ডাকসুর ভিপি নুরুল হক ও ছাত্রলীগের ‘হালকা ধাক্কাধাক্কি’

সোহরাব হাসান :: সম্মেলনের ১০ মাস পর ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে পদাধিকারীদের হাতে পদবঞ্চিতদের নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হওয়ার পর লিখেছিলাম, পদবঞ্চিত হলেও তাঁরা মারবঞ্চিত হননি। এরপর অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগের নির্দেশে হোক আর নিজেদের বোধোদয়ের কারণে হোক, ছাত্রলীগ নেতৃত্ব সন্ত্রাসী হামলার দায়ে চারজনকে সামরিক বরখাস্ত করে এবং একজনকে স্থায়ীভাবে। সাময়িক বরখাস্ত ছাত্রলীগের এক নারী কর্মী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলেও পত্রিকায় খবর এসেছে।

এই ঘটনার পর ভেবেছিলাম, ছাত্রলীগ নিয়ে আর লিখতে হবে না। কিন্তু আজ সোমবার প্রথম আলোর শেষ পাতায় ডাকসুর ভিপি নুরুল হকের আহত অবস্থার ছবি ও খবর পড়ে মনে হলো ছাত্রলীগ আগের ছাত্রলীগই আছে। তাদের চরিত্রে সামান্য পরিবর্তন হয়নি।

কোটা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক ডাকসুর ভিপি হয়ে সাধারণ ছাত্রদের কল্যাণে কিছু করতে পারবেন, সে বিষয়ে খুব আশাবাদী হতে পারছি না। কেননা, ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকসহ ডাকসুর অন্যান্য পদাধিকারী তাঁকে সহায়তা না করলে একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।

তবে কোটা আন্দোলনের পর থেকে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা ছাত্রলীগের হাতে লাগাতার নিগৃহীত হচ্ছেন। ডাকসুর নির্বাচনের পর মনে হচ্ছে ভিপি নুরুল হকই তাদের এক নম্বর লক্ষ্যবস্তু।

আমরা ভেবেছিলাম, দ্বিতীয় পার্লামেন্ট হিসেবে খ্যাত ডাকসুর নির্বাচিত ভিপিকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সম্মান জানাতে না পারুক অন্তত অসম্মান জানাবেন না। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের পরপরই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছাত্রলীগ প্রথমে তাঁর ওপর চড়াও হলো। তিনি সেখানে লাঞ্ছিত অনুসারীদের রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। এরপরও বিভিন্ন সময়ে তিনি নাজেহাল হয়েছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী গণভবনে ডাকসুর অন্যান্য কর্মকর্তার পাশাপাশি ভিপি নুরুল হককে সস্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। নুরুল হকও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখেছেন বলে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।

যেকোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ইফতার আয়োজন করার অধিকার আছে। ছাত্রলীগ চাইলে সেটি করতে পারত। হয়তো করেছেও। কিন্তু তারা কেন অপরের ইফতার আয়োজন বন্ধ করে দিল, সেটি কোনোভাবে মাথায় আসে না।

