প্রবাসী নারী গৃহকর্মী, তাঁরা মানুষ এবং নারী, ক্রীতদাসী নন

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: আরবি ভাষায় মানুষকে বলা হয়েছে আশরাফুল মাখলুকাত—সৃষ্টির সেরা জীব। আমির হোক ফকির হোক মানুষের প্রথম ও প্রধান পরিচয় সে মানুষ। সামাজিক অবস্থান যার যা-ই হোক, মানবিক মর্যাদা প্রতিটি মানবসন্তানের প্রাপ্য। আধুনিক কালে বিশ্ব সংস্থা থেকে মানবাধিকারের যে ঘোষিত সনদ, তার চৌদ্দ শ বছর আগে ইসলাম ধর্ম মানুষের মানবিক মর্যাদার কথা ঘোষণা করেছে। শেষনিশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বমুহূর্তে মহানবী (সা.) তাঁর অনুসারীদের যে কথাটি বলেন তা হলো: ‘নামাজ সাবধান। দাসদাসী সাবধান, তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ কোরো না।’ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শেষ উপদেশ ও নির্দেশ প্রতিটি মুসলমানের অবশ্যপালনীয়।

মাটির নিচের তেলসম্পদে তকদির খুলে যাওয়ার আগে জাজিরাতুল আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মানুষের অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো ছিল না। তবে বহু আগে একসময় আরবদের মাথা ছিল। তাদের কবি, দার্শনিক, বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁরা দুনিয়ার মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। আজ আরবদের মাথা না থাকলেও খিলকার পকেটে টাকা আছে। সে জন্য ঘরে-বাইরে তাঁদের কাজের লোকের প্রয়োজন। হেরেমে তাঁদের বেগম সাহেবাদের শুধু নয়, তাঁদের
নিজেদের খেতমত করার জন্য দাসদাসী দরকার। বাংলাদেশের দরিদ্র নারীদেরও অনেকের কাজ করে টাকা রোজগার করা দরকার। তাঁরা দান-খয়রাত চান না। সে জন্য দেশে এবং বিদেশে তাঁরা কর্মসংস্থান চান। আরব দেশগুলোর বিত্তবানেরা বাংলাদেশ থেকে কর্মী/গৃহকর্মী নিতে আগ্রহী। বাংলাদেশের চাকরিপ্রত্যাশীরাও সেখানে যেতে ইচ্ছুক।

আরব দেশগুলোর আর্থসামাজিক অবস্থা ভালো রাখার স্বার্থেই বিদেশি শ্রমিকদের প্রয়োজন। বাংলাদেশের শ্রমিকেরাও সেখানে যাচ্ছেন। পুরুষদের সঙ্গে নারী শ্রমিকও রয়েছেন। আহামরি বেশি বেতন নয়, মোটামুটি ভালো বেতনের আশায় বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের অনেকে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে আগ্রহী। গত চার বছরে কয়েক লাখ নারী শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চাকরি নিয়ে গেছেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে গত মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশি নারী শ্রমিক সৌদি আরব গেছেন ১ লাখ ৯৪ হাজার ২০২ জন, জর্ডানে ৬৬ হাজার ৫৯৮ জন, ওমানে ৪১ হাজার ৭৫৫ জন, আরব আমিরাতে ৩৩ হাজার ২০৭ জন, কাতারে ১৮ হাজার ১০৪ জন এবং লেবাননে ১৩ হাজার ৩১১ জন।

বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৭ লাখ ২৪ হাজার ৬৩৬ জন। নারী শ্রমিকদের মধ্যে পোশাক কারখানায় কাজ পাচ্ছেন শুধু জর্ডান ও লেবাননে। সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশে প্রধানত তাঁরা গৃহকর্মী হিসেবেই কাজ করছেন। তবে বিশেষভাবে গৃহকর্মীদের পোড়া কপাল।

সৌদি আরবের নারীরা আগের মতো এখন আর মুখ বুজে স্বামীদের সব অপকর্ম সইতে রাজি নন। গতবার যখন বাংলাদেশ থেকে নতুন নারী শ্রমিকদের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, তখন পত্রিকায় পড়লাম সেখানকার বেগমেরা দাবি করেছেন মেয়েরা যেন বাংলাদেশ থেকে একা না যান। তাঁরা যেন তাঁদের স্বামীদের সঙ্গে নেন। তাঁদের এই দাবি ছিল খুবই অর্থবহ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তব কারণেই সেই দাবি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

গত কয়েক মাসে সৌদি আরব থেকে কয়েক শ নারী শ্রমিক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। বিমানবন্দরে এবং বাড়িতে ফিরে গিয়ে তাঁরা সাংবাদিকদের যে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন, তা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। মনে হয় আখেরি জামানায় দুনিয়া থেকে মনুষ্যত্ব বিলুপ্তির পথে।

বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন যাবৎই কথাবার্তা হচ্ছিল। নারী শ্রমিকদের অনেকে দেশে ফিরে আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন। কাগজে কিছু লেখালেখিও হয়েছে। কিন্তু বছর দুই যাবৎ পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। আরব দেশগুলোতে নারী গৃহকর্মীদের অসহায়ত্ব অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের তথ্য থেকে জানা যায়, গত বছর শুধু সৌদি আরব ও ওমানের সেফ হোম আশ্রয়কেন্দ্র থেকে দেশে পাঠানো হয়েছে ২ হাজার ৩০০ নারী শ্রমিককে। ২০১৬ সালে সেফ হোম আশ্রয়কেন্দ্র থেকে দেশে ফেরেন ১ হাজার ৩৬২ জন নারী শ্রমিক। তাঁরা দেশে ফিরেছেন বটে কিন্তু পৃথিবী যে কত নিষ্ঠুর, সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছেন।

