জাতীয় নির্বাচন গণমাধ্যমেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দরকার

মো. গোলাম রহমান :: জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে নানা ইস্যুতে তর্ক-বিতর্ক চলছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সাংবাদিকদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের আচরণ ও তাঁর গাড়িবহরে হামলা নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় নিয়ে দুটি লেখা লিখেছেন সাংবাদিকতার শিক্ষক ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ড. মো. গোলাম রহমান ও সাংবাদিক কামাল আহমেদ।

নির্বাচন নিয়ে মানুষের আবেগ থাকে। নানা ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকে। এটি গণতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কতকগুলো প্রতিষ্ঠান আছে। তার মধ্যে আছে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করে। তাদের কার্যক্রমের প্রতিফলন ঘটায় গণমাধ্যম।

আমরা সম্প্রতি লক্ষ করলাম, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গেলেন। সেখানে জামায়াত ইস্যুতে তাঁকে কিছু প্রশ্ন করা হলো। কিন্তু তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিছু মন্তব্য করলেন। বিরূপ উক্তি করলেন। এটি সাংবাদিকমহল ভালোভাবে নেয়নি। যে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি, তাদের সঙ্গে তিনি একজোট হয়ে থাকলে সাংবাদিকেরা তাঁকে সেটি নিয়ে প্রশ্ন করতেই পারেন। এটা অপ্রাসঙ্গিক নয়। তাঁদের প্রশ্ন যুক্তিসংগত। তিনি চাইলে সে প্রশ্নের জবাব না–ও দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে সাংবাদিকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করলেন। এ নিয়ে সাংবাদিকদের ক্ষুব্ধ হওয়া বা প্রতিবাদ জানানো অস্বাভাবিক নয়। ড. কামাল হোসেন অবশ্য পরে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি দুঃখপ্রকাশ করলেও জাতির কাছে ক্ষমা চাননি।

এখন এই বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকাও খতিয়ে দেখা দরকার। বিশেষ করে প্রথম আলোর কথাই বলব। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে। কিন্তু আমরা দেখলাম প্রথম আলো ড. কামাল হোসেনের এই আচরণের খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপেনি। তারা গুরুত্ব দিয়েছে কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলার খবরের প্রতি। ড. কামালের অশোভন মন্তব্যকে ছোট করে দেখে তাঁর গাড়িবহরে হামলার ঘটনাকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমার মনে হয় এখানে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসৃত হয়নি। প্রথম আলোর মতো একটি দায়িত্বশীল পত্রিকার কাছে আমরা এটা আশা করি না।

মূলত যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি, সেই চেতনাকে যারা লাঞ্ছিত করছে, ঘটনাক্রমে সেই অপশক্তির সঙ্গে এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হাত মিলিয়েছে। আর তাকে যেসব সংবাদমাধ্যম সমর্থন দিয়েছে, তাদের মধ্যেও বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য কাজ করে থাকতে পারে। আমরা জানি, প্রথম আলোর পাঠক বেশি, গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এ কারণে প্রথম আলোর কাছে আমাদের প্রত্যাশাও বেশি। প্রথম আলো বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। স্বাধীনতার কথা বলে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে স্ববিরোধিতাও আমরা খেয়াল করি।

যে দল মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছে এবং আদালতে একটি স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে; একই সঙ্গে যাদের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে, সেই জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে যাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, আমাদের তাঁদের বিরোধিতা করে যেতেই হবে। নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠভাবে সংবাদ পরিবেশনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ তার সামনে থাকে। নির্বাচন চলাকালে এবং নির্বাচনোত্তর সময়ে প্রতিটি স্তরেই সাংবাদিকদের অনেক দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হয়। সবার খবর তাদের পরিবেশন করতে হয়।

কিন্তু প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারকে আমরা সব সময় সরকারবিরোধী খবর পরিবেশন করতে দেখি। আমি বলছি না, তাদের কোনো খবর সত্য নয়। কিন্তু আমি বলব, তাদের মূল স্পিরিটটা যেন সরকারের বিরোধিতা করাই। আওয়ামী লীগ সরকার টানা দশ বছর ক্ষমতায়। তাদের ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। সরকারের লোকজন হয়তো কিছু অপকর্ম করে থাকতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দেশের উন্নয়নের জন্য, প্রবৃদ্ধির জন্য, দেশকে সময়োপযোগী করে উপস্থাপন করার জন্য এই সরকার অনেক কাজও করেছে। দায়িত্বশীল সাংবাদিকদের সেই নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি এসব ইতিবাচক খবরও প্রকাশ করা উচিত। তা না করে আওয়ামী লীগের সার্বিক অর্জন ম্লান করে দিতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করতে হবে কি শুধু বিরোধিতা করার জন্য? এই ধ্যানধারণা গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশিত নয়।

