পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের ‘প্রশ্নোত্তর’ অনুষ্ঠান : সরকারের মেয়াদেই সিলেট বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক হবে

লন্ডন, ০৬ মে : বাংলাদেশে সবকিছু কিছুটা ধীর গতিতে চলে এই কথা অকপটে স্বীকার করে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, একটির পর একটি ইস্যুর কারণে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই এটি নিশ্চিত করা হবে। চালু হবে সিলেট-লন্ডন সরাসরি ফ্লাইট। রিফুয়েলিংয়ের কাজের পর এবার রানওয়ে সস্প্রসারণসহ অন্যান্য কাজের জন্য আরো তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব আয়োজিত ‘কোয়েশ্চন টাইম উইথ ফরেন মিনিস্টার’ অনুষ্ঠানে এ প্রতিশ্রুতি দেন। এছাড়া, গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচন, রোহিঙ্গা সঙ্কট, জেরুজালেমে আমেরিকার দূতাবাস স্থাপনের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে অবস্থান, বিদেশের বাংলাদেশ মিশন থেকে নাগরিকত্বের স্মার্ট কার্ড ইস্যু করা, হাইকমিশনের সেবার মানের উন্নয়ন, বিদেশে বড় হওয়া নতুন বাংলাদেশি প্রজন্মকে বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট করতে এবং?তাদের সেবা পেতে নেওয়া উদ্যোগ, তারেক রহমানকে ফিরিয়ে নেয়া ও বিরোধী দলবিহীন রাজনীতিসহ নানা ইস্যুতে সাংবাদিকদের বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় পর্বে বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিশেষ বক্তব্য উপস্থাপন করেন সিনিয়র দুই সাংবাদিক শামসুল আলম লিটন ও বুলবুল হাসান।

প্রেস ক্লাব সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ জুবায়েরের পরিচালনায় এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা: সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী।

অনুষ্ঠানে প্রেস ক্লাবের সাবেক ও বর্তমান নেতৃবৃন্দ, সম্পাদক ও সাংবাদিকরা মন্তব্য ও প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর প্রারম্ভিক বক্তব্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র দূরীকরণ ও মানুষের জীবনমান নিয়ে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিলো- সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার বার প্রতিশ্রুতির পরও সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক হয়নি কেনো? এজন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে সব কিছু ধীর গতিতে চলে। প্রথম দিকে তারা বললো, রিফুয়েলিং সিস্টেম দরকার। এটা করা হলো। এখন বলে আরো বড় রানওয়ে দরকার। এসবের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে কাজ শেষ হবে কবে তার দিনতারিখ নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে এই সরকারের মেয়াদের মধ্যেই ওসমানী বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক করে চালু হবে সিলেট-লন্ডন সরাসরি ফ্লাইট। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ভোটে অনিয়মের বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অস্বীকার করেন। মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে নানা ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে, ঘাটতি। সবকিছু একেবারে ‘পারফেক্ট’ বলা যাবে না। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-এক আসনের এমপি ড. মোমেন বলেন, ভোট কারচুপি হলে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী তো লাখের ওপর ভোট পেতেন না। আমি আমার এলাকার কথা বললাম। এছাড়া আশপাশের দেশে তো নির্বাচনে বড় ধরণের সংঘাত হয়। আমাদের তো তেমনটি হয়নি। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, বিরোধী দলের নির্বাচনী ব্যর্থতার বড় একটি কারণ হচ্ছে তাদের নেতৃত্বের দূর্বলতা। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যথার্থ ও কার্যকর বিরোধীদল দরকার বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রী।