প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পরেরটি বগুড়ায়। পত্রিকার খবর অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হকের ইফতার অনুষ্ঠানে জোরপূর্বক বাধা প্রয়োগ করে পণ্ড করে দিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার উদ্যোগে শহরের মসজিদ সড়কের গ্র্যান্ড এ মালেক চায়নিজ রেস্টুরেন্টে আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিতে গিয়েছিলেন নুরুল হক। পুলিশ পাহারায় তিনি অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকতে গেলে স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রেস্টুরেন্টে তালা লাগিয়ে দেন। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেলের দাবি, জেলার সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওই ইফতার অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘটনাটি তালা দেওয়ার মধ্যে সীমিত থাকলেও বগুড়ার ঘটনাটি মারধর করা, ডাকসু ভিপির হাসপাতালে ভর্তি এবং নিরাপত্তার জন্য রাতে মাইক্রোবাসে ঢাকায় পাঠানো পর্যন্ত গড়ায়।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে আয়োজিত ইফতার ও দোয়া মাহফিলে যোগ দেওয়ার জন্য ভিপি নুরুলসহ ১৮ জন ঢাকা থেকে বিকেলে বগুড়ায় আসেন। উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগার মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। তবে আয়োজকেরা জানান, বেলা দুইটার দিকে শহরের স্টেডিয়াম পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মোস্তাফিজ হাসান নিরাপত্তার ঝুঁকির কথা বলে তাঁদের এখানে কোনো অনুষ্ঠান করতে নিষেধ করেন। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে ভিপি নুর উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগার চত্বরে আসেন। তবে পুলিশের লিখিত অনুমতি না থাকায় সেখানে অনুষ্ঠানের বাধা দেন সহকারী লাইব্রেরিয়ান রাজু আহম্মেদ। তাঁর সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন নুর। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বগুড়া ছাত্রলীগের সভাপতি নাইমুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একটি দল গ্রন্থাগার চত্বরে ঢোকে। এরপর কোনো কথা বলার আগেই বগুড়া আজিজুল হক কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ ভিপি নুরকে ঘুষি মারেন। এরপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নুরের ওপর অতর্কিত হামলা করেন। মারপিট চলার সময় ভিডিও ধারণ বন্ধের হুমকি দিয়ে যমুনা টেলিভিশনের ফটোগ্রাফারকেও মারধর করেন ছাত্রলীগের সদস্যরা। সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা চলে যাওয়ার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ভিপি নুরকে গ্রন্থাগারের প্রধান ফটকে ফেলে পেটান। এতে নুর ‘অজ্ঞান’ হয়ে গেলে তাঁকে রিকশায় তুলে দেন ছাত্রলীগের নেতা আবদুর রউফ। এরপর দলীয় স্লোগান দিতে দিতে ঘটনাস্থল থেকে খানিকটা দূরে টিটো মিলনায়তনে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ইফতার মাহফিলে যোগ দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

কিন্তু জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাইমুর রাজ্জাক মারপিটের কথা অস্বীকার করে বলেন, গ্রন্থাগারের কাছেই স্বেচ্ছাসেবক লীগের ইফতার মাহফিলের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্য গ্রন্থাগার চত্বর থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। এই কারণে ছাত্রলীগের সদস্যরা সেখানে গিয়ে দেখেন, গ্রন্থাগার চত্বরে ভিপি নুর এসেছেন। এই সময়ে ভিপি নুরের সঙ্গে ‘হালকা ধাক্কাধাক্কি’ হয়েছে।

জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি বলেছেন, মারধর করা হয়নি। হালকা ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। ছাত্রলীগের হালকা ধাক্কাধাক্কিতে যদি ডাকসুর ভিপি আহত হয়ে পড়ে যান এবং তাঁকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়, তাহলে ছাত্রলীগেরে ভাষায় মারামারি হলে কী হতো ভাবতেও শঙ্কিত হই। নুরুল হক ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। তাঁর প্রতি ছাত্রলীগের এই আচরণ কেবল নিন্দনীয় নয়, শাস্তিযোগ্য। ডাকসুর ভিপির গায়ে হাত দিয়ে তারা ফৌজদারি অপরাধ করেছে। ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি কেন বারবার এভাবে নিগৃহীত হবেন? উডবার্ন গ্রন্থাগার চত্বরে ইফতার আয়োজনের অনুমতি যদি কর্তৃপক্ষ না দিয়ে থাকে, তাহলে সেটি তারা দেখবে। কিন্তু ছাত্রলীগ এসে এক জায়গায় তালা লাগিয়ে দেবে, আরেক জায়গায় ডাকসুর ভিপিকে মারবে, এটি কী ধরনের ভব্যতা? দেশে কি আইনকানুন ভদ্রতা-সভ্যতা বলে কিছু নেই? থাকলে ছাত্রলীগ কীভাবে এসব করতে পারে?

ছাত্রলীগ নেতৃত্ব বা সরকার কী জবাব দেবে?

Advertisement