‘দীর্ঘ রবীন্দ্রযুগ’

।। Dr. Zaki Rezwana Anwar।।

আজ ২২শে শ্রাবণ। পালিত বা উদযাপিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যবার্ষিকী। পালন বা উদযাপন শব্দ দুটোই খুব সীমিত শোনায়। কারণ রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর জীবনে কেবলমাত্র পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণে মঞ্চের পেছনে সাঁটিয়ে দেয়ার জন্যে কোনো চিত্রকলা নয় – রবীন্দ্রনাথ রয়েছে বাঙালীর হৃদয়ে, জীবনে, মননে – সংবৎসর।

ব্রিটবাংলায় প্রকাশিত ডক্টর জাকি রেজওয়ানা আনোয়ারের অন্যান্য লেখা :

https://britbangla24.com/news/47070

https://britbangla24.com/news/36629

https://britbangla24.com/news/28055

রবীন্দ্রনাথের কাজের পরিধি এত বিশাল, তাঁর সৃষ্টিশীলতা এত বিচিত্র ও তাঁর ভাবনা এত পরিশীলিত যে, অনেকের পক্ষে তাঁর দর্শনকে পুরোপুরি জানা বা বোঝা সহজ নয়। তবু বলতে হয়, বাংলাভাষী প্রায় প্রত্যেক মানুষের জীবনেই রবীন্দ্রনাথ কোনও না কোনও ভাবে তাঁর ছায়া ফেলে গেছেন । আমাদের সুখে দুঃখে, উৎসবে পরবে, শোকে শ্বান্তনায়, আকাঙ্ক্ষায় নিঃসঙ্গতায় – রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে রয়েছেন পরতে পরতে। এক কথায় রবীন্দ্রনাথ যার সঙী তার কখনো একা হতে হয় না।

রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার সব চাইতে বড় ফসল হচ্ছে তাঁর গান। এখানে ‘গান’ বলতে গীতিকবিতা বা বাণী, সুর ও তালের অবিচ্ছেদ্য amalgamation-এর কথাই বোঝাতে চাইছি। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী ও সুর বিশ্লেষণ কোরলে মনে হয়, একটি গানের বাণী আর তার সুর হচ্ছে অনেকটা কাপ-পিরিচের মত। কাপের গায়ে ফুল আঁকা থাকলে পিরিচের গায়ে সিংহ আঁকলে চলবে না, তাতে আঁকতে হবে প্রজাপতি। একেই হয়তো বলে beautification । রবীন্দ্রনাথ তাঁর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বাণী, সুর আর তালকে একই সঙ্গে বশীভূত কোরে এমনভাবে একই বিন্দুতে নিয়ে এসেছে যে একেকটি গান হয়ে গেছে একেকটি complete feature, প্রতিটি গানই হয়ে উঠেছে তাঁর নিজের গান – রবীন্দ্রসঙ্গীত ।

কখনো কি মনে হয় না যে, রবীন্দ্রনাথের গান হচ্ছে কৃষ্ণের বাঁশী? কৃষ্ণের বাঁশী শুনে রাঁধা মনে কোরত কৃষ্ণ তাকে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে আবার কৃষ্ণের ভক্তরা মনে কোরত এ তাদের প্রতি আহ্বান। মনন ভেদে, জীবনের বিভিন্ন স্তরে রবীন্দ্রনাথের একই গানকে কখনো মনে হয় এটি মানব মানবীর প্রেমের গান আবার কখনো মনে হয় এটি সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে একটি আত্মার যোগাযোগ। ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না’ এটি কি মানবীয় প্রেমের গান না কি আধ্যাত্মিক গান? এই versatility-ই বোধকরি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিয়ে গেছে অন্য এক level-এ।

তবে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মুগ্ধ এবং বিস্মিত করে রবীন্দ্রনাথের অপরিণত বয়সের ভারী কিছু গান । মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন ‘মরণ রে তুহূঁ মম শ্যাম সমান’ -এর মত গান।, ‘এ মোহ আবরণ খুলে দাও, দাও হে’-এর মত এমন একটি জীবন জিজ্ঞাসার গান তিনি লিখেছিলেন তেইশ বছর বয়সে। ‘তবু মনে রেখো’ -এই গানটিও রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর যৌবনে, যদিও কবিতাটি সুর কোরেছিলেন পরিণত বয়সে আর নিজ কণ্ঠে রেকর্ড কোরেছিলেন তাঁর শেষ জীবনে। তাঁর বাইশ বছর বয়সে লিখা একটি গান ‘মরি লো মরি আমায় বাঁশীতে ডেকেছে কে’ – যা স্বামী বিবেকানন্দের ( তখনকার রবীন্দ্র বন্ধু নরেন্দ্রনাথ দত্ত) কণ্ঠে অনেক গীত হত। পড়ে জেনেছি যে স্বামী বিবেকানন্দের গুরূ কাশীতে তাঁকে এই গানটি গাইতে মাঝেমাঝে অনুরোধ কোরতেন।

কখন কোন বেদনায়, কোন চেতনায়, কোন জীবন জিজ্ঞাসায় রবীন্দ্রনাথ কি গান লিখতে পারেন তা বুঝে উঠা দুরূহ ব্যাপার, তবে এটুকু বুঝতে পারি যে আমরা একটি দীর্ঘ রবীন্দ্রযুগের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি আর কোন বাঙালীই বা চায় যে এ যুগের শেষ হোক?

লেখক : ডক্টর জাকি রেজোয়ানা আনোয়ার, মা ও শিশু বিশেজ্ঞ। চ্যানেল এসের সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার এবং সিনিয়র কমিউনিটি এক্টিভিস্ট।

Advertisement