পদকের রাজনীতি: পলিটিকস ন’করিবা বন্ধু

গওহার নঈম ওয়ারা :: ‘আমরা খুব খুশি আমাদের নড়াইলের জামাই ভারতরত্ন হয়েছেন’, নড়াইলের ভদ্রাবিলা গ্রামের ঘোষদের মেয়ে শুভ্রার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির। সেই সুবাদে ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানের ভাগিদার আমরাও। নড়াইলের এক বন্ধু এভাবেই তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন মোবাইলে।

এবারও প্রথা অনুযায়ী ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে রাষ্ট্রীয় নানা তামঘা–পদক বিতরণ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ পদক ভারতরত্ন দেওয়া হয়েছে তিনজনকে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের নেতা পরলোকগত চন্দিকদাশ অমিত্র দেশমুখ ওরফে নানাজি দেশমুখ, পরলোকগত জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ভুপেন হাজারিকা আর সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে। মনোনীত তিনজনের মধ্যে একমাত্র প্রণব মুখার্জি জীবিত আছেন। বিজেপি ক্ষমতায় এলেই নানাভাবে নানাজিকে পদকে–খেতাবে ভূষিত করে থাকে। তাদের গুরুকে তারা সম্মান দেবে এই রাজনীতি বুঝতে ভুষি সেবনের দরকার পড়ে না। বাংলাদেশের জামাইবাবুকে ভারতরত্ন প্রদানের রাজনীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জনতা দলের (সেক্যুলার) মহাসচিব দানিশ আলি বলেছেন, কাগজে–কলমে একজন সেক্যুলার নেতা হয়ে তিনি এক সাম্প্রদায়িক সংগঠন আরএসএসের সদর দপ্তর নাগপুরে গেছেন, তাদের গার্ড অব অনার নিয়েছেন, আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বালিরাম হেডগেওয়ারকে ভূমিপুত্র বা সন অব সয়েল বলেছেন। বিনিময়ে তিনি ভারতরত্ন হয়েছেন। নানাজি দেশমুখের মনোনয়নের প্রতি ইঙ্গিত করে দানিশ আলি বলেছেন, ধর্মীয় নেতাদেরই যদি ভারতরত্ন দেওয়ার ছিল, তবে কর্ণাটকের সিদ্ধগঙ্গা মঠের সদ্য প্রয়াত শিবকুমার স্বামীকে কেন নয়? প্রায় ১১১ বছর বেঁচে এত কাজ করার পরেও এই চলমান ভগবান কেন বিবেচনা থেকে বাদ পড়লন, তার জবাব কর্ণাটকের মানুষ জানতে চায়। তাঁর মতে, প্রণবের চাইতে ভগবান শিবকুমার স্বামী অনেক বেশি উপযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো রাজনৈতিক ফায়দার সুযোগ ছিল না; তাই তিনি বাদ পড়েছেন।

