর তা উদার হাতে পছন্দের টিভি চ্যানেলে দিচ্ছে। কে যে কখন ধরা খায়, বলা মুশকিল।

ষাটের দশকে শুনেছি এবং দেখেছি, কীভাবে সরকার মাস্তানতন্ত্র চালু করেছিল। গভর্নর মোনায়েম খানের পেটোয়া বাহিনী ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওরা অনেকেই পকেটে চাকু রাখত। মারামারির সময় হকিস্টিক ব্যবহার করত। কিন্তু পুলিশি পাহারায় তারা কখনো প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করেছে বলে শুনিনি। ওই চক্রের মাস্তানেরা অবশ্য কেউ পার পায়নি। এদের এক নেতা সাইদুর রহমান ওরফে পাঁচপাত্তু এস এম হলে নিহত হয়েছিলেন। আরেক মাস্তান সর্দার খোকার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেল রমনায়। অনেকেই বিদেশে পালিয়ে বেঁচেছিল।

এখন দেখি লুঙ্গি পরে, লাঠি, বাঁশ আর রামদা হাতে লোকজন পথে নেমে পড়েছে। এরা কারা? সেদিন জিগাতলার কাছে এক সাংবাদিককে অমানুষিকভাবে পেটানো হলো। এই দৃশ্য আমাদের কয়েক বছর আগে বিশ্বজিৎকে আক্রমণের ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দেয়। এদের কাজকারবার দেখলে মরহুম মোনায়েম খানও লজ্জা পেতেন।

গত কয়েক দিন বাতাসে নানা গুজব ছড়িয়েছে। গুজব তখনই তৈরি হয় এবং ডালপালা মেলে, যখন প্রথাসিদ্ধ গণমাধ্যমে সংবাদ লুকানো হয়। সরকারি টেলিভিশন সম্পর্কে অনেক আগে একটি মন্তব্য শুনেছিলাম—সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স। এখন তার আসর পড়েছে বেসরকারি মাধ্যমেও। একদিকে চলছে সত্য গুমের চেষ্টা, অন্যদিকে দেখছি সেলফ-সেন্সরশিপ। এই অবস্থা কদিন চলবে, কে জানে।

শিশু-কিশোরেরা রাজপথে একটি স্লোগান শিখিয়ে দিয়েছে, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। এই স্লোগান টিকে যাবে। এখানে ব্রেশ্‌ট আবারও প্রাসঙ্গিক—আমাদের দরকার প্রাত্যহিক ন্যায়বিচার।

Advertisement