দুটি ছবি এবং হার না মানা প্রত্যয়…

:: আ নো য়া রু ল ই স লা ম অভি ::


তারিকুল ইসলাম স্যার
ক.
কিছু মানুষ আলো নিয়েই যাপিত থাকেন। সংসারে, সমাজে। মানুষের বোধটা নিহারিকার মতো একদিনে এবং এমনি এমনি হয় না। তার জন্য চাই ইচ্ছা শক্তি,শুদ্ধ চিন্তা এবং তার ধারাবাহিক চর্চা। এই ছবিটা আমার কাছে একটা গল্পের মতো। অনেক ভাবে আমি দেখি।আমার শৈশব। আমার প্রিয় বন্ধু ,শিক্ষক পিতার খুব সাধারণ, সফেদ জীবন। জীবনের প্রথম স্কুলে ধারাপাত শেখা সময়। আমার প্রিয় শিক্ষাগুরুগণ।যাদেরকে আমি পিসিমা ও দিদি বলেই ডাকতাম।
এই ছবিটা আবার আমাকে জীবন বদলের প্রবল ইচ্ছা শক্তিতে ‘‘হার না মেনে’’ চলার প্রত্যয় দেয়। যেভাবে স্যার তার প্রিয় শিক্ষার্থীদের সাথে স্নেহ-মমতার বন্ধনে মিশে আছেন ক্লাসরুমে। অপার ব্যক্তিত্বে প্রেরনাদায়ী হয়েও।

ছবিটা আমি নিবন্ধ চোখে দেখছি । শিক্ষার্থীদের চোখের ঝিলিক আর স্মিত হাসি বলে দিচ্ছে- তাদের কাছে ভুতপূর্ব প্রেরনাময়ী সময় বলতে আসলে এই মূহুর্তকেই বুঝায়। আমার নিখাদ বিশ্বাস, এভাবেই একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষাগুরুর জ্ঞানসঙ্গ চায়। আমরা এভাবেই আশায় আশায় বাঁচি। বাঁচতে চাই। যদিও আমাদের সামনে সংখ্য গরিষ্ট হয়ে আছে- ভুরি ভুরি অন্ধকার আর বাতি নিভে যাওয়ার উদাহরণ।

এই বাঁচা –মরায়, গোলক ধাঁধাঁয়, দ্বিধায় অথবা বৈরী পরাবাস্তবতার মাঝেও মানুষ আশায় বাঁধে ঘর। এই রকম আদর্শিক শিক্ষক,দ্বিজ পিতা মাতা আমাদের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী দরকার। প্রতিটি শিক্ষালয়ে। প্রতিটি ক্লাসে।ধারাপাত শ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে।


বিশ্বজিৎ
খ.
আরেকটি ছবি গত তিনদিন থেকে আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। আমি নরম মনের মানুষ। জানি অপদার্থরাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নরম মনের হয়। এবং হয়তো অপদার্থ বলেই রক্তভয় ও ভীষণ রকম আছে।’’……. বিশ্বজিৎকে তার সমবয়সী শিক্ষার্থীরা অতর্কিত কুপাচ্ছে।

বিশ্বজিৎ এর শরীর রক্তে ভেজে গেছে। তবুও তাঁর চাপাতি ও ধারালো অস্ত্রের কূপ সামলানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা। কি বিভৎস, বর্ণনাহীণ কষ্টের….’’। দৃশ্যটি আমার চোখ থেকে সরাতে পারছি না।

অনেক দিন এই দৃশ্যটি সংবাদ মাধ্যমে ‘‘খবর’’ হয়নি। তিন দিন আগে, উচ্চ আদালতের রায় এর পর বিশ্বজিৎ আমাদের চোখে, বোধের দরজায় ঘুরছে!

মানুষের মস্তিস্ক নাকি প্রতি চবিশ ঘন্টায় মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিট ধারন করে রাখার ক্ষমতা রাখে।বাকী সময়ের স্মৃতি স্বাভাবিক ভাবে ডিলিট হয়ে যায়। বিশ্বজিৎ আমার জন্য কি তাহলে ব্যাতিক্রম হয়ে আসলো। আমি কেন ঘুমাতে পারছিনা। চোখের সামন থেকে বিভৎস,রক্তাক্ত ছবিটি সরাতে পারছিনা?
বিশ্বজিৎ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছিল। তার সহপাঠি,বন্ধু অথবা পতিপক্ষ যারা কুপিয়েছে তারাও ছাত্র ছিল। তাদেরও আমার মতো জীবনের প্রথম স্কুলে ধারাপাত , নামতা পড়ে, ধাপে ধাপে বিশ্ববিদ্যালয় আসতে হয়েছে। তাদের ও মা আছে। বাবা আছে। আছে বোন ,বন্ধু। পায়ে নুপুর, চোখে কাজল আর আলকাতরা রঙের লম্বা চুল বেনী করে অপেক্ষায় আছে হৃদগহীনের একান্ত কেউ। সচিত্র এবং ভিডিও ক্লিপে পক্রিকা এবং ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া চিহ্নিত অপরাধীরা সর্বোচ্চ আদালত থেকে সহজ সাজায় বেরিয়ে আসা ও সাজা কমিয়ে আনার নেপথ্য অন্যতম কারণ হলো- ’’আইনজীবি- ফরেনসিক বিভাগ, তদন্তে দ্বায়িত্বে থাকা পুলিশ – প্রসাশন এবং আইনজীবী‘দের যৌথ প্রচেষ্টা।