কর্ণাটকের এক প্রবীণ নেতা লোকসভার সদস্য মাপান্না মালিকার্জুন খারগে সমালোচনার খড়্গ নিয়ে চড়াও হয়েছেন। তিনিও শিবকুমার স্বামীর পক্ষে জিগির তুলেছেন, তবে একটা মারাত্মক ভুল তিনি করে ফেলেছেন। তিনি মনোনীতদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গিয়ে গায়ককে এই খেতাব না দেওয়ার কথা বলে ফেলেছেন। এতে অবশ্য ভুপেন হাজারিকা নন; বরং রাজনীতিবিদদের সীমাবদ্ধতাই প্রকাশ পেয়েছে। বিজেপি কিন্তু রাজনীতির ঘুঁটি চালতেই ভুপেন হাজারিকাকে ভারতরত্নের বরমাল্য দিতে চেয়েছে। যেসব মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ভারতের মূলধারা থেকে পিছিয়ে রাখা আসামের মন জয় করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কৌশল বিজেপি নিয়েছে, তা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আসামের বাসিন্দাদের কাছে। শুধু আসাম নয়; বরং ওডিশাসহ পূর্ব ভারতের সবগুলো রাজ্য এখন রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। নরেন্দ্র মোদি চেষ্টা করছেন সেসব পথ আটকে দেওয়ার। অসমিয়া শিল্পী ভুপেন হাজারিকাকে ভারতরত্ন উপাধিদান তারই অংশ। এটা একধরনের রাজনীতির দাবা খেলা ‘পলিটিকস’। সেই ১৯৫৪ সালে চালু হওয়া ভারর্তরত্ন পদকে কখনো কোনো জীবিত অসমিয়ার নাম উচ্চারিত হয়নি। এবার নিয়ে মাত্র দুইবার আসামের কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হলো আর দুইবারে লোকসভা নির্বাচনের মুখে এমন ঘটনা ঘটল। এটা কি একান্তই কাকতালীয় না শুধুই পলিটিকস? আসামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী লোকপ্রিয় গোপীনাথ বারদুলাইয়ের মৃত্যুর প্রায় ৫০ বছর পর নির্বাচনের বছর ১৯৯৯ সালে তাঁকে ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বিজেপি তখন মধ্যবর্তী নির্বাচনের আঁচল ধরে ক্ষমতায় আসতে ব্যাকুল। ক্ষমতায় ফেরে তারা সঠিক সংখ্যা নিয়ে। এবারও তাদের সংখ্যা নিয়ে শঙ্কা আছে, তাই একটু ভুপেনচর্চার চেষ্টা । তাঁকে একটু সম্মান দেখিয়ে আসামে ভোটের বাজিমাত করার পুরোনো পলিটিকসে আবার মেতেছে বিজেপি। সেটা বুঝেই আসামের জনপ্রিয় গায়ক জুবিন গর্গে নতুন গান বেঁধেছেন,

‘পলিটিকস ন’করিবা বন্ধু / দুবেলা দুমুঠো ভাত খুঁটি খুঁটি খাও/তবু পলিটিকস ন’করিবা বন্ধু/
পরিবর্তন শব্দটি শুনিতে বড় ভাল… /পলিটিকস ন’করিবা বন্ধু ’ …

গানটি অসমে এবং বাইরেও অনেক জনপ্রিয় হয়েছে। এই জুবিন গর্গে গত বিধানসভার নির্বাচনে আসাম বিজেপি প্রধান সর্বানন্দকে নিয়ে, বিজেপিকে নিয়ে গানের পর গান গেয়েছেন। সে গানে মেতেছিল তরুণ যুব প্রবীণ। ‘আসামের আনন্দ সর্বানন্দ’ মুখে মুখে ফিরেছে, ভরিয়েছে ভোটের বাক্স। এখন সেই তিনিই বলছেন, পলিটিকস বুঝে গেছি, ভুপেন মামার (জুবিন ভুপেনের কাছের মানুষ ছিলেন, তাঁকে মামা ডাকতেন) প্রতি এত দরদ এত দিন কোথায় ছিল? ১০ বছর আগেই তাঁকে এই খেতাব দেওয়া যেত। সময়ের কাজ সময়ে না করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য ঝুলিয়ে রাখার চালাকি আমরা বুঝে গেছি।

ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী নবিন পট্টনায়ককে বশে রাখার চেষ্টায় নবিনের বোন গীতা মেহেতাকে পদ্মশ্রী পদকের জালে জড়াতে চেয়াছিল বিজেপি সরকার। সুলেখিকা গীতা বলেছিলেন, ভোটের আগে এসব পদক ভোটারদের কাছে ভুল বার্তা দিতে পারে, আমার ভাইয়ের ওপর এক অস্বস্তির চাপ আসতে পারে, তাই এবার মাফ চাচ্ছি বলে পদ্মশ্রী তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমাদের বিবেকের বালাই নেই বলে যে সেটা অন্য কারও থাকবে না তা কি হয়। পচা আমের ঝুড়িতে একটা–দুইটা ভালো আম রেখে আমওয়ালা ভালো সাজার চেষ্টা করলে ভালো আম চুপ থাকে। কারণ আম কথা বলতে পারে না। কিন্তু মানুষ তো আম নয়, তার জবান আছে। তাই তো গীতা মেহেতা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন আর জুবিন গর্গে গেয়ে ওঠেন ‘পলিটিকস ন’করিবা বন্ধু।

Advertisement