দীর্ঘ জটিলতা কাটিয়ে আবারো ইউরোপে পান রপ্তানির অনুমতি পেল বাংলাদেশ

।। হিমিকা আযাদ ।। 

বাংলাদেশের পানে ক্ষতিকর সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির কারণে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ থেকে সাময়িকভাবে পান রফতানির উপর ইইউ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যা ধাপে ধাপে ২০২০ পর্যন্ত বর্ধিত করে।কিন্তু তারপরও গোপনে পান রপ্তানী করছিল ব্যবসায়ীরা ।
অর্থনীতি বিষয়ক ইংরেজি দৈনিক দি ফিন্যানশিয়াল এক্সপ্রেসের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল নিষেধাজ্ঞার পরও শাকসবজির মধ্যে পান ঢুকিয়ে গোপনে ইউরোপে পান রপ্তানি করছিলেন কিছু ব্যবসায়ী৷ সেটি ধরা পড়ার কারণে এখন ফলমূল ও শাকসবজি রপ্তানির ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ এর ফলে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা রপ্তানি আয়ের সুযোগ নষ্ট হতে পারে।


বিষয়টি নিয়ে তখনকার বাণিজ্য সচিব মাহবুব আহমেদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। কারণ গোপনে পান রপ্তানির সঙ্গে কতিপয় কাস্টমস কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে৷। এরই মধ্যে
ইইউ পান রপ্তানীতে কতিপয় শর্ত আরোপ করে। পান সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া মুক্ত হতে হবে, উৎপাদন হতে শিপমেন্ট পর্যন্ত উত্তম কৃষি চর্চা (গ্যাপ), গুড হাইজিন প্র্যাকটিসেস (জিএইপপি),  গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস (জিএমপি) অনুসরণ করতে হবে, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব হতে সালমোন্যালা ব্যাকটেরিয়া মুক্ত সার্টিফিকেট প্রভৃতি প্রদান করতে হবে।
ইইউ আরোপিত শর্তপূরণে বাংলাদেশ অনেকগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর মধ্যে রয়েছে পান আবাদের এলাকা নির্বাচন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, উত্তম কৃষি চর্চার আলোকে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, মনিটরিং, ট্রেসিবিলিটি বা শনাক্তকরণ, পানের স্যাম্পল টেস্ট, কৃষক নির্বাচন ও প্রশিক্ষণ, রফতানিকারকদের প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ, নিয়মিতভাবে পানের জমির মাটি ও পানি পরীক্ষা, রপ্তানি বাজারের জন্য নিরাপদ ও বালাইমুক্ত পান উৎপাদন নির্দেশিকা প্রভৃতি।

এসব উদ্যোগের মাধ্যমে ইইউ’র আরোপিত শর্ত পূরণ করতে পারায় গত ১৫ এপ্রিল ২০২১ সালে পান রপ্তানীর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। যার ফলে বুধবার থেকে পান রফতানি আবার শুরু হলো।
নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে ২০১২-১৩ সালে ১৮ হাজার ৭৮০ টন ও ২০১৩-১৪ সালে ১৩ হাজার ২৫০ টন পান রপ্তানি হয়। যার মূল্য যথাক্রমে ৩৮ মিলিয়ন ও ৩০ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
বুধবার (২৬ মে) সকালে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ঢাকার শ্যামপুরে কেন্দ্রিয় প্যাকিং হাউজে ‘ইউরোপে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন পান রফতানি’ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। প্রথম চালানে রফতানি হচ্ছে এক মেট্রিক টন পান।
এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মন্ত্রী বলেন, আমাদের নিরলস উদ্যোগের ফলে ইউরোপে পান রপ্তানী আবার শুরু হয়েছে। এটি খুবই আশার কথা। ভবিষ্যতে পান রপ্তানি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবলস অ্যান্ড এলাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিএফভিএপিইএ) ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক আরও বলেন, কৃষিপণ্যের রপ্তানীর সম্ভাবনা অনেক। সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ইউরোপসহ উন্নত দেশে অন্যান্য কৃষিপণ্যের রপ্তানী বৃদ্ধিতে উদ্যোগ অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে দেশে উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা (গ্যাপ) বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। সারাদেশে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিষমুক্ত শাকসবজি উৎপাদন হচ্ছে। অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব থেকে সনদ দেয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া, ভ্যাকুয়াম হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ চলছে। ফলে, আমরা আশা করছি, দেশের রফতানি বৃদ্ধিতে কৃষিপণ্য বিরাট ভূমিকা রাখবে ও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। এছাড়া, কৃষকও লাভবান হবে।

