প্রতীকদের আত্মহনন রোধ করব কীভাবে?

তাজুল ইসলাম :: শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র প্রতীকের আত্মহত্যা আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, এর মূল্যায়নপদ্ধতি, শিক্ষক নিয়োগ ও এর গুণগত মান এবং উচ্চশিক্ষায় স্বার্থান্বেষী চক্রের দৃশ্য-অদৃশ্য প্রভাব নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। আমি ২০১৭ সালের ১৫ মে প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় কলামে ‘পরীক্ষায় যারা ফেল করেছ বা করবে’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল করতে না পেরে হতাশ হয়ে যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তাদের জন্য। প্রতীকের এই হৃদয়বিদারক আত্মহননের পর বিষয়টির আরও গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি।

শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান ‘র‌্যাঙ্কিং বা গ্রেড’ পদ্ধতির এবং শুধু একাডেমিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কৃতিত্ব মাপার প্রচলিত ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে। অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ, চাকরিদাতা—সবার কাছে মেধা ও সফলতার একমাত্র মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে এই তথাকথিত আইকিউ বা একাডেমিক বুদ্ধিমত্তা।

কিন্তু আসলেই কি আমাদের রয়েছে কেবল একটি একক ও অনন্য বুদ্ধিমত্তা, নাকি আমরা ‘বহুমুখী বুদ্ধিমত্তা’ ও ধারার অধিকারী?

এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ উচ্চশিক্ষার বিদ্যায়তনে শিক্ষক নিয়োগ-প্রক্রিয়া, শিক্ষকদের গুণগত মান ও নৈতিক মান নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নব্বইয়ের দশকের পর থেকে সর্বত্র, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষালয়ে শিক্ষক নিয়োগ কী প্রক্রিয়ায় হয় তা এখন সবার কাছেই ‘ওপেন সিক্রেট’। ওই সব ‘বিশেষ বিবেচনা’ ছাড়াও মেধার যে স্কোর সেগুলো সুকৌশলে ‘পেয়ে দিতে’ বা কারও কাছ থেকে ‘কেড়ে নিতে’ একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী এককাট্টা হয়ে কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতীকের বেলায়ও তেমন আপত্তি উত্থাপন করছেন তাঁর স্বজনেরা। উচ্চশিক্ষায় যেখানে সব বিষয়ে ‘প্রশ্ন’ করার, বিতর্ক করার অবাধ অধিকার থাকার কথা, মেধা-মনন বিকাশে উন্মুক্ত চিন্তাধারাকে স্বাগত জানানোর কথা, জ্ঞান-মেধাকে যেখানে ‘ক্ষমতায়িত’ করার কথা, সেখানে এখন চলছে অন্ধ আনুগত্য, দলীয় বাছাইকরণ বা ছাঁটাইকরণ, গোষ্ঠীগত এমনকি অঞ্চলভিত্তিক পছন্দকরণের হিড়িক।

এ তো গেল মেধা মূল্যায়নে অসংগতি ও দুর্নীতির কথা। কিন্তু যদি সঠিকভাবে ও প্রচলিত পন্থায় মেধা যাচাই করা হয়, সেই ‘মাপ-পদ্ধতি’ও কতটুকু গ্রহণযোগ্য এবং যুগোপযোগী? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্ট্যানফোর্ড-বিনেটের আইকিউ টেস্ট আবিষ্কারের পর আমরা আইকিউ দিয়ে মেধা মাপার যুগে প্রবেশ করি। তবে বর্তমানে জানা গেছে, আইকিউ জীবন সফলতায় বড়জোর ২০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। বাকিটা নির্ভর করে অন্যান্য উপাদান, বিশেষ করে ‘আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স’-এর ওপর। সংক্ষেপে যাকে ‘ইকিউ’ বলা যায়। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কৃতী অধ্যাপক হাওয়ার্ড গার্ডনার প্রথম এই প্রথাগত আইকিউর ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, এটি বুদ্ধিমত্তা মাপার একটি সংকীর্ণ ধারণা। এটি ব্যক্তির দক্ষতা ও সক্ষমতার যে বিশাল ব্যাপ্তি রয়েছে, সেটিকে অস্বীকার করে। গার্ডনার বলেন, আইকিউ ১৬০ যাদের, তাদের অনেকেই আইকিউ ১০০ যাদের, তাদের অধীনে কাজ করে। বিল গেটস নিজে বলেছেন, তাঁর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করা অনেক বন্ধু তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।

হার্ভার্ডের শিক্ষার্থীদের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ আইকিউ যাদের, মধ্য বয়সে পৌঁছে তাদের বেতনের মান, উৎপাদনশীলতা ও কর্মস্থলে পজিশনে যারা নম্বর কম পেয়েছে, তাদের থেকে তেমন উচ্চে ছিল না। বস্তির ৪৫০ বালকের ওপর অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, যাদের আইকিউ ৮০-এর কাছাকাছি, পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে বেকার ছিল ৭ শতাংশ। অন্যদিকে যাদের আইকিউ ১০০-এর ওপরে ছিল, তাদের মধ্যেও বেকার ছিল ৭ শতাংশ (কোনো পার্থক্য নেই)।

