তুমি কেমন করে ‘ধন’ করো হে গুণী

তোফায়েল আহমেদ ::গণমাধ্যমে আচমকা ‘গুণ’ শব্দটার বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। এ গুণ কার এবং কী গুণ? না, এটি কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টির সাধারণ কোনো গুণ নয়, নয় গুনটানা নৌকার গুন। এমনকি কবি নির্মলেন্দু গুণও নয়। এ গুণের বিশেষ মাহাত্ম্য ও মাজেজা আছে। এ গুণ হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্মানিত প্রার্থীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও আয় বৃদ্ধির গুণিতক হিসাব। ‘গুণ’ শব্দটির আরও একটি প্রয়োগ হচ্ছে আজকাল হরহামেশা। কার মামলা কত গুণ বাড়ল বা কমল, সেটি বোঝানোর জন্য। তবে গুণীজনদের সম্পদ ও আয়ের গুণিতক হিসাবের কথা ভেবে একজন বাঙালি হিসেবে গর্বে ছাতি স্ফীত হয়ে ফেটে পড়ার উপক্রম। কারণ, কেউ আমাদের আর গরিব বলার সাহস দেখাতে পারবে না।

দেশ ও জাতি হিসেবে গরিব হলেও জাতির প্রতিনিধিরা সবার পক্ষ থেকে ধন আহরণের যে গতি ও কলাকৌশল জেনে গেছেন, তাতে জাতির দারিদ্র্যের ভাব ও মূর্তি দুটোই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে বাধ্য। যে ধন অর্জনের গুণপনায় জাতি মুগ্ধ, উল্লসিত ও বিগলিত, তা তো তুচ্ছ টাকাপয়সার ধন। ডলার, পাউন্ড, লিরা, ফ্রাঁ, রুপি ইত্যাদির ধনভান্ডার বা কানাডার বেগমগঞ্জ, আমেরিকার ম্যানহাটান, লন্ডনের অভিজাত এলাকার দালানকোঠার প্রসঙ্গ এখানে এখনো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেনি। পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ বাংলাদেশের কোনো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনবানদের তালিকায় দেখে বাঙালিদের ধনগুণে মুগ্ধ সিঙ্গাপুরের এক পত্রিকা বিস্মিত হয়ে খবর প্রকাশ করেছিল। আনন্দে রবি ঠাকুরের একটি গান সামান্য পরিবর্তন করে এখন গাইতে ইচ্ছা করে, ‘তুমি কেমন করে “ধন” করো হে গুণী, আমি শুনি, শুধু অবাক হয়ে শুনি।’

এ ধন অর্জন প্রতিযোগিতায় বিরোধীদলীয়রাও খুব পিছিয়ে নেই। রাজনীতির মাঠে বিরোধী দলও আবার এক প্রকারের নয়। মাঠের ও জেলখানার বিরোধী দল এবং সরকারি বিরোধী দল। স্বামী সরকারি বিরোধী দলের সভাপতি আর স্ত্রী সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। স্বামী-স্ত্রী দুজনের দুই ভূমিকা। একজন বিরোধী দলের নেতা তো অন্যজন মন্ত্রীর মর্যাদায় সরকারের উপদেষ্টা। দুজনের সম্পদ বর্তমান ও সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীর (দুজনই তিনবারের প্রধানমন্ত্রী) মিলিত সম্পদের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।

বেশি বেশি কর দিলে কিছু করদাতাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ‘কর বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করে। আমাদের দেশের একজন মন্ত্রীর পিতৃপ্রদত্ত নামই বীর বাহাদুর। তাঁর স্ত্রী ধনগুণে এ দেশে শীর্ষস্থানীয়। গত ১০ বছরে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ৭৫ গুণ এবং আয় ৯৩ গুণ বেড়েছে (প্রথম আলো, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮)। তিনি এবার ‘ধন বাহাদুর’ খেতাবও পেতে পারেন।