পান ভারত, মায়ানমার, কম্বোডিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, লাওস এবং ভিয়েতনাম সহ অনেক এশীয় এবং মহাসাগরীয় দেশগুলিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ তৈরি করে। এটি কারো কাছে সখের আবার কাছে নেশার বস্তু । ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে থেকেই দক্ষিন এশিয়ার মানুষ পান খাওয়া রপ্ত করে ফেলেছিলো। পাঁচ হাজার বছর আগেকার রচনা শ্রীমদ্ভগবতে লেখা আছে, দেবতা কৃষ্ণ পান খেতেন। বলা হয়ে থাকে, দেব চিকিৎসক ধন্বন্তরীর সহায়তায় আয়ুর্বেদ পণ্ডিতরা এটা আবিষ্কার করেন। ইতিহাসে রয়েছে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয়তমা রানী নূরজাহান অন্দরমহলে নারীদের কাছে পান জনপ্রিয় করে তোলেন। হৃদয়াকৃতির পানকে সাহিত্যে কম ভালোবাসা দেখানো হয়নি। আর গানতো রয়েছেই। মধ্যযুগীয় কবি আলাওল তার পুঁথি সাহিত্যে পানের বর্ণনায় বলেছেন ‘অধর রাতুল কৈল তাম্বুল রসে’। পল্লী কবি জসীম উদ্দিন তার ‘পালের নাও’ কবিতায় লিখেছিলেন ‘পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও- পালের নাও। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্ল বর্মন লিখেছিলেন ‘পান খায়ো রসিক জামাই কথা কয়ো ঠারে (হুঁশিয়ার হয়ে)/ পানের জন্ম হইলো কোন অবতারে?’। পরিতোষ ভৌমিকের কবিতায় আছে ‘পান আছে আমার ঘরে পানের স্ব-মহিমায়/ পানের রসে গড়াগড়ি স্বর্গ বিষাদ ছায়।’ কবি আসাদ চৌধুরীর ‘তবক দেওয়া পান’ নামে একটি গোটা কাব্যগ্রন্থই রয়েছে।
আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষের কন্ঠে চট্টগ্রামের খুবই জনপ্রিয় একটি আঞ্চলিক গান হচ্ছে- ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, মহেশখালির পানের খিলি তারে বানাই খাবাইতাম’। যেটি পরবর্তীতে ‘সদরঘাটের পানের খিলি’ নামে একটু পরির্বতন করে আজিজুর রহমানের ‘সাম্পানওয়ালা’ নামক ছবিতে সংযোগ করা হয়। অথবা উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার কন্ঠে –‘পান খেয়ে ঠোঁট লাল করিলাম/ বন্ধুভাগ্য হইলো না।’ আবেদনভরা এই গানটি প্রবল জনপ্রিয়তা পায় একসময়। বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের ‘বাটাতে পান সাজায় থুইলাম/ বন্ধু এসে খাইলো না’, কণ্ঠশিল্পীর আনুশেহ’র গাওয়া ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও’, ।পান নিয়ে বোম্বের ‘ডন’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘খাইকি পান বানারাস ওয়াল, খুল য্যায়ে বান্ধ আকাল তালা’ এই গানটি জনপ্রিয়তায় গানের সকল রের্কডকে ছাড়িয়ে যায়।

হিমিকা আযাদ : ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট ইউকে।

 

Advertisement