থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়

সৈয়দ আবুল মকসুদ:: একবার এক লোককে জমিদার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘খাওয়াদাওয়া কেমন চলছে?’ লোকটি জবাব দিলেন, শজনের ডাঁটার চচ্চড়ি, কলাগাছের থোড়ের ঝোল, ডাল আর মিষ্টিকুমড়ার বড়া। জমিদার বললেন, এর আগেও তো ওই একই কথা শুনেছি। লোকটি বললেন, ‘ওই হলো, থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।’

কোনো অবস্থা যখন আগে-পরে একই রকম এবং বৈচিত্র্যহীন, তখন তাকে থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় বলাই যায়। পরিবর্তন ও বৈচিত্র্যের ভেতর দিয়ে অগ্রগতির সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের রাষ্ট্র। ১০ কোটির বেশি ভোটার। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটি। এখানে অন্তত ১০ হাজার মানুষ আছেন, যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগ্য। ৩০০ বা ৩৫০ আসনের অন্তত ১০টি পার্লামেন্ট গঠনের মতো যোগ্য মানুষ এ দেশে রয়েছেন এবং জনগণের প্রত্যাশা, একটি সংসদের চেয়ে আরেকটি সংসদ আরও দক্ষ ও শক্তিশালী হবে। শক্তিশালী সংসদ হলেই শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পারে এবং শক্তিশালী মন্ত্রিসভাই দক্ষ সরকার ও সুশাসন দিতে পারে। তবে সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনশীল; একটি সরকার যে আরেকটি সরকারের চেয়ে ভালো হবে, প্রগতিশীল হবে, দক্ষ হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের সুবিধা এখানে যে অদক্ষ সরকারকে আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়ারও সুযোগ থাকে।

সবার আগে যে জিনিসটি দরকার তা হলো, যিনি জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য প্রার্থী হবেন, তাঁকে জানতে হবে—আমি যে সংসদের একজন সদস্য হতে যাচ্ছি, আমার কাজটা কী হবে? সেখানে গিয়ে তিনি কী কী সুযোগ-সুবিধা পাবেন, তা তিনি যেমন জানেন, তেমনি তাঁর ভোটাররাও অধিকাংশই জানেন। সেখানে গেলে কোটি টাকার গাড়ি ডিউটি ফ্রি কেনা যায়, বিপুল বেতন-ভাতা পাওয়া যায়, যা জনগণের টাকায় দেওয়া হয়, বিপুল সয়-সম্পত্তি থাকলেও রাজউকের একটি প্লটপ্রাপ্তিও অবধারিত। এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বস্তুত সবকিছুর ওপর খবরদারির ক্ষমতা তো আছেই।

নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইনের সময়োপযোগী সংশোধন একটি কাজ সাংসদের; কিন্তু তার বাইরে জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষাই সবচেয়ে বড় কাজ। সে জন্য নিজের ঘরসংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য, সর্দিকাশি হলে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, নিউইয়র্কে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে কম ব্যস্ত থাকলে ভালো। আমরা তাঁকেই সহস্র সালাম জানাব, যিনি নিজে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা তাঁর এলাকার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বা জেলা সদর হাসপাতালে করিয়ে থাকেন। কয়েক বছর আগে আমি একজন সাংসদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁর এলাকার উপজেলা হাসপাতালের কয়জন চিকিৎসক আছেন এবং ঘাটতি কয়জনের। কথা বলে বুঝতে পারলাম, তিনি হাসপাতালটির ভেতরে কখনো ঢোকেননি।

পার্লামেন্ট হলো জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ বিতর্কের জায়গা। যুক্তিযুক্ত বিতর্ক করার যোগ্যতা যাঁর যত বেশি, সাংসদ হওয়ার যোগ্যতা তাঁর তত বেশি। ভোটকেন্দ্রে পর্যবেক্ষক এবং সংবাদকর্মীদের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও চলবে, কিন্তু সংসদের ভেতরে সদস্যদের মূর্তির মতো বসে থাকলে চলবে না। বোবা বা কালার ভান ধরে বসে থাকলেও হবে না। দলের বিরুদ্ধে না গিয়েও জনস্বার্থে দলের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা চাই। তা যদি না করেন, তাহলে ভোটারদের সঙ্গে নিমকহারামি করা হবে। দলের নেতার আনুগত্য স্বীকার করেই তাঁর ভুল সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার সৎসাহস থাকা চাই। সামনে তোয়াজ করে আড়ালে নেতার সমালোচনা করা খুবই নীচতা, চুগলখোরি জিনিসটি বাঙালিরই বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য জাতি যা বলার সামনাসামনি বলে, আড়ালে গিবত গায় না। গিবতকারীকেও দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ, চাটুকারিতা ও খোশামোদিকে প্রশ্রয় দিলে গিবত গাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না।