যে পত্রিকাটি বিএনপিকে সমর্থন করে প্রকাশিত হয়, তার কাছে আমাদের কোনো প্রত্যাশা নেই। চাওয়া–পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু নিরপেক্ষ দৈনিক হিসেবে প্রথম আলো কিংবা আরও যেসব দৈনিক রয়েছে, তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। অন্য অনেক পত্রিকা ভালোই করছে বলে আমি মনে করি। বিজয় দিবসের পরের দিন প্রথম আলোতে আমরা দেখেছি, বিজয় দিবস নিয়ে তেমন কথা নেই। প্রথম পাতায় তাদের একটা নিউজ হলো, ‘বিশ্ব পাঠে স্থান পাচ্ছে বাংলাদেশ’। এটা সাইড স্টোরি হতে পারে। কিন্তু বিজয়ের যে আনন্দ উৎসব, তার ছবি বা খবর থাকা দরকার ছিল। তার বদলে আছে বিভিন্ন জায়গায় হামলার খবর। শুধু এখানে নয়, পত্রিকাজুড়ে এই ধরনের খবর। কাদের গাড়ি ভাঙা হয়েছে, কারা প্রতিবাদ করেছে—এই সব কথাবার্তা। পুরো পত্রিকা দেখলে উদ্দেশ্যটা বোঝা যায়। সেখানে খবর ছাপা হচ্ছে, কামাল হোসেন বলছেন, ক্ষমতা পনেরো–ষোলো দিন পর তাঁর হাতে এসে যাচ্ছে। সুতরাং পুলিশকে যেন তাঁর আদেশ দিচ্ছেন। কমান্ড করছেন। এই কমান্ড আপত্তিকর। তাঁর হাতে যদি ক্ষমতা চলেই যায় তাহলে আর নির্বাচনের দরকারটা কী? এটা একধরনের সন্ত্রাস। শুধু হাতে মারলেই সন্ত্রাস হয় না। এটাও সন্ত্রাস। এটাকে রাজনৈতিক সন্ত্রাস বলা যায়। বক্তৃতা সন্ত্রাস বলা যায়।

সম্প্রতি দুটো পত্রিকায় ড. কামাল হোসেনের নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার। অন্য কোনো পত্রিকায় তো ওই নিবন্ধ আসেনি? তার মানে কী? তাঁকে গ্লোরিফাই করার একটা চেষ্টা চলছে। এই যে অতিরিক্ত উৎসাহ নিয়ে তাঁকে সামনে আনা হচ্ছে, তাঁকে গ্লোরিফাই করা হচ্ছে, তাতে কি মানুষের মনে প্রশ্ন আসবে না?

বাংলাদেশে একুশ–বাইশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ানো হয়। অন্তত দশ হাজার ছাত্র সাংবাদিকতায় পড়েন। হয়তো আরও বেশি পড়েন।

হাজার হাজার লোক এই খাতে কাজ করে। এখন শুধু গণমাধ্যমের কর্মীরাই না, এখন যঁারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁরা কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে একধরনের তাল মিলিয়ে চলেন। তাঁদের কাছে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক বড় এবং তাঁরা কিন্তু ‘মিডিয়া ইললিটারেট’ না। তাঁরা ‘মিডিয়া লিটারেট’। তাঁরা সবকিছু বলেন না। লেখেন না। কিন্তু সব বোঝেন।

গত ১০ বছরে সরকারের অনেক ব্যর্থতা আছে। কিন্তু অর্জনও তো হয়েছে। কিন্তু আমি দেখলাম, মিডিয়াতে অর্জনগুলোর কথা গত কয়েক বছরে আসেনি। ইদানীং কিছু কিছু আসছে। এটি গণমাধ্যমের একধরনের পরিবর্তন। আমরা জানি গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করে, দোষত্রুটি সামনে আনে। কিন্তু তারও তো একটা মাত্রা থাকে। ভালোকে ভালো, মন্দকে মন্দ বলার ব্যাপার থাকে। যখন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হলো, যে হামলা থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন, সেই হামলায় কারা কারা জড়িত, তা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের সেই দলকেই আবার পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে কেন? ২১ আগস্ট নিয়ে প্রথম আলো ভালো খবর করেছে, তারা জজ মিয়ার কাহিনি প্রকাশ করেছে। আমি তার প্রশংসা করি। কিন্তু প্রথম আলো সেই ভূমিকায় আছে কি না, সেই প্রশ্নও অনেকে করছেন।

যদি আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলি, তাহলে গণমাধ্যমেরও কিন্তু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকার কথা। সেটা কী রকম? সেটা হলো এই বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা কী অপকর্ম করেছিল, সেটাও বলতে হবে। সেগুলো তো যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। তাহলে কি শুধু এই সরকারের কার্যকলাপই সমালোচনা করার যোগ্য? সেটার জবাব দেওয়াও সাংবাদিকদের দায়িত্ব। সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা সংবাদমাধ্যমকে মনে রাখতে হবে।

Advertisement