এই মুহুর্তে, আমি বার বার স্যারের ছবিটি দেখছি। এই সময়ে, নস্ট ভ্রষ্টদের আধিক্য যেখানে, সেখানে মানবিক অর্থে আমি খুব দুর্বল মানুষ। দুর্বলদের যে কোন বিষয়ে বিশ্বাসের মাত্রাটা একটু বেশী থাকে। আমি উচ্চ আদালত সম্পর্কে সচেতন ভাবেই কোন মন্তব্য করবোনা। এবং’’আইনজীবি- ফরেনসিক বিভাগ, তদন্তে দ্বায়িত্বে থাকা পুলিশ – প্রসাশন এবং আইনজীবী‘দের বিষয়ে দুর্বলদের আসলে কিছু বলতে নেই! অন্তত বিশ্বজিৎ এর মা-বাবার আতংকিত মূখ তাই বলে।

স্যারের এই ছবিটা আমি মমতায়, সহজ যুক্তিতে, আকড়ে থাকতে চাই। আমি আশায় আশায় থাকতে চাই। আমার ঝাউবন কান্দে ঘরকন্যার লাগি কাব্যগ্রন্থে ‘‘ভূমিহীন ভূমিপুত্রের গল্প‘‘ কবিতায় রইস মিয়ার স্বপ্নের মতো- ‘‘…তবু কচুপাতা ঘরের স্বপ্ন দেখে রইস মিয়া। চোখ বুজে খালি পেটে আলো বুনে। যেভাবে গেছে সব ঢেউয়ের তুড়ে চোখে চোখে পাষাণ পেটে, আবার যদি ঢেউয়ে ঢেউয়ে জেগে যায় আমার সোনাভূমি….!“(অসমাপ্ত)।

রইস মিয়ার মতো আমার দিবাস্বপ্নের অলৌকিক ছোঁয়ায় যদি জেগে উঠে হাজার সবুজপ্রাণ। গ্রীক একটি প্রবাদে আছে- ‘‘দুর্বলদের ধর্ম বিশ্বাস প্রবল হয়।” আমি দুর্বল মানুষ- পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করছি- এই ছবির শিক্ষার্থীরা অনন্ত তাদের দ্বিজ পিতাদের আদর্শিক চেতনা এবং বোধে বড় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়ে, – ’’আইনজীবি- ফরেনসিক বিভাগ, তদন্তে দ্বায়িত্বে থাকা পুলিশ – প্রসাশন এবং আইনজীবী ইত্যাদি পেশায় সৎ ভাবে তার উপর অর্পিত রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন পালন করে। তার শিক্ষাগুরু এবং পিতা মাতার মুখ আলোয় ভরে রাখুক। বিশ্বজিৎ এর মতো অসহায়, সুবিচার চেয়ে আদালতে আতংকে ও অপমাণে সময় পার করা মা-বাবাদের নির্ভরতার প্রতীক হোক। মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে, স্যারের মতো তার অগনণ ছাত্রের মাঝে মানবিকতার আদর্শিক স্ফোরন ঘটাক।

মানুষের স্মৃতি শক্তি নাকি প্রতি এগারো বছর পর পর ঝরে যায়, আপনা আপনি। কিছু বিশেষ স্মৃতি ছাড়া। স্যারের এই ছবিটি আমার স্মৃতিতে আমৃত্যু জীবন্ত রাখতে চাই। শ্রদ্ধেয় তারিকুল ইসলাম স্যার এবং এই রকম মানবিক বোধের শিক্ষকদের দীক্ষায় বড় হওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকে নিশ্চয় উচ্চ আদালতে বিচারক হবে। বিশ্বজিৎ এর মামলায় প্রভাব খাটানো অসৎ, অমানুষ ’’আইনজীবি- ফরেনসিক বিভাগ, তদন্তে দ্বায়িত্বে থাকা পুলিশ-প্রসাশন এবং আইনজীবী‘ দের জায়গায় তাদের একদিন চাকুরী হবে। বিশ্বজিৎ এবং তার মা-বাবা হয়তো ক্ষমা করেও দিতে পারেন আমাদের।
স্যারে জ্ঞানসঙ্গ মুহুর্ত ছবিটা আমি বুকের পাজরে রাখতে চাই।


আনোয়ারুল ইসলাম অভি। কবি, সম্পাদক, পলল ডট কো ডট ইউকে। লন্ডন।

Advertisement