আমাদের মেয়েরা সৌদি আরবে যেসব বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন, তাঁদের অনেকের মধ্যে মানবিক গুণাবলির অত্যন্ত অভাব। তাঁদের পাশবিক প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত নয়। তাঁরা বাছবিচার করেন না কে ধর্মপত্নী আর কে পরনারী, কে যৌনকর্মী আর কে গৃহকর্মী। মানুষের পক্ষে যতটা নিষ্ঠুর হওয়া সম্ভব আমাদের অনেক সৌদি ভাই তার চেয়ে কিছুটা বেশি। তাঁরা নারী শ্রমিকদের শারীরিক নির্যাতন করে পৈশাচিক আনন্দ পান। তাঁরা লাঠি দিয়ে মারধর করেন, তলপেটে লাথি মারেন, কাজ করান সুবেহ সাদিক থেকে মধ্যরাত অবধি। না খাইয়ে রাখার মধ্যে তাঁদের নির্মল আনন্দ। দুই বেলা খেতে দেন নুন দেওয়া অল্প পরিমাণ ভাত।

সৌদি প্রত্যাগত অনেক নারীর মধ্যে একজন ঢাকা বিমানবন্দরে প্রথম আলো প্রতিনিধিকে তাঁর কাহিনি বর্ণনা করেন। ২০ হাজার টাকা বেতনে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার বাবা গরিব। ১৬ বছর আগে আমাকে প্রায় ৬০ বছরের এক বৃদ্ধের কাছে বিয়ে দেন। ওই সংসারে দুই মেয়ের জন্ম হয়। স্বামীর বয়স ৭৫ হওয়ায় সংসারের কোনো কাজই করতে পারেন না। সব দায়িত্ব পড়ে আমার ঘাড়ে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য একদিন আমার কাছে আসেন। বলেন, মাত্র ৬৫ হাজার টাকা হলে বিদেশ যাওয়া যাবে। এখন দিতে হবে মাত্র ৩৫ হাজার। বাকি টাকা বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে। সৌদি আরবের রিয়াদ শহরে গিয়ে দুজন বৃদ্ধের দেখাশোনা করতে হবে। এমন শর্তে আমি সৌদি আরব যাই। প্রথম দুই দিন একটা ঘরে থাকি। তৃতীয় দিন আমাকে একটি গাড়িতে করে এক ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই কক্ষে আমার সঙ্গে আরও ৪০ থেকে ৪৫ জন নারীকে রাখা হয়। আগে থেকে রাখা ওই নারীদের কাছে শুনতে পারি নানা নির্যাতনের কথা।’ সেখানকার অন্তত ১০ জন নারী তাঁকে বলেন, অনৈতিক কাজ না করলে শরীরে গরম পানি ঢালাসহ মারধর করা হয়। গরম রড দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়।

দূতাবাসের মাধ্যমে নির্যাতিতাদের কাউকে দেশে ফেরত আনাই সমস্যার সমাধান নয়। প্রয়োজন কড়া প্রতিবাদ। বাংলাদেশের বিলীয়মান সিভিল সোসাইটি ও অগণিত নাগরিক সংগঠনের হাজারো কাজ। এই হতভাগিনীদের পাশে কে দাঁড়াবে? বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের, বিশেষ করে সৌদি আরবের টাকায় যাঁরা রাজনীতি করেন, বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা গড়ে তোলেন, এসব নির্যাতিত নারীর জন্য তাঁদের অন্তরে করুণার সৃষ্টি হবে না। তাঁরা তাঁদের প্রভুদের বলবেন না যে নিষ্ঠুর না হয়ে একটু মানবিক হোন।

দোজখ থেকে পালিয়ে যাঁরা দূতাবাসের শেল্টার হোমে আশ্রয় নেন, তাঁরা শূন্য হাতে যান। একবার গৃহকর্মী হলে তার বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা সম্ভব হয় না। তাঁদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে আসার বিমান ভাড়া নেই। পাসপোর্ট আটকে রেখেছে। নিয়োগকর্তারা নিশ্চুপ। দেশে ফেরার রাহা খরচ বহন করতে হয় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডকে।

গত বছর সৌদি আরবে নারী শ্রমিক গেছেন ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন। এ বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত গেছেন ২১ হাজার ৬১০ জন। তাঁরা গেছেন বৈধ প্রক্রিয়ায়। তাঁরা অভিবাসী শ্রমিক, অনুপ্রবেশকারী নন। স্বজনদের ফেলে যাঁরা বিদেশবিভুঁইয়ে শ্রম বিক্রি করে রোজগার করতে যান, তাঁদের একটু বেশি করুণা প্রাপ্য। এই নির্যাতিতেরা মানুষ এবং নারী শ্রমিক—ক্রীতদাসী নন। এই হতভাগিনীদের পাশে শুধু প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং দূতাবাসের লেবার উইং নয়, আন্তর্জাতিক শ্রমিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও দাঁড়ানো নৈতিক কর্তব্য।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক

Advertisement