ধর্ষক বাবাকে দেখতেও কি প্রকৃত বাবার মতই!

:: সুরমা রহমান ::
“একটা মেয়ে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে তার বাবাকে। কারণ সে জানে, দুনিয়ার সব ছেলে তার সাথে বেঈমানী/ বিশ্বাসঘাতকতা করলেও তার বাবা কখনো তার সাথে এমনটি করবে না”। “প্রতিটি বাবার কাছে তার মেয়ে একটা রাজকন্যা”। বাবা মেয়েকে নিয়ে এমন মধুর আরো অনেক কথা প্রচলিত আছে।

একটা মেয়ের চরম বিশ্বাস, অগাধ ভালবাসা, অসীম আস্থার জায়গা হচ্ছে তার বাবার কোল এবং বুক। এত দিন সেটাই জানতাম। কিন্তু বাবা নামক মানুষরোপী ঐ অমানুষগুলো যখনই ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে, স্বজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে তারই নিজের মেয়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তখন কি আর ঐ মধুর বাণীগুলো প্রচলিত থাকে? আস্থা থাকে ঐ বাণীগুলোর প্রতি। একটা মেয়ে কি তার জীবদ্দসায় কখনো চিন্তা করে তারই জন্মদাতা, তার জীবনের প্রথম হিরো, তার চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষটি তার সাথে এমন আচরণ করবে? এটা আসলেই বিরাট এক প্রশ্নবোধক এবং আশ্চর্যবোধক প্রশ্ন পৃথিবীতে। মেয়েকে বাবা ধর্ষণ/খুন করছে? এ আবার হয় নাকি? মেয়েরা হলো বাবার রাজকন্যা, রাজকন্যার ক্ষতি কি স্বয়ং কোন রাজা করতে পারে?

হ্যা, করছে তো! হচ্ছে তো এখন এমন। বিবেক আজ মরে ভূত হয়ে সর্ষে বিক্রি করছে। আর তাইতো হিসাবটা চলে গেছে লাভ ক্ষতির মামলায়। আজ কিছু সংখ্যক বাবা মেয়েকে খুন করতে পারে নিজের স্বার্থের জন্য। নিজের মেয়েকে পণ্য করে বিক্রি করে দিতে পারে তারই মত কিছু কুলাঙ্গারের কাছে। জুয়ার আসরে বসে বাজি ধরতে পারে নিজের মেয়েকে নিয়ে। আজ বাবা মেয়ে সম্পর্কের চেয়ে বড় সম্পর্ক হল মানুষ আর স্বার্থের। স্বার্থের কারণে মানুষ ভুলে যায় তার অস্তিত্ব এমনকি নিজের সন্তানকেও। প্রতিটা সম্পর্কই যেন স্বার্থের মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তাই তো বিউটির বাবা অন্য লোকের প্ররোচনায় একবারের জন্যও দ্বিধা করেনি চোখের সামনে ভাড়াটিয়া খুনি দ্বারা নিজের মেয়েকে খুন করতে, আর সে দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে তা অবলোকন করতে (পুলিশের ভাষ্যমতে)। অন্যের প্ররোচনায়, অন্যের স্বার্থের জন্য নিজের মেয়ের বলিদান! বাবুল ধর্ষণ করেছে বিউটিকে আর তার বাবা বাবুলকে ফাঁসানোর জন্য বিউটিকে খুন করেছে, হোক নিজে কিংবা অন্যকে দিয়ে। খুনে তো তার সম্মতি আছে (পুলিশের ভাষ্যমতে)। তবে, আছে কি, বাবুল আর বিউটির বাবার মাঝে কোন তফাত? বিউটির চোখে তো বাবুল আর তার বাবা সমান অপরাধী।

ঘটনা কি শুধু একটা? লাখো বিউটি ঝরে যাচ্ছে এভাবে। কক্সবাজার সদরের পিএমখালী ইউনিয়নের কাঠালিয়ামুড়া এলাকায় নিজের ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে দিনের পর দিন ধারাবাহিকভাবে ধর্ষণ করে এক গুণধর পিতৃদেব। ২০১৭ সালের মার্চে সংঘঠিত এ ঘটনায় গর্ভবতী হয়ে সম্প্রতি ওই মেয়ে একটি বাচ্চাও প্রসব করে। ১৩ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ? তাও নিজের বাবা?