বশংবদ কিছু লোকের মিলনমেলা হলে তাকে আর পার্লামেন্ট বলা যায় না। তার দ্বারা জনগণের কোনো উপকার হয় না। ভারতের প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান হীরেন মুখোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি, বিধানসভার নেতা বিধানচন্দ্র রায় বলতেন তাঁর বন্ধুপুত্র বিরোধী দলের জ্যোতি বসু সম্পর্কে, জ্যোতি আরও বলুক। লোকসভায় সমাজবাদী নেতা ড. রামমনোহর লোহিয়া সরকারের তীব্র সমালোচনা করতেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু গালে হাত দিয়ে বসে শুনতেন। স্পিকার তাঁকে থামিয়ে দিতেন না। দেশের স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ আর গোষ্ঠী ও ব্যক্তির স্বার্থ দুই জিনিস।

বিপুলসংখ্যক বশংবদ ব্যক্তিকে নিয়ে মস্ত বড় একটা মন্ত্রিসভা গঠন করলেই ভালো সরকার হয় না। বাংলার ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত সংসদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক। অবিভক্ত বিশাল বাংলা। মন্ত্রিসভা মাত্র ১১ জনের। তার মধ্যে খাজা নাজিমুদ্দিন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন; হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন পাঁচজন—নলিনী রঞ্জন সরকার (অর্থ), শ্রীশচন্দ্র নন্দী, বিপি সিংহ রায়, মুকুন্দ বিহারী মল্লিক প্রমুখ। খুব ভালো চালিয়েছেন সরকার।

দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিমুদ্দিনের। তাঁর মন্ত্রিসভা ছিল ১৩ জনের। হিন্দু নেতারা অর্থ দপ্তর চেয়েছিলেন। বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা তুলসী গোস্বামীকে অর্থ মন্ত্রণালয় দেওয়া হয়। তমিজুদ্দিন খানকে শিক্ষা। নবাব মোশাররফ হোসেনকে আইন। জমিদারি প্রথা ছিল। তারক মুখার্জি চেয়ে নিয়েছিলেন রাজস্ব। সোহরাওয়ার্দী সিভিল সাপ্লাই নিয়ে বহু মুসলমান যুবককে চাকরি দেন। ছয়জন হিন্দু মন্ত্রীর মধ্যে ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল (সমবায়), প্রেমহরি বর্মণ (বন ও আবগারি), পুলিন মল্লিক (প্রচার)।

ঋণ সালিসি বোর্ড আইনটি নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভাই চূড়ান্ত করে, পাস করে ফজলুল হকের সরকার। নাম হয় তাঁর। তবে সরকার একটি ধারাবাহিকতা। একই সংসদ একাধিক মন্ত্রিসভা উপহার দিতে পারে। বিশেষ করে কোয়ালিশন সরকারগুলোর ক্ষেত্রেই তেমনটি বেশি দেখা যায়।

গত পাঁচটি সংসদে দেখা গেছে, জনস্বার্থ নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে অল্প, খিস্তিখেউর হয়েছে বেশি। সংসদ যেন ইতিহাসের ক্লাস। সাংসদেরা কেউ ইতিহাসের প্রফেসর, কেউ ইতিহাসের ছাত্র। পার্লামেন্টে ইতিহাস নিয়েও আলোচনা হবে। তবে সে ইতিহাসের বিষয়বস্তু যদি হয় পাল ও সেন যুগ নিয়ে কিংবা হোসেন শাহি রাজত্ব নিয়ে, তাহলে ভালো। যে কালপর্বটি কিছুদিন আগেই মানুষের চোখে দেখা, তা নিয়ে বাক্যব্যয় ও অর্থব্যয় স্রেফ অপচয় ছাড়া কিছু নয়। জনপ্রতিনিধিদের মুখে ওসব মানুষ শুনতে চায় না।

পাতানো মামু যেমন মামা নয়, পাতানো বিরোধী দলও বিরোধী দল নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল সরকারের অতিগুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান বিরোধী দলের নেতাই হয়ে থাকেন। গত ২৭ বছরে এই কমিটির তৎপরতা সম্পর্কে মানুষ বিশেষ অবগত নয়। রাষ্ট্রের টাকাকড়ি মুড়িমুড়কির মতো খরচ হচ্ছে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের অফিসের রিপোর্ট নিয়ে সংসদে কবে আলোচনা হয়েছে, তা জনগণ জানে না।

মোগল সামন্তবাদী শাসনব্যবস্থার পর ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকেরা যে প্রশাসনকাঠামো রেখে গেছে, তাতে কোনো নির্বাচিত সংসদ ছাড়াও রাষ্ট্র চলবে। তা বিভিন্ন সামরিক শাসনের সময় দেখা গেছে।

কিন্তু তাতে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী, ভাষাভাষী, ধর্ম, বর্ণের মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষিত হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তা দিতে পারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সংসদ। সুতরাং ত্যক্তবিরক্ত বাংলাদেশের মানুষের এখন একটাই চাওয়া, তা হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা তেমন একটি সংসদ গঠিত হবে। তার বাইরে জোড়াতালি দিয়ে কিছু হলে জনগণের হতাশার সীমা থাকবে না। মানুষ থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় চায় না।

Advertisement