ধর্ষক হত্যার ফাঁদের গভীরে…

হেলাল মহিউদ্দীন

২০০৪ সালে ভারতের নাগপুরে জনাকীর্ণ আদালত চত্বরে ২০০ নারী আক্কু যাদবকে হত্যা করেন। তাঁরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন মরিচের গুঁড়া ও সবজি কাটার ছুরি। মুহূর্তেই এক নারী তাঁর পুরুষাঙ্গ কর্তন করেন। তিন-চার মিনিটে ৭০টি ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত আক্কু মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে ধরাধাম ত্যাগ করেন। তাঁকে হত্যা করে নারীরা মুহূর্তেই স্লোগান দেন, ‘আমাদের ২০০ জনকেই গ্রেপ্তার করা হোক’। মামলা হয়। কিন্তু জনমত ওই নারীদের পক্ষে। উকিলরা পক্ষে দাঁড়িয়ে বললেন, নারীদের আদালতি পরিচিতি হবে ‘অপরাধী’ নয়, ‘অপরাধের শিকার’। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক কেবল সমর্থনই দিলেন না, নারীদের প্রকাশ্য অভিনন্দন জানালেন।

আক্কু যাদব ছিলেন ধর্ষক ও নির্যাতক। বস্তিতে মাস্তানি ও চাঁদাবাজির জন্য ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, পিতার সামনে কন্যাকে নির্যাতনের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখতেন।

২০০৪ সালের ঘটনায় ভারতজুড়ে নানা বক্তব্য, মতামত ও বিতর্ক কয়েকটি অনুসিদ্ধান্তের জন্ম দেয়। যেমন: এক. আইন ব্যর্থ হলে মানুষ আইন হাতে তুলে নেবেই (জনবাদী ভাষ্য); দুই. মব জাস্টিস বা গণপিটুনিও অনেক সময় দরকার, বিশেষ করে যখন ন্যায়বিচার পেতে গেলেও বছরের পর বছর লেগে যায় (উপযোগবাদী গণমনস্তত্ত্ব); তিন. ধর্ষক ভয় দেখানোর ও দমনের অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণকে ব্যবহার করে; ধর্ষণ একধরনের রাজনীতি (নারীবাদী ও একাডেমিক ভাষ্য); চার. ভারতীয় সিনেমা, নারীদের কামোদ্দীপক পোশাক, ধর্মকর্ম থেকে দূরে সরে যাওয়া, ইন্টারনেট ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে না নিলে গণশাস্তি সমস্যার সমাধান নয় (রক্ষণশীল নৈতিকতাবাদী ভাষ্য), পাঁচ. নারীদের মরিচের গুঁড়াকে অস্ত্ররূপে ব্যবহারের আইডিয়া এসেছে ‘মিরিচ মসালা’ নামের একটি সিনেমা থেকে; পুরুষাঙ্গ কর্তনের আইডিয়াও মহেশ ভাটের পুরোনো একটি সিনেমায় শাবানা আজমির প্রতিশোধী চরিত্র থেকো নেওয়া এবং ছয়. ঘটনাটি আরও কিছু গল্প-উপন্যাস আর সিনেমার ফ্যান্টাসির রসদ জোগানো ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয়নি (নৈরাশ্যবাদী ভাষ্য)।

২০১৪ সালে আদালত হত্যাকাণ্ডে জড়িত নারীদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ খারিজ করে দেন। অপরাধবিজ্ঞানী ও আইন বিশ্লেষকেরা সংগত কারণেই আদালতের এই গণমনোরঞ্জক (পপুলিস্ট) রায় পছন্দ করেননি। এই মহলের বক্তব্য ছিল মানুষ হত্যা যেহেতু হত্যাই, কিছুটা প্রতীকী শাস্তি অন্তত দেওয়া যেত! না হলে ‘কপিক্যাট সিনড্রোম’ অর্থাৎ অনুরূপ ঘটনা বাড়বে। কারণ, এভাবে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাতে দুই শর জায়গায় দুই হাজার, তারপর চার হাজার মানুষ যুক্ত হবে। পুরো সমাজব্যবস্থার হাজারো অসংগতিতে জনগণের মধ্যে বিচিত্র কারণে বিভিন্ন বিষয়ে জমে থাকা ক্ষোভ সুযোগ পেলে এক জায়গায় জড়ো হবে, মুখিয়ে থাকবে নির্বিচার গণপিটুনির জন্য। পকেটমার, ছিঁচকে চোর বা সিঁধেল চোরও গণপিটুনির শিকার হতে পারে। ‘মব জাস্টিস’ নৃশংস হয় এবং এটিও একধরনের মানসিক ধর্ষকামিতার প্রকাশ। বিপজ্জনক বিষয় এই যে এক ধর্ষকামিতা ঠেকাতে গিয়ে আরেক ধর্ষকামিতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। গুজব ছড়িয়ে, লিঞ্চিং করিয়ে কেউ জমিজমা দখল বা হিংসা বাস্তবায়নের ফন্দি আঁটতে পারে। ২০০২ সালে গুজরাটের গোধরায় যে নির্বিচার মুসলমান হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছিল, তার পেছনের গুজব ও রাজনীতির কূটচালের উদাহরণটিও বারবার উঠে আসে ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের আলোচনায়।