এ রকম আরও দৃষ্টান্ত এ দরিদ্র জাতির সামনে আসতে পারে। তাদের যথাযথ ইস্তেকবালের জন্য জাতির প্রস্তুতি থাকা আবশ্যক। আর প্রকাশ্য ধনই তো সব ধন নয়, অনেকের গুপ্তধনও এন্তার। মাটি খুঁড়ে তার খবর বের করবে কে? ধনবান হওয়া অন্যায় নয়। আইনানুগ ও ন্যায়ানুগভাবে ধনার্জন মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ, দেশে-বিদেশে যাঁদের আরও সম্পদ আছে, কিন্তু প্রদর্শিত হয়নি, তাঁদের খুঁজে বের করুন। তাতে দেশের বাইরেও আমাদের ধনবানদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। এখানেই নির্বাচন কমিশন দক্ষতা ও সততার পরিচয় দিক। দুদক, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করি সহায়তা করবে।

খুব জমে উঠলেও নির্বাচনে ওয়াদা খেলাপ, নীতি খেলাপ-জাতীয় বিষয়গুলোরও গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার কোনো আলোচনা কোথাও নেই। অর্থমন্ত্রী এস এ এম এস কিবরিয়া-তনয় গণফোরাম-প্রার্থী রেজা কিবরিয়ার ক্রেডিট কার্ডের নবায়ন ফির পাঁচ হাজার টাকা বকেয়ার বিষয়টি কী অপরূপ দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চিহ্নিত করা হলো ‘বিল খেলাপ’ হিসেবে। উদ্দেশ্যের সততা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও কর্মের দক্ষতা প্রশংসনীয়। শেয়ারবাজার নিয়ে চিহ্নিত লোকেরা ছিনিমিনি খেলে বহু নিরীহ বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়েছে। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এখন অনেক প্রার্থীর ধনদৌলতের হিসাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বেশুমার লাভালাভ পরিলক্ষিত হচ্ছে হলফনামায়। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর যে সরকারি তদন্ত হয়েছিল, তার আলোকে নির্বাচনী হলফনামার তথ্যের সম্পর্ক নির্ণয় জরুরি ছিল। এখানে সিকি ভাগ দক্ষতা দেখাতে পারলে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী নির্বাচন কমিশনকে মাথায় তুলে নাচত।

যেসব এমপি-প্রত্যাশী চূড়ান্তভাবে বাদ পড়লেন, তাঁদের জন্য অশেষ সমবেদনা। এ দুঃখের মধ্যেও কিন্তু দুটো মহা আনন্দ সংবাদ ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। আনন্দটা আসলে দেশের দুটি স্বনামধন্য পরিবারের একান্ত নিজস্ব। তবু কোনো কোনো আনন্দ ব্যক্তিগত পরিসর ছাড়িয়ে যায়। টেকনাফের এমপি বদির মাথায় ‘ইয়াবা-সম্রাট’-এর মুকুট। কথায় কথায় তিনি হাত চালাতেন। তিনি নাকি কথাই বলেন হাতে। বহু সরকারি কর্মকর্তা তাঁর কিল-ঘুষি-থাপ্পড় খেয়ে ধন্য হয়েছেন। সে পরিবার এখন মহাখুশি। বদির বদলে মাঠে এবার বউদি! টাঙ্গাইলে এক হত্যা মামলার তিন আসামি পুত্রের বাবা এমপি পদপ্রার্থী। তাঁদের পরিবারের খুশির আনন্দে দূর থেকেই শুধু শরিক হতে পারলাম।

পরিশেষে সেই অতিপরিচিত প্রবাদবাক্যটি স্মরণ করতে পারি। যে জাতি গুণীর কদর করে না, সে জাতির মধ্যে গুণীর জম্ম হয় না। আসুন সবাই গুণীর কদর করতে শিখি।

ড. তোফায়েল আহমেদ: অধ্যাপক, লেখক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ

Advertisement