জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। গঠিত হচ্ছে নতুন নতুন জোট। জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে বিরাট ফারাক। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজের তিন কিস্তির লেখার প্রথম কিস্তি প্রকাশ হলো আজ

বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা সহজেই দৃশ্যমান। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিকট ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা নিয়ে কমবেশি সবাই চিন্তিত। সম্ভাব্য সেসব পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হলে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক এবং শাসন পরিস্থিতি থেকেই আলোচনার শুরু করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে নির্বাচন নিয়ে সংশয় ও সন্দেহের কারণ হচ্ছে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট।

যদিও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সমস্বরে বলছেন যে সংবিধানে বিবৃত ব্যবস্থা অনুযায়ী যথাযথ সময়ে নির্বাচন হবে, তথাপি ইতিমধ্যে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছে, আদৌ নির্বাচন হবে কি না। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারাও এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন হলেও তাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোটের বাইরে আর কারা অংশ নেবেন, তার কোনো ধারণাই কারও কাছে নেই। ১৪-দলীয় জোটের শরিকেরা ছাড়া আর কারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, এ বিষয়টি এই কারণে অস্পষ্ট যে এখন পর্যন্ত কোনো দলের নেতারা বলেননি যেকোনো পরিস্থিতিতে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেনই। সরকারের অংশীদার এবং সংসদে ‘বিরোধী দলের’ দাবিদার জাতীয় পার্টির বক্তব্যের সারাংশ দুর্বোধ্য। তাঁদের নেতারা ‘এই হলে ওই করব, ওই হলে এই করব’ ধরনের কথাবার্তা যতবার বলেছেন, তার কিয়দংশ বারও দ্বিধাহীনভাবে বলেননি যে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেনই। তাঁদের দ্বিধার কারণ হতে পারে যে সিদ্ধান্তের ভার তাঁদের হাতেই নেই অথবা রাজনীতির বাতাস কোন দিকে বইছে, সেই বুঝে পাল তোলার অপেক্ষায় আছেন নেতারা।

কিন্তু এর বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল এবং জোট আছে—বড়, ছোট, মাঝারি; বামপন্থী-মধ্যপন্থী-ইসলামপন্থী নেতারা, তাঁরা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন কী পরিস্থিতিতে তাঁরা নির্বাচনে যাবেন। অর্থাৎ তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে চান। তাঁদের দাবিদাওয়ার স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে দাবি পূরণ না হলে তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না। এসব জোটের মধ্যে আছে নতুন গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ২০-দলীয় জোট। তা ছাড়া দলগতভাবে বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলসহ আরও অনেক দলও একই ধরনের দাবি করেছে। বিভিন্ন জোট ও দলের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যেসব দাবি তোলা হয়েছে, সেগুলোর দফাওয়ারি ভিন্নতা আছে, কিন্তু কিছু বিষয়ে ঐকমত্য সুস্পষ্ট। সেই ঐকমত্যের দাবিগুলো হচ্ছে নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং নির্বাচনের অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করা।

রাজনীতির সংকটটা এখানেই। কেননা, প্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলেছে যে সংবিধানে যেভাবে লেখা আছে, তার বাইরে গিয়ে তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেবেন না এবং তাঁরা প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসবেন না। নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনিশ্চয়তার মূল কারণ হচ্ছে এই রাজনৈতিক প্রশ্নের সমাধান এখনো দৃশ্যমান নয়। কেননা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করে না যে দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট আছে। ক্ষমতাসীনেরা মনে করে যে তাঁদের ‘সাংবিধানিক’ অবস্থান এবং বিরোধী দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে তাঁদের পক্ষে এসব দাবি উপেক্ষা করেই ২০১৪ সালের মতো কিংবা অন্য কোনো আকারে নির্বাচন করা এবং সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে।