এসব আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা প্রমাণিত হলো ২০১৫ সালে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার মানুষের হাতে ফরিদ খানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং চার হাজার মুসলমানের প্রাণভয়ে নাগাল্যান্ড ত্যাগের মাধ্যমে।

গণহিংসার আপদ-বিপদ
২০১৫ সালের ৫ মার্চ ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ফরিদ খানকে জেলখানা থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে উন্মত্ত জনতা। তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে পাথর ছুড়ে, প্রহার করে ও টেনেহিঁচড়ে সাত কিলোমিটার দূরের একটি ক্লক টাওয়ারের ওপর নিয়ে গলায় রশিসমেত রেলিংয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় জনগণের প্রদর্শনের জন্য। এই বীভৎস উল্লাস যে শিশু, নারী, হৃদ্‌রোগ ও দুর্বলচিত্তের মানুষের ওপর কী ভয়াবহ প্রভাব তৈরি করতে পারে, উন্মত্ত জনতা তা বিবেচনায়ও আনার চেষ্টা করেনি।

এক তরুণী পুলিশের কাছে গিয়ে মামলা করেছিলেন যে মাতাল ফরিদ খান তাঁকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক মাতাল করে সবান্ধব ধর্ষণ করেছেন এবং পাঁচ হাজার রুপি হাতে দিয়ে চুপ থাকার হুমকি দিয়েছেন। ফরিদ খানের পরিবার অভিযোগ অস্বীকার করল। জানাল, অভিযোগকারী তাদের পরিচিত, ফরিদ খানের স্ত্রীর সঙ্গে সখ্যও আছে। তরুণী ফরিদ খানকে হোটেলে ডেকে নিয়ে জিম্মি করে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিলেন। অন্যথায় তাঁকে ধর্ষকের দায়ে ফাঁসানোর হুমকি দেন। ফরিদ খানের দুই ভাই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরিরত। তাঁদের বাবাও অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনা, দেশপ্রেমিক এবং আইন মেনে চলা পরিবার। মেডিকেল প্রতিবেদনেও ধর্ষণের আলামত মেলেনি।

হয়তো পরিবারের ভাষ্যও বিশ্বাসযোগ্য নয়! হয়তো ফরিদ খান ধর্ষণ করেও থাকতে পারেন। মেডিকেল প্রতিবেদনেও ভুল হয়। সবকিছুই তখন আদালতের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের এখতিয়ারে। সেসব বিবেচনা ছাপিয়ে তবু গণরোষ, ক্ষোভ, ঘৃণা, হতাশা—সবকিছু ফরিদ খানের ওপর পড়ল অনেক কারণে।

২০১২ সালে ভারতে ধর্ষণজনিত অপরাধ মহামারির রূপ নেয়। বিশ্ব মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হয় দিল্লিতে ২৩ বছর বয়সী এক কলেজছাত্রীর বাসে গণধর্ষণের ঘটনা। ছয়জন ধর্ষকের একজন জেলে আত্মহত্যা করেন। মুকেশ সিং নামের একজন ধর্ষক বিবিসির প্রযোজনায় একটি ডকুমেন্টারিতে সাক্ষাৎকার দেন। লেসলি উডুইন পরিচালিত ‘ইন্ডিয়াস ডটার’ নামের ছবিটি ৮ মার্চ নারী দিবসে ভারতের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাতে গণ-অসন্তোষ তৈরির উপাদান আছে মনে করে আদালত ছবিটির প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তাতে নারীবাদীরাসহ ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও সাংবাদিকসমাজও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ছবিটি ভারতের বাইরে প্রদর্শিত হয় এবং ইউটিউবে ভাইরাল হয়ে ওঠে। কোর্টের হস্তক্ষেপে জনতা তেতে ওঠে। তখনই ক্ষোভের আগুন নামাতে শিখণ্ডী মিলে গেল। নাম ফরিদ খান।