দূতাবাস কিংবা হাইকমিশন থেকে প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্ট কার্ড) দেয়া সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের চিঠি লিখেছেন। বিষয়টি জটিল কোনকিছু নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনগুলো যদি পাসপোর্ট ইস্যু করতে পারে তাহলে স্মার্ট কার্ড ইস্যু করতে আমি তো কোন সমস্যা দেখি না। তবে মন্ত্রী জানান, তাঁর চিঠির জবাব তিনি এখনো পাননি। রোহিঙ্গা সঙ্কট প্রশ্নে চীনের সহযোগিতা ছাড়া মায়নমারের সাথে সমঝোতা কঠিন হবে মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মায়ানমার একটি কঠিন দেশ। তারাই এই সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। আর তারা চীন ছাড়া কথা বলে না। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণায় ট্রাম্পের সাথে বাংলাদেশ নেই- এ কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আমরা ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে। ব্রিটেনে বসবাসরত তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগের প্রসঙ্গে প্রশ্নে জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে সাজাপ্রাপ্ত যে কোনো আসামীকে আমরা ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর সাথে দেনদরবার করছি। সেটা তারেক রহমান বা মঈন উদ্দিন যে কেউ হতে পারে। বিদেশে বড় হওয়া নতুন বাংলাদেশি প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা প্রসঙ্গে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, লন্ডন হাই কমিশনে কানেকটিং?রুটস নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এছাড়া প্রবাসের নতুন প্রজন্মের সাথে সেতুবন্ধ রচনায় ৭৭টি হাইকমিশনকে ডাটাবেইস তৈরীর নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন বলে জানান। তবে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর কর্মীদের নিয়ে হতাশা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন। অনুষ্ঠানে দূতাবাসের সেবার মান নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই মন্তব্য করেন। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীন আচরণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ওপরে কাজ এসে পড়তে পারে এমন ভয়ে দূতাবাসের কর্মীরা টেলিফোন ধরেন না। তিনি বলেন, সরকারী অফিসগুলোতে এমন অবস্থা বিরাজমান। এমন মানসিকতার পরিবর্তন কীভাবে করা যায় তা নিয়ে তিনি চিন্তিত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অন্যান্য দেশের সরকারি অফিসে টেলিফোন বাজার সঙ্গে সঙ্গে কেউ না কেউ সেটি রিসিভ করেন। জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে সাহায্য করতে পারি। তারা সরাসরি সাহায্য করতে না পারলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে খবরটি পৌঁছে দেন। কিন্তু আমাদের সরকারী লোকেরা পাশে টেলিফোন বাজলেও ধরেন না। তাঁরা মনে করেন, টেলিফোন ধরলে কোনো কাজ এসে পড়বে। এই মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তৃতায়?বিলেতে বাংলা গণমাধ্যমের সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন ক্লাবের সভাপতি ও সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদক মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটির সংগঠনগুলোতে নানা বিভক্তি থাকলেও প্রেসক্লাব গত ২৫ বছর ধরে তার ঐক্য ও সম্প্রীতির ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে চলেছে। এ বছর ক্লাবের রজতজয়ন্তী উদযাপনে তিনি বাংলাদেশ সরকার ও বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করেন। অনুষ্ঠানে ‘বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা দিবস’ পর্বের আলোচনায় বিশিষ্ট সাংবাদিক শামসুল আলম লিটন ও বুলবুল হাসান উপস্থাপিত বিশেষ বক্তব্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিদ্যমান নানা প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করা হয়। পাশ্চাত্যসহ দক্ষিণ এশিয়ায় সাংবাদিকতার বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি তারা বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার ঝুঁকির কথাও উল্লেখ করেন। সামসুল আলম লিটন বলেন, গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যম যে কাজ করে তা আসলে তার নিজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র আর বাংলাদেশ সর্বত্র গণমাধ্যম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ওয়ার্? প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০ নম্বরে। বাংলাদেশ উত্তর কোরিয়া উগান্ডা আফগাস্তিান আর ইরাকের মতো দেশের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে যা দুর্ভাগ্যজনক। বুলবুল হাসান বলেন, একটা দেশের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন সেটা নির্ভর করে ঐ দেশের শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর; বাংলাদেশের গণমাধ্যম শাসক এলিট বা শাসকগোষ্ঠীর অনুগত প্রজার মত আচরণ করে চলেছে! প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেকটা জেহাদ ঘোষণা করেছেন, কিন্তু কিছু আমলা সাংবাদিকদের প্রায় প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে! ভয়ে অথবা বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে কিছু সাংবাদিক আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতাসীনদের স্তুুতি করতে ব্যস্ত। তাই গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরী করে দিতে হবে। বুলবুল হাসান বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আরো খর্ব হয়েছে- রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডার্স-এর এই মন্তব্য উল্লেখ করে প্রশ্ন রাখেন, আমাদের দেশের সংবিধান যেখানে এই স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দিতে বলেছে সেখানে রাষ্ট্র কেন বার বার ব্যর্থ হচ্ছে? ‘ওয়ার্? প্রেস ফ্রিডম ডে’-এর এ বছরের আন্তর্জাতিক থিম ‘মিডিয়া ফর ডেমোক্রেসি‘ নিয়ে এই উপস্থাপনা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোন প্রতিত্রিুয়া ব্যক্ত করেনি।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ডা: মোদাচ্ছের আলী লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবকে এমন আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এধরনের বিতর্কের দরকার আছে। সরকারকে যথার্থ ও গঠনমূলক প্রশ্নের জবাব দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে উত্থাপিত তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনে নিযুক্ত মিনিস্টার (প্রেস) আশিকুন নবী চৌধুরী। এইসব বিষয় যে তথ্য ও সূচকের ওপর ভিত্তি করে উপস্থাপন হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে দাবি করে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মিনিষ্টার (প্রেস) বলেন, তবে এর মানে এই নয় যে বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় কোনো সমস্যা নেই। এমনটি কেউ দাবীও করবে না। তবে অনেক তথ্য যথার্থ প্রমাণ ও গবেষণা ছাড়াই উদ্বৃত হয়। সামগ্রিক উন্নতির পাশাপাশি বাংলাদেশে সাংবাদিকতাও এগিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। এছাড়া তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের কল্যাণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুহিব চৌধুরী, সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ বেলাল আহমদ ও সৈয়দ নাহাস পাশা, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও সুরমার সাবেক সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাসন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুস সাত্তার, চ্যানেল এস-এর চেয়ারম্যান আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি, সাপ্তাহিক বাংলা পোস্ট সম্পাদক ব্যারিষ্টার তারেক চৌধুরী, সাপ্তাহিক দেশ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ, সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান পোলক, আহাদ চৌধুরী বাবু, নিলুফা হাসান, উর্মি মাজহার ও ডঃ জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার প্রমুখ। অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর পরিচিত পাঠ করেন প্রেস ক্লাবের নির্বাহী সদস্য নাজমুল হোসেন। শুরুতে ক্লাবের কমিটির নেতৃবৃন্দ ও নির্বাহী সদস্যরা অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানান এবং উপহার হিসেবে তাদের হাতে প্রেস ক্লাবের মনোগ্রামখচিত স্যুভেনির তুলে দেন।

Advertisement