উচ্চতর আইকিউ বা একাডেমিক বুদ্ধিমত্তা অধিক উন্নতি, সম্মান বা সুখী হওয়ার গ্যারান্টি না দিলেও আমরা অভিভাবকেরা, পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থীরা সবাই সেই সোনার হরিণের পেছনে ছুটছি—জিপিএ-৫ বা উন্নত গ্রেডের পেছনে। ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া না পাওয়া, সেখানে উচ্চতর গ্রেড পাওয়া না পাওয়াকে এ জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা এত গুরুত্ব দিয়ে দেখে থাকেন, কারও কারও জন্য যা ‘বাঁচা-মরা’ বা ‘মানসম্মানের ’ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। তখন অনেকেই সেই স্বপ্নভঙ্গ, আশাভঙ্গের মনোবেদনায় মুষড়ে পড়েন। কেউবা হতাশায়, আত্মগ্লানিতে বা অভিমানে আত্মহত্যার মতন চরম পথ বেছে নেন।

কিন্তু আমরা ভুলে যাই আইকিউ নয়, ইকিউ বা ‘আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা’ জীবন সফলতার মূল চাবিকাঠি। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে মানুষের বিশেষ চরিত্র বা একসেট গুণের সমষ্টি। গার্ডনার তাঁর প্রভাবশালী ফ্রেইমস অব মাইন্ড বইয়ে একক বুদ্ধিমত্তার পরিবর্তে সাতটি ধারা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। পরে উনি ও অন্যরা এটি ২০ ধরনের হতে পারে বলে দাবি করেন। গার্ডনার বলেন, ‘বুদ্ধিমত্তা কোনো ম্যাজিক্যাল সংখ্যায় (৭ সংখ্যা) আবদ্ধ থাকার বিষয় নয়।’

এসব বহুমুখী বুদ্ধিমত্তার অন্যতম হচ্ছে: ১. আন্তব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা (ইন্টার পারসোনাল ইন্টেলিজেন্স)—এটি হচ্ছে অন্যকে বুঝতে পারার সক্ষমতা। অন্যদের মেজাজ, উদ্দেশ্য বোঝা ও সে অনুযায়ী সাড়া দিতে পারা বা প্রয়োজনে তা ‘নাকচ’ করে দিতে পারা; গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও কমনসেন্স; নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা; সম্পর্ক লালনপালন করতে জানা ও বন্ধুত্ব ধরে রাখতে পারা; সম্পর্কজনিত দ্বন্দ্ব নিরসন করার সক্ষমতা ইত্যাদি।

২. সামাজিক বুদ্ধিমত্তা (সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স)—জীবন সফলতার জন্য ‘নিখুঁত সামাজিক মানচিত্র’ ধারণ ও অনুধাবন গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো সেই দক্ষতা, যা আপনাকে সমাজে ‘তারকা’ বানিয়ে দেবে। এর জন্য প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক প্রায়োগিক জনদক্ষতা। সামাজিক বুদ্ধিমত্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্যকে বোঝার ক্ষমতা এবং মানবীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিজ্ঞতার সঙ্গে আচরণ করতে পারা।

৩. ইন্ট্রা-পারসোনাল ইন্টেলিজেন্স—এটি হচ্ছে ‘সমন্বয়ধর্মী দক্ষতা’, নিজের সম্বন্ধে সঠিক ধারণা রাখা। নিজের প্রকৃত আবেগ, আচরণের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সক্ষমতা।

আমরা এমন শিক্ষাপদ্ধতি গ্রহণ করেছি, যেখানে কেউ খুব সফল হলে বড়জোর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবেন। আমাদের উচিত হবে বর্তমানের ‘র‌্যাঙ্কিং বা গ্রেড’ সিস্টেমের বদল করে শিক্ষার্থীদের নিজেদের সক্ষমতা, গুণাবলিকে শনাক্তে সহায়তা করে ও সেগুলোর যত্ন নেয় তেমন পদ্ধতির প্রবর্তন করা।

সফলতার রয়েছে শত শত পথ ও পন্থা এবং আমাদের প্রত্যেকের রয়েছে অনন্য ও অসীম সম্ভাবনা। প্রত্যেকেই এর যেকোনো একটি বেছে নিয়ে জীবনে সফল হতে পারেন। এর জন্য ভালো ফল করতেই হবে, বিশেষ পেশা বা চাকরি পেতেই হবে—এমন বাধ্যবাধকতা নেই। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার শত ফুল ফুটতে দিলে, জনদক্ষতা, সমাজদক্ষতা, আবেগীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারলে শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল না করতে পারার হতাশা, গ্লানি, অভিমান শিক্ষার্থীদের অতলে নিমজ্জিত করে দিতে পারবে না।

Advertisement