আগুনে ঘৃতাহুতির মতো গুজব ছড়ানো হলো যে ফরিদ খান অস্থানীয় এবং অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি। আসলে তাঁর কয়েক পুরুষ আসামের নাগরিক-বাসিন্দা, বাংলাদেশি নয়। সেই সময় বিজেপির ইন্ধনে ‘অবৈধ বহিরাগত খেদাও’ নামে ‘মুসলিম খেদাও’ আন্দোলন সবল হচ্ছিল। ফরিদ খান মুসলমান হওয়ায় সেই পালে দ্রুত ঝড়ের হাওয়া লাগল। আদালত, প্রশাসন—কেউই হয়তো বুঝতে পারেনি অকস্মাৎ নারীবাদী, প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল সবাই বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খাওয়ার মতো একই রাস্তায় নামবে। সুচিন্তার মানুষেরা যখন বুঝতে পারল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। একটি ভয়াবহ অমানবিকতার গা শিউরে ওঠা বীভৎস প্রদর্শনী দেখে বিশ্ববাসী হতভম্ব হয়েছে। দাঙ্গা ও হত্যার ভয়ে চার হাজার মুসলমান নাগাল্যান্ড ছেড়েছে।

নির্বিচার শাস্তি অপরাধ কমায় না
প্রশ্ন হচ্ছে, উন্মত্ত গণবিচারে শাস্তির প্রদর্শনীর পর ভারতে ধর্ষণ কি কমেছে? না, উত্তরোত্তর বাড়ছে। ধর্ষণের গড় বার্ষিক বৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ধর্ষণ ভারতের অপরাধের তালিকায় চতুর্থতম। বলা হয়, ভারতে ধর্ষণ যা হয়, তার ছিটেফোঁটা মাত্র রিপোর্ট হয়। পুলিশ অপরাধটি কমিয়ে দেখানোর জন্য ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মামলা নথিভুক্তই করে না। তবু ২০১৫ সালে সাড়ে ৩৪ হাজার এবং ২০১৬ সালে সাড়ে ৩৮ হাজার ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। ২০১২ সালে সংখ্যাটি ছিল সাড়ে ২৪ হাজার। সংখ্যা কমিয়ে দেখনোর জন্যই সম্ভবত গত বছর আদালত ‘বিবাহাধীন ধর্ষণ’ (ম্যারিটাল রেপ) ‘ধর্ষণ’ নয় ঘোষণা দিয়েছেন। ধর্ষকের পক্ষও নিচ্ছেন ভারতের রাজনীতিকেরা। ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি জম্মু ও কাশ্মীরে আট বছর বয়সী শিশু আসিফাকে আটজন মিলে ধর্ষণের পর হত্যা করে। আন্দোলন শুরু হলে ধর্ষণকারীদের সমর্থনেও আন্দোলন দাঁড়িয়ে যায়। দুজন মন্ত্রী সেগুলোয় অংশও নেন।

বাংলাদেশে বছরে ১০ শতাংশ (৯ দশমিক ৮ শতাংশ) হারে ধর্ষণ বৃদ্ধি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। শিশু ধর্ষণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। শিশু অধিকার ফোরাম গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩২৫টি শিশু ধর্ষণ নথিভুক্ত করেছে। এদিকে ‘আমি ধর্ষক’ লেবেল বুকে ঝুলিয়ে দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নতুন একটু ধারা তৈরি হতে চলেছে। বিচারবহির্ভূত সব হত্যাকাণ্ড হত্যাকাণ্ডই। এই পদ্ধতিও ধর্ষকামী পদ্ধতি। প্রতিশোধ গ্রহণ অপরাধ, বিচারকার্য নয়। বিচারব্যবস্থায় অসংখ্য গলদ এবং ফুটো আছে নিশ্চিত, কিন্তু ধর্ষক হত্যাকাণ্ডে সম্মতি দেওয়ার অর্থ যে কারও হত্যাকাণ্ডেই সম্মতি দেওয়া। যেকোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে শত্রুতাবশত হত্যা করে ‘আমি ধর্ষক’ লেবেল ঝুলিয়ে হত্যাকারী পগার পার হয়ে যাবে। এমন সুযোগ তৈরি করে দিয়ে নিজেদের আরও বিপদে ফেলার ফাঁদে বাংলাদেশের কেউ আর না পড়ুক।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।

Advertisement