নিপাখি হয়ে বাঁচবে তুমি মানুষ?

ফারুক ওয়াসিফ :: যুদ্ধদিনে মানুষের মৃত্যু সহজ ও সওয়া হয়ে যায়। কোনো যুদ্ধ চলছে না দেশে, তবু শত মানুষ পুড়ে কিংবা হাজার মানুষ ভবনধসে মারা যাচ্ছে। লাগাতার। ঘটনার ধাক্কায় চেতনা অবশ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আর মানুষ আমরা, সৃষ্টির সেরা জীব আমরা ‘মান-উষ, মান-উষ’ করে মুখটা সরু করে ফেলেছি। আর মনটাকে পাথর। কয়েক দিনের ঝড়ে নড়াইলের হাজারো পাখি মারা গেল। শিলাবৃষ্টি ধান, ফল ও পাখিদের মস্ত বড় এক ঘাতক। গত কালবৈশাখীতে মেঘনায় দেখেছি, কীভাবে কালো পানকৌড়িরা শিলাবৃষ্টি থেকে বাঁচতে প্রাণপণ পাখা ঝাপটাচ্ছে। তারপর কোনো একটা শিলা হয়তো মাথায় বা ডানায় লাগল, পাখিটা টুপ করে ডুবে গেল পানিতে। পাখিদের মৃত্যুতে কারবারি মানুষের কী আসে–যায়?

নড়াইলের এক পর্যটনকেন্দ্রের ৩০ হাজার পাখির মৃত্যুর ঘটনাকে শোকপ্রকাশের কোন তালিকায় রাখব; বুঝতে পারছি না। আজ সকালের আকাশে ওড়া পাখিরা কি জানে, পাখিদের জগতে খুব বড় সর্বনাশ ঘটে গেছে? আর এর জন্য দায়ী মানুষের লোভের শিকার জলবায়ু ও তার পরিবর্তন। মানুষ কি জানে, প্রকৃতির শিশু এই পাখিদের মৃত্যু আসলে আরও বড় বিপদেরই পূর্বাভাস? মানুষ কি জানে, সরলতার, প্রেম–প্রকৃতি–ভালোবাসার, বিশ্বাসের মৃত্যু ঘটিয়ে ঘটিয়ে আমরাও একদিন শেষ হয়ে যাব? পড়ে থাকবে ছেঁড়া পালক আর রক্তাক্ত দেহ; হোক তা মানুষের কিংবা পাখির? কবি জীবনানন্দ দাশ নক্ষত্রের মৃত্যুতে ব্যথা পেতেন মনে, আমার কেন যে পাখিদের মৃত্যু মনে দুঃখের ঘাই জাগাচ্ছে। আজ আবার দুঃখতোয়া বৃষ্টিও ঝরেছে রাতভোর।

২০১৫ সালের কালবৈশাখীর রাতেও আচানক মরে গিয়েছিল ৩০ জন মানুষ আর ২৫ হাজার পাখি। সেসব গরিব আর পাখিরা যেন একই, অপঘাতে মারা না গেলে যারা খবর হয় না। কুষ্টিয়ার এক গ্রামেই পাওয়া গেছে ২৫ হাজার পাখির লাশ। চুয়াডাঙ্গার গ্রামের বন-জঙ্গলের মাটিতে স্তূপের মতো পড়ে ছিল মৃত পাখিরা। লেবানিজ কবি কাহলিল জিবরান বলেন, ‘বিদায়ের সময়ই মানুষ বুঝতে পারে তার প্রকৃত ভালোবাসা।’ এত পাখির মৃত্যু দেখে মনে কি জাগে না এই কথা যে, ওরা আমাদের কে ছিল?

আমাদের মনেও কি ডানা ঝাপটায় না কোনো পাখি? পাখি হলো প্রকৃতির শিশু। শিশুদের দেখলে মনে যেমন মায়া উথলে ওঠে, মানুষের শিশুরা যেমন নিষ্পাপ সারল্যের অনুভূতি জাগায়, প্রায় সে রকমই লাগে পাখিদের দেখে। মানুষ কাছে গেলে নাকি প্রকৃত সারস উড়ে যায়, কিন্তু প্রকৃত সরল-শুদ্ধ মানুষের কাছে উড়ে আসে পাখি—লোকমুখে শোনা যায় সেই গল্প। শিল্পী সুলতান, লেখক আহমদ ছফার সঙ্গে পাখি থাকত। সোলেমান নবী নাকি পাখিদের ভাষা বুঝতেন। এক ঘরহারা–বিবাগী লোককে চিনি, যে ভাবে সবাই চলে গেলেও পাখিরাই তাকে দেখে রাখবে।