থাকবে তো পৃথিবীতে বাবা মেয়ের সম্পর্কটা অটুট! থাকলেও আর কত দিন? এসব অসুস্থ পাষণ্ড শয়তান বাবারা টিকে থাকতে দিবে তো আসল হিরো বাবাদের তাদের সম্মান টুকু বাঁচাতে নিজের মেয়ের কাছে! নাকি সে বাবারাও ভয় পাবে মেয়ের চোখে চোখ রাখতে, মেয়ের মাথায় রাখতে! এ সমস্ত বাবাদের বাবা না বলে এদের খুনি, ধর্ষক বলেই ডাকুন। এদের বাবা ডাকলে তো আমাদের যে বাবারা আছেন এখনো তাদের মেয়েদের স্বপ্ন দেখান, এখনো যে বাবা তার মেয়েকে নিজের রাজকন্যা করে রেখেছেন, যে কন্যার স্বপ্ন পূর্ণ করতে সূর্য উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষণ নিজেকে সঁপে দিয়েছেন কাজের কাছে সে মহান বাবাদের ছোট করা হবে। ধর্ষক কে ধর্ষক, খুনিকে খুনি বলতে আবার লজ্জ্বা কি? এদেরকে তাদের নিজস্ব পরিচয়েই ডাকুন।

American publisher and philanthropist, Irvin J. Borowsky র মতে, “Childhood environments that are physically violent, emotionally unsupportive and characterized by competition for scarce resources have been associated with sexual violence”.

সুতরাং, ধর্ষণ চিন্তাভাবনা একটা মানুষের মাথায় একদিনে আসে না। এটা একটা প্রক্রিয়ায় চলে। একটি শিশু কিংবা কিশোর যখন তার পরিবারের ক্রমাগত ঝগড়া-বিবাধ হতে দেখে, কিংবা পরিবারের বড়রা যখন ক্রমাগত অন্যদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ করতে থাকেন, নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে নিজেদের আত্মিক সম্পর্কের দূরত্ব বজায় রাখেন এবং উপযুক্ত শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হন তখনই ছেলেরা ছোট ছোট অপরাধ করতে করতে ধর্ষণ এবং খুনের মত জঘন্য অপরাধগুলো করতেও একদিন পিছপা হয় না। ওরা যখন দেখতে পায় ওদের চোখের সামনে ধর্ষণ হচ্ছে, খুন হচ্ছে। ধর্ষক/খুনিরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরছে, তখন তো এটা ভাবা স্বাভাবিক, এসব করা কোন ব্যাপার না বা অপরাধ না। ভয় হয়, ধর্ষণ যে একটা জঘন্য অপরাধ এ কথাটা না একদিন সমাজ থেকে উঠে যায়।

আসুন, আমরা আমাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দেই, মানুষকে সম্মান করতে শিখাই, তাদের প্রতিটা চিন্তাকে মূল্যায়ন করি, ভালকে ভাল বলতে, খারাপকে খারাপ বলতে শেখাই। তাদের সামনে ধর্ষক/খুনিদের এমন শাস্তি দেই যেন ধর্ষক তার এই কালো দিনটাকে কোনদিন না ভুলে। আর যে শিশু, কিশোরগুলো বেড়ে উঠছে আগামীকাল সমাজ চালাবে বলে তাদের জানাই, ধর্ষণ একটা সামাজিক ব্যাধি, এটা শুধু জঘন্য অপরাধই নয় বরং ক্ষমার অযোগ্য একটা অপরাধ। এদের ঘৃণা করতে শিখাই ধর্ষককে এবং ধর্ষণকে। এদের শিখাই মেয়েদের কিভাবে সম্মান করতে হয়, মেয়েদের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে কিভাবে সম্মান করতে হয়। সেই সাথে এটাও বলতে শিখাই, ধর্ষক আর যাই হোক, কারো বন্ধু, ভাই, ছেলে, স্বামী হতে পারে না। আর বাবার মত পবিত্র, এত দামি একটা ডাক শোনার মত তো তাদের কোন যোগ্যতাই নেই। এমনকি ধর্ষকরা সমাজের কোন অংশ হতে পারে না। ধর্ষকদের জায়গা কেবলই ওপারে কিংবা জেলে কিংবা জঙ্গলে।

Advertisement