কিন্তু ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পরে এবং বিশেষ করে এ বছর অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পরে এটা স্পষ্ট যে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ করাই নির্বাচনের সততা (ইন্টেগ্রিটি) এবং সম্পূর্ণতা নিশ্চিত করে না; নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় না। এসব অভিজ্ঞতা আবারও প্রমাণ করেছে, সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থা ও বিরাজমান শাসন পরিস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন বিষয়ে কথা বলা অর্থহীন। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে অবাধ নির্বাচনের নিশ্চয়তা তৈরি করা। সেটা কেবল কথার কথা হিসেবে নয় বা তার দায়িত্ব কেবল নির্বাচন কমিশনের নয়।

বাংলাদেশের রাজনীতির যেকোনো পর্যবেক্ষকই এটা জানেন যে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সবার অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচনের অনুকূল নয়। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে এই যে ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতারা যখন নির্বাচনী প্রচারাভিযানে দেশের সর্বত্র চষে বেড়াচ্ছেন, সেই সময় সরকারবিরোধীরা কেবল যে সমাবেশের অনুমতিবঞ্চিত হচ্ছেন তা-ই নয়, এমনকি তাঁদের আবেদন বিবেচ্য হচ্ছে এমনও মনে হয় না। বারবার অনুরোধ করেও জাতীয় ঐক্য, যুক্তফ্রন্ট, নাগরিক ঐক্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সমাবেশের অনুমতি পায়নি বলে তাঁরা অভিযোগ করেছেন। সরকারের পছন্দের না হলে সভা-সমাবেশ না করতে দেওয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের কোনো রাখঢাক নেই; যে কারণে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘কোনো দল রাজপথে নেমে মিটিং করবে, মিছিল করবে তার জন্য দেশ স্বাধীন করা হয়নি’ । যার অর্থ হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া আর কারও সভা-সমাবেশ বা প্রতিবাদ জানানোর কোনো অধিকার নেই। বিরোধী দলের সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হোক অথবা না হোক, সমাবেশে অংশগ্রহণকারী, এমনকি অংশগ্রহণেচ্ছু রাজনৈতিক কর্মীদের আটক ও মামলা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেশে ‘উন্নয়ন মেলা’র পাশাপাশি শুরু হয়েছে ‘গায়েবি’ মামলা। এসব মামলার শিকার জীবিত ব্যক্তিরা অন্তত এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে তাঁরা বেঁচে আছেন। কেননা, মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী গত ৯ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৪০৩ জন এবং গুমের শিকার ৫৮ জন।

মতপ্রকাশের ক্ষেত্র কতটা সীমিত হয়েছে, তার উদাহরণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রগ্রাহক শহিদুল আলমের অব্যাহত কারাবাসের মাঝখানেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলামকে আটক করতে এবং তাঁকে রিমান্ডে পাঠাতে সরকারের তৎপরতা ছিল দর্শনীয়। এমন ঘটনার তালিকা বেশ দীর্ঘ। বিভিন্ন কথিত এবং কল্পিত অভিযোগে শিক্ষক থেকে তরুণ শিক্ষার্থী আটক হয়েছেন। আরা যাঁরা এখনো আটক হননি, তাঁদের হয় পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে অথবা আদালতের বারান্দায় বসে থাকতে হচ্ছে জামিনের আশায়। সবচেয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিরও যে জামিন হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ‘গুজবে’র অজুহাত তৈরি করে নিপীড়ন, হেনস্তার এক অভাবনীয় ধারার জন্ম হয়েছে। শুধু তাই নয়, একদিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘গুজব শনাক্তকরণ সেল’ অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে ‘গুজব ঠেকাতে নতুন ইউনিট’ খোলার পরিকল্পনা হয়েছে।