একসময় তো সেটাই রাখত। আদিম সময়ে মানুষ ও পশুপাখি অনেক কাছাকাছি ছিল। এখনো গেরস্থ কৃষকের সংসারে পশুপাখি ও শিশুরা একসঙ্গে খেলা করে। শিশুদের সঙ্গে পাখিদের এই সম্পর্ক, পাখির প্রতি শিশুদের যে উচ্ছল আদর, তাতেই তো প্রমাণ, পাখি আর শিশুরা আসলে একই! ওরা আমাদের এমন কিছু দেয়, যা আমরা শৈশবে রেখে এসেছি বলে কষ্ট পাই। বড় হওয়া মানে সারল্য হারাতে থাকা, পাখি-স্বভাব ভুলতে বসা, জীবন-জগতের প্রতি মুগ্ধতা হারানো, চোখের মায়াঞ্জন খুইয়ে ফেলা নিলাজ দৃষ্টি। শরীরের যেমন পুষ্টি প্রয়োজন, মনের মহল্লায় পাখির ছায়া তো তেমনি এক পুষ্টি।

এ কারণেই হয়তো, নড়াইল, কুষ্টিয়া বা চুয়াডাঙ্গার মানুষেরা পাখির মৃত্যুতে দুঃখ পায়। এদের অনেকেরই পাখির মতো সংসার‍। সম্পত্তি নেই, নেই কোনো সঞ্চয়, দিন এনে দিন খেতে হয় পাখিদের মতো করেই। পাখিরা যেমন লতাপাতা-খড়কুটোয় ঘর বানায়, এরাও তেমনি প্রকৃতির দান দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকে। গাছের ওপর পাখির মামুলি বাসা আর মাটির ওপর বেড়ার ঘর ঝড়ের রাতে একসঙ্গেই তছনছ হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাই সামাজিকও বটে। সমাজে যারা গরিব ও বঞ্চিত, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে তারাই বেশি অরক্ষিত। পাখিরা যেমন প্রকৃতির মধ্যে দুর্বলতম প্রাণের অংশ; সমাজের মধ্যে এসব মানুষও তেমনি। পাখির জন্য শোকে তাই সেসব বঞ্চিত মানুষের প্রতি বেদনাও মিশে থাকে। থাকা উচিত।

মুক্তি ও শান্তির প্রতীক হলো পাখি। দেশটা সুখে নেই, মানুষ কতটা মুক্ত তা–ও সত্য করে বলতে সাহস লাগে। এ রকম সময়ে হাজার হাজার পাখির মৃত্যু বিপন্নতারও প্রতীক। লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ের বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানোর বলা ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। গল্পটা অনুবাদ করে দিচ্ছি:

উরুগুয়ের রাজনৈতিক বন্দীদের অনুমতি ছাড়া কথা বলা, শিস দেওয়া, হাসা, তাড়াতাড়ি হাঁটা অথবা একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানানো বারণ। এমনকি প্রসূতি নারী, প্রেমিক জুটি, প্রজাপতি, নক্ষত্র ও পাখি আঁকা কিংবা সেসবের ছবি উপহার পাওয়াও ছিল নিষিদ্ধ। এক রোববার, ‘আদর্শবাদী হওয়ার’ দায়ে বন্দী ও নির্যাতিত স্কুলশিক্ষক দিদাসকো পেরেজের কাছে তাঁর পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে মাইলা দেখা করতে এল। বাবার জন্য সে পাখির ছবি এঁকে এনেছিল। জেলের দরজাতেই রক্ষীরা ছবিগুলো নষ্ট করে দেয়।

পরের রোববার মেয়েটি আবারও আসে। এবার মাইলা এনেছে তার আঁকা গাছের ছবি। তো গাছ যেহেতু নিষিদ্ধ না, সেহেতু ছবিগুলো কারাগারে ঢুকতে পারল। দিদাসকো মেয়ের আঁকার খুবই তারিফ করে জানতে চাইল, ‘তোমার গাছের পাতার ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি দেওয়া ছোট ছোট রঙিন গোল্লাগুলো কী, মা? এগুলো কি কমলালেবু? কী ফল এগুলো?’

মেয়ে তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে ‘হিশশশশ! ’ তারপর বাপের কানে ফিসফিস করে বলে: বোকা তুমি! দেখছ না এগুলো হলো চোখ? ওগুলো তোমার কাছে লুকিয়ে পাঠানো আমার পাখিদের চোখ।’ (Eduardo Galeano, Memory of Fire III, The Century of the Wind, 1988)

ছোটবেলায় আমারও একটি পাখির ছানা মরে গিয়েছিল ঝড়ে। ভাইবোনেরা মিলে তাকে কবর দিয়ে ফুল ছিটাতে ছিটাতে কেঁদেছিলাম। সেই ছোট পাখিটা আমাকে বলে গেছে, ‘মানুষ শুধু রক্ত-মাংস দিয়েই তৈরি নয়, মানুষ মায়া দিয়েও তৈরি।’

ঝড়ে, নদীতে ডুবে, বাস উল্টে আর আগুন ও গুলিতে যে মানুষগুলো মরে গেল, তাদের ভেতরেও মায়া ছিল! মানুষ বড় নিপাখি হয়ে গেল! মানুষ বড় কঠিন হয়ে গেল!

Advertisement