জনগণ ভোট দিতে পারবে তো?

সোহরাব হাসান:: জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক উৎসবের আমেজ ছিল, এটি আনন্দের দিক। আবার কোথাও কোথাও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটেছে। তারপরও কোনো রকম অঘটন ছাড়া নির্বাচনের এই পর্ব শেষ হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা স্বস্তিবোধ করতে পারেন। অতীতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া নিয়ে অনেক মারামারি–হানাহানির ঘটনা ঘটেছে বলেই আচরণবিধিতে শোডাউন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ৩০০ আসনে সংসদ সদস্য পদে ৩ হাজার ৫৬ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ২৮১ জন ২৬৪টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, বিএনপির ৬৯৬ জন ২৯৫টি আসনে ও জাতীয় পার্টির ২৩৩ জন ২০১টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। অন্যান্য দল থেকেও বহুসংখ্যক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

মনোনয়ন নিয়ে সব দলে কমবেশি গোলমাল থাকলেও জাতীয় পার্টির মতো এতটা বিশৃঙ্খল অবস্থা অন্য কোনো দলে হয়নি। জাতীয় পার্টির অনেক নেতা মনোনয়ন না পেয়ে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছেন, নেতৃত্বের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে মনোনয়ন না দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন, নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। একটি রাজনৈতিক দলের ন্যূনতম নীতি, আদর্শ ও নৈতিকতাবোধ থাকলে মনোনয়ন নিয়ে এ রকম হযবরল অবস্থা হতে পারে না। দলের প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এটি তাঁর পুরোনো কৌশল। আর দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার কিছু বলছেন না। তৃণমূলে যাঁরা জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁদের একাংশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

শুরু থেকেই রাজনৈতিক মহলে যে প্রশ্নটি ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়েছে তা হলো, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না, নির্বাচনের আগে তিনি জামিন পাবেন কি না। বিএনপির নেতারা বলছেন, তিনি প্রার্থী হতে পারবেন। তাঁর পক্ষে তিনটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়াও হয়েছে। গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রায় দিয়েছেন যে দুই বছরের বেশি দণ্ডিত হলে কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না, যদি না আপিল বিভাগ সেই দণ্ড স্থগিত করেন। বিএনপির ছয়জন দণ্ডিত নেতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা এই রায় দেন। এই রায় অনুযায়ী, খালেদা জিয়াসহ অনেক নেতাই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ যশোর-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবিরা সুলতানার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রায় দেন, উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ড স্থগিত থাকবে। হাইকোর্টের এক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, দণ্ডিত ব্যক্তিরা নির্বাচন করতে পারবেন না। অন্য রায় বলছে, পারবেন।

তাহলে শেষ পর্যন্ত কোনটি টিকবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। সরকারপক্ষ দ্বিতীয় রায় অর্থাৎ দণ্ড স্থগিত করার রায় স্থগিত চেয়ে আপিল করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রার্থিতা নিয়ে আইনি জটিলতার চেয়েও রাজনৈতিক জটিলতা আরও প্রকট। কোথাও দলের ভেতরে, কোথাও জোটের ভেতরে। আইনি জটিলতা কাটলেও রাজনৈতিক জটিলতা যে বাড়বে, তার আলামত এখনই পাওয়া যাচ্ছে। অনেক আসনেই মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে, দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে, আবার কারও কারও প্রতি স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একাংশ অনাস্থাও প্রকাশ করেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব মনে করেছিলেন, ‘খামোশ’ বললেই সবাই চুপ হয়ে যাবেন। কিন্তু অনেকেই চুপ হননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তৃণমূলের মতামত বাধ্যতামূলক ছিল। পরে সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন তৃণমূলের মতামতের কোনো দাম নেই। শীর্ষ নেতৃত্ব যাঁকে পছন্দ করেন, তিনিই মনোনয়ন পেয়ে যান। তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে কি না, সেটি দেখা হয় না। এ কারণে এক দল থেকে আরেক দলে যোগ দিয়েই প্রার্থী হয়ে যান। নেতারাও তাঁদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেন। এই ধারা চলছে ১৯৯১ সাল থেকেই।

বুধবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন অনেক আসনে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হলেও যে বিষয়টি আমাদের ভালো লেগেছে তা হলো, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে কোলাকুলি, শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময়ের ঘটনা। কোনো কোনো আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে আলিঙ্গনবদ্ধ ছবিও আমরা দেখেছি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় গিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন সিলেট-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ চৌধুরী। বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ১০টায় নগরের ধোপাদীঘিরপাড়ে হাফিজ কমপ্লেক্সে অর্থমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন তিনি। এ সময় এক টেবিলে বসে নাশতা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সিলেট–১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও অর্থমন্ত্রীর ছোট ভাই এ কে আবদুল মোমেন ও বিএনপির প্রার্থী ইনাম আহমদ চৌধুরী। ইনাম আহমদ চৌধুরী বলেছেন, পারিবারিক সম্পর্কের কারণে তিনি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

রাজনীতি তো এমনই হওয়া উচিত। বিভিন্ন দলের মধ্যে মত ও পথের ভিন্নতা থাকবে, কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করতে হবে কেন? যত সমস্যা ঢাকায়। এক দলের নেতা অন্য দলের নেতার মুখ দেখেন না। পেশাগত কাজে মাঝেমধ্যে ঢাকার বাইরে গেলে দেখি সেখানে সব দলের নেতাদের মধ্যে সদ্ভাব আছে। বিপদে–আপদেও একে অপরের পাশে দাঁড়ান।

এটা হলো মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠ হলো তফসিল ঘোষণার পরও কোনো কোনো স্থানে বিরোধী দলের নেতাদের বাড়িতে গিয়ে প্রতিপক্ষ হুমকি দিয়ে আসে। প্রতিপক্ষকে এলাকায় গেলে কবরে পাঠানোর হুমকিও দেওয়া হয়। এগুলো পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। তারপরও নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা দেখতে পায় না। তারা ভাবে, উট পাখির মতো বালুতে মাথা গুঁজে থাকলেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। কিন্তু অন্ধ হলেও যে প্রলয় বন্ধ হয় না, সেই কথাটি নির্বাচন কমিশনকে কে বোঝাবে?

নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দুই ধরনের অভিজ্ঞতা আছে—আনন্দের ও বিষাদের। যে নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়, মাঠ সমতল থাকে; সে নির্বাচন বরাবর উৎসব-আনন্দের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। আর যে নির্বাচন হয় একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, সেই নির্বাচনে ভোটাররা থাকেন অনাগ্রহী ও নিস্পৃহ। সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কত লোক মারা গেছে, তার একটি হিসাব নিলেই সংঘাতের মাত্রাটা বোঝা যাবে।

এই প্রেক্ষাপটে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? ঘরে-বাইরে পথেঘাটে, শহরে-গঞ্জে মানুষের মনে একটাই দুশ্চিন্তা—ভোটটি সুষ্ঠু হবে তো? নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, এবার ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে সোয়া ২ কোটির বেশি তরুণ ভোটার। ২০১৪ সালের পর ভোটার হয়েছেন ১ কোটি ২২ লাখের বেশি তরুণ। ২০০৮ সালের পর যাঁরা ভোটার হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগ এই প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। ২০১৪ সালে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হওয়ায় এই বিপুলসংখ্যক ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এবার ৩০০ আসনেই নির্বাচন হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দল এই নির্বাচনে অংশও নিচ্ছে।

তারপরও মানুষের শঙ্কা কাটছে না। নির্বাচন কেমন হবে—এই প্রশ্নের জবাবে তাঁরা সিইসি কে এম নুরুল হুদার মতো বলতে পারছেন না, নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। তাঁদের মনে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘ভোট দিতে পারব তো?’

Advertisement