‘টুটি চেপে ধরা জেবুন্নেছারা’

।। Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA ।।
মার্কিন ইতিহাসে রিচার্ড নিক্সনই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি পদত্যাগ করেছিলেন। এখন থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। মার্কিন জাতির জানা প্রয়োজন ছিল এবং তারা জানতে পেরেছিল যে এ বিষয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন দেশবাসীকে যা বলেছিলেন – তা ছিল মিথ্যে। ঐ ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কথা গণমাধ্যমে ফাঁস করেন কার্ল বার্নষ্টেইন নামের একজন সাংবাদিক। কথাটার অবতারণার উদ্দেশ্য হল সাংবাদিকদের এ ধরনের কাজকে কেউ বলেন, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সাহসী অভিযান’  আর কেউ বলেন, ‘তথ্য চুরি।’ বিষয়টা হল কার মুখ থেকে কথাটা বের হচ্ছে।
যদি ‘তথ্য চুরি’ কথাটিও ব্যবহার করি তাহলেও আমরা জানি সত্য উদঘাটনে একজন সাংবাদিক তথ্য চুরি করতে পারেন যদি না তিনি দেশের বিরুদ্ধে কিছু বলেন। এমন কি বৃহত্তর জনস্বার্থে একজন সাংবাদিক দেশের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছুও লিখতে পারেন। সারা বিশ্বেই জনস্বার্থে সাংবাদিকগণ যুগে যুগে তথ্য চুরি করেছিলেন, করছেন এবং করে যাবেন। নিউজ হেড লাইন হয়ে যাবার ভয় না থাকলে পৃথিবীটা আরো অনেক বেশী অন্যায়ে ঢেকে যেতো।
স্বাস্থ্য বা শিক্ষা এসব বিভাগের দুর্নীতি সমাজে অনেক বেশী স্পিল ওভার এফেক্ট ফেলে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জমে উঠা অনিয়ম দুর্নীতি এখন পাহাড় সম। এই প্যান্ডেমিকে এবং রোজিনা ইসলামের মত সাহসী সাংবাদিকদের কল্যাণে সার্ফেসে উঠে এসেছে সেসব তথ্য। একটি এক্সরে মেশিন, একটি হাই ফ্লো ক্যানুলার দাম বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কত ধার্য্য করা হয় তা শুনলে মেডট্রনিক, জনসন এন্ড জনসন বা এবোটের মত পাশ্চাত্যের বড় বড় কোম্পানিগুলোর সিইও-দের রক্ত চাপ বেড়ে যেতে পারে।
জাতি কোল্যাপ্স করতে পারে – টেবিলের উপর ভাসিয়ে রাখা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এমন একটি গোপন তথ্য চুরির অভিযোগ এনে একজন সাংবাদিককে যে পাঁচ ঘন্টা আটকে রেখে হেনস্থা করা যায় – জাতি তা দেখলো; তথাকথিত দেশদ্রোহীসম কাজে লিপ্ত সাংবাদিককে ধরতে পুলিশের আসতে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে – জাতি তা দেখলো; একজন নারী সাংবাদিককে থানায় নিয়ে যেতে প্রায় অর্ধ শতাধিক পুলিশের বহরের প্রয়োজন – জাতি তা দেখলো; মন্ত্রণালয়ের ভেতরে একজন অতিরিক্ত সচিব একজন সাংবাদিককের টুটিও চেপে ধরতে পারে – জাতি আজ তাও দেখলো।
গত দুদিনে আমি দেখলাম প্রতিবাদের ভাষাগুলো এ রকম ‘তদন্ত চাই’, ‘বিচার চাই’ গোছের – অর্থাৎ সবই ফিউচার টেন্স। আমার চোখে পড়লো না কেউ বলেছেন ‘বিচার তদন্ত পরে হবে, সব কিছুর আগে টুটি চিপা এই কর্মকর্তাকে তার বর্তমান কর্ম থেকে অব্যাহতি দিয়ে ওএসডি করে রাখা হোক যতদিন তদন্ত শেষ না হয়। ধরে নিলাম আমার চোখে পড়েনি কেউ একজন এই দাবীটি করেছেন। তাহলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে নিদেন পক্ষে ওএসডি করে রেখে কর্তৃপক্ষ সদ্বিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো না কেন?
এই ঘটনায় বাড়তি দুটো পাচক রস রয়েছে। প্রথমত: সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম একজন নারী, দ্বিতীয়ত তিনি প্রথম আলোর সাংবাদিক। একজন নারীর চরিত্র নিয়ে মশলাদার কিছু কথা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারলে তো আর কোনো কথাই নেই, বাকী সব কিছু তার আপন গতিতে চলবে। আর রোজিনা ইসলামের প্রথম পরিচয় তিনি একজন নির্ভীক সাংবাদিক। তিনি প্রথম আলোর নাকি গার্ডিয়ানের নাকি ওয়াশিংটন পোস্টের নাকি দ্যা ইকনোমিষ্টের সাংবাদিক – সেটা কি এতোই বড় ব্যাপার! প্রথম আলোই বা তাদের ষ্টাফের প্রতি কি দ্বায়িত্ব পালন করে তাও দেখার বিষয়।
ভাবছি শেষ পর্যন্ত কি রোজিনা ইসলামের সুবিচার পাওয়া আর অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেসার বিচার কামনা সলজ্জ সাধ হয়েই থেকে যাবে? শুধুই  কি পড়ে থাকবে  হ্যাশট্যাগ ‘ফ্রি রোজিনা!’
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী। মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র কমিউনিটি এক্টিভিস্ট।
Advertisement