এর মধ্যেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারি হয়েছে, যার আওতায় যে কাউকে কোনো রকম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই আটক করা যাবে, তল্লাশি করা যাবে যেকোনো জায়গা, জব্দ করা যাবে যেকোনো রকমের ডিজিটাল ডিভাইস—সেটা এমনকি সংবাদপত্রের সার্ভার হলেও ব্যতিক্রম হবে না। তাতে করে সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ হবে, কিন্তু সে জন্য সরকারকে এ অপবাদ সইতে হবে না যে তারা গণমাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সবাই অবহিত আছেন, সাংবাদিকতায় যুক্তরা যে এখন একধরনের ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ বা স্বতঃপ্রণোদিত নিয়ন্ত্রণ চর্চা করছেন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ নামের যে খড়্গে মরচে ধরেছিল, তাতে ভালো করেই শাণ দেওয়া হয়েছে। তিনজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী সম্পাদক পরিষদকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মন্ত্রিসভায় এ আইন নিয়ে আলোচনা হবে, কিন্তু তা ঘটেনি। সম্পাদক পরিষদ একে ‘আস্থা ও বিশ্বাসের লঙ্ঘন’ বলেছে। এখন অবস্থা এমন যে মনের ভেতরে কী আছে, সেই বিবেচনায় আইন করা হচ্ছে। অপরাধ সংঘটন নয়, অপরাধের ‘চিন্তা’ই দোষী বলে চিহ্নিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

আরেকটি বিষয় এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে; এই প্রবণতাকে বর্ণনা করার জন্য বিশিষ্ট লেখক ও সামাজিক আন্দোলনের ব্যক্তিত্ব অরুন্ধতী রায়ের ভাষা ধার করতে চাই, ‘সেন্সরশিপ নাউ হ্যাজ বিন আউটসোর্সড টু দ্য মব’ (সেন্সরশিপের কাজ উন্মত্ত জনতার কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে)। ভারতের মতোই বাংলাদেশেও এই ‘উন্মত্ত জনতা’ তাদেরই আক্রমণ করে, যারা ভিন্নমতাবলম্বী। এই উন্মত্ততা কোনো স্বতঃস্ফূর্ত বিষয় নয়, সব সময়েই
দৈহিকভাবে আক্রমণ না করলেও আক্রমণের ব্যাপ্তি বিশাল। রাজনৈতিক প্রণোদনা ছাড়া এগুলো তৈরির উপায় নেই।

এ পরিস্থিতি অবশ্যই গণতান্ত্রিক শাসনের বৈশিষ্ট্য নয়। এ শাসনকে আপাতদৃষ্টে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করা হলেও তা যে বড়জোর দৃশ্যত গণতান্ত্রিক, কিন্তু মর্মবস্তুর দিক থেকে কর্তৃত্ববাদী—তা বোঝা দরকার। এ ধরনের শাসনকে গণতন্ত্র-বিষয়ক গবেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা দো-আঁশলা ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করে থাকেন, যার প্রধান ভিত্তি হচ্ছে বলপ্রয়োগ। এ ব্যবস্থা স্থায়ী রূপ নেওয়ার আগেই দরকার নাগরিকদের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো—মতপ্রকাশ, সমাবেশ, ভোটাধিকার, জীবনের নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হওয়া।

বিরাজমান ব্যবস্থাকে প্রচলিত ধারণা এবং তত্ত্ব দিয়ে বিবেচনা করলে ভুল হবে। বিরোধী দল এবং জোটগুলো এ অবস্থা উপলব্ধি করে এই সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে সম্মিলিত অবস্থান গ্রহণ করতে পারছে কি না, মতপার্থক্যগুলোর চেয়ে অভিন্ন জায়গাগুলো শনাক্ত করতে সক্ষম হচ্ছে কি না এবং আশু সংকট, যার মাত্রা অভূতপূর্ব এবং ক্রমবর্ধমান, তা মোকাবিলার পথ খুঁজে বের করতে পারছে কি না—সেটাই এখন দেখার বিষয়। এ অবস্থার মোকাবিলা করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করা গেলে যারা ‘দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য’ অর্জনে আগ্রহী তাঁরা সেগুলো অর্জন দূরের কথা, সেই বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পাবেন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতির অতীতের বৃত্তচক্রকে যাঁরা অবধারিত বলে ভাবছেন এবং সেই বিবেচনায় তাঁদের অবস্থান তৈরি করছেন—তাঁরা গত এক দশকে, বিশেষত ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পরে, রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন বিবেচনায় নিচ্ছেন বলে মনে হয় না।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর

Advertisement