প্রশ্নবিদ্ধ না প্রশ্নহীন নির্বাচন?

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন। এটি রুটিন বৈঠক। প্রতিটি নির্বাচনের আগে তারা এ ধরনের বৈঠক করে থাকে। কিন্তু বৈঠকের ফল নিয়ে জনগণের তেমন উৎসাহ নেই। কেননা, ভোট যেভাবে যাঁদের করার কথা, তাঁরা সেভাবেই করেন ।
তবে বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা সাংবাদিকদের যে কথাটি বলেছেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এ নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থেকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করণীয়, তা করা হবে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
সিইসির ভাষ্য থেকে আমরা জানতে পারলাম, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁরা কথা দিয়েছেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় এমন কিছু তাঁরা করবেন না। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন না করার বিষয়টি আমরা দুভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। এক. নির্বাচনটি এমনভাবে করা, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। তবে বাংলাদেশে কেউ প্রশ্ন করেননি, এমন নির্বাচনের কথা আমাদের জানা নেই। দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য ও অধিকতর সুষ্ঠু নির্বাচনকেও পরাজিত পক্ষ হৃষ্টচিত্তে নিতে পারেনি। তারা কখনো সূক্ষ্ম, কখনো স্থূল কারচুপির অভিযোগ এনেছে। যেমন বিএনপি মনে করে, ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল তাদের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, তেমন আওয়ামী লীগও ভাবে ২০০১ সালের নির্বাচনটি ছিল তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর চক্রান্ত। (সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেই কথাটিই ফের দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ২০০১ সালের মতো আর নীলনকশার নির্বাচন হবে না।)
প্রশ্নহীন নির্বাচনের আরেকটি ধরন হলো যাঁরা প্রশ্ন করতে পারেন, তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া। সামরিক শাসনামলে এ ধরনের নির্বাচনই বেশি হতো; কেউ প্রশ্ন করতে পারতেন না। করলেও ক্ষমতাসীনদের কিছু যায় বা আসত না। সব প্রধান দলের বিরোধিতা ও বর্জনের মুখে ১৯৮৮ সালে সামরিক শাসক এরশাদ যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিলেন, তাতে আড়াই শতাংশের বেশি লোক ভোট দেয়নি বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছিল। এ নিয়ে সেই সময় এরশাদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, আড়াই শতাংশ লোকও যদি ভোট দিয়ে থাকে তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। সেই নির্বাচনে এরশাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী সৈয়দ ফারুকুর রহমান, পরবর্তীকালে যার ফাঁসি হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা কথায় কথায় বিএনপি নেতাদের একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের দোসর বলে গালমন্দ করেন; কিন্তু যেই ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন, তাঁর সম্পর্কে একটি কথাও বলেন না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ নামের জোট তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিল, ৪৩ শতাংশ কেন্দ্রে ১৯ ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এখনো তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। নির্বাচন কমিশনও কোনো অনিয়ম তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা যায় না। নির্বাচনের আগে ও ভোটের দিন বিএনপির যেসব কর্মী ও নির্বাচনী এজেন্ট ‘মারাত্মক অপরাধী’ হিসেবে আটক হলেন, ভোট শেষ হওয়ার পর কীভাবে তাঁরা নিরপরাধ ও নির্দোষ ব্যক্তি হিসেবে ছাড়া পেলেন? নির্বাচন কমিশন যদি এই প্রশ্নগুলো না করতে পারে, তাহলে সিইসির সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা ও আশ্বাস দুটোই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।
তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দিকনির্দেশনা দিয়েছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিদের কথা শুনেছি। কীভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করা যায়, তার পরামর্শ দিয়েছি। আমরা আশা করি, তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।’
কিন্তু তাঁর নিশ্চয়ই জানা আছে যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু দিকনির্দেশনাই যথেষ্ট নয়। সেই দিকনির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে পালিত হলো কি না, সেটি দেখার দায়িত্বও কমিশনের। কে এম নুরুল হুদা দাবি করেছেন, নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতি
সঠিক আছে। অথচ সিলেট ও রাজশাহীতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে পুলিশের তল্লাশির খবর গণমাধ্যমে এসেছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি যদি সঠিকই থাকবে তাহলে সিলেটে দলীয় কর্মীদের ছাড়াতে একজন মেয়র প্রার্থীকে কেন থানার সামনে অনশনে বসতে হলো?
নির্বাচনের সময় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইসির সিদ্ধান্ত ও আদেশ মানতে বাধ্য। যদি কেউ সেটি না মানেন, তঁার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে তারা। আইনে সে রকমটিই আছে। কিন্তু খুলনা ও গাজীপুরে এন্তার অভিযোগ আসার পরও ইসিকে কোনো ব্যবস্থা িনতে দেখা যায়নি। বরং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে খুলনার রিটার্নিং কর্মকর্তার অতীত রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তারা ত্বরিত সেখানে একজন উপদেষ্টা পাঠিয়ে দিল। কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা
শুরু থেকে সবকিছু ঠিক আছে বলে সমস্যা অস্বীকার করে চলেছেন।
কিন্তু তাঁদের জানা থাকা উচিত যে সমস্যা আড়াল বা অস্বীকার করলে সেটি আরও প্রকট রূপ নেয় এবং একসময় সমাধানের বাইরে চলে যায়। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখা। প্রয়োজনে তারা গণশুনানি করতে পারে। যে জনগণকে নিয়ে নির্বাচন তারা যদি মনে করেন, ভোট দিয়ে কী হবে, ফলাফল আগেই নির্ধারিত হয়ে আছে, তাহলে সেই নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম নির্বাচন নিয়ে একটি নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের সঠিক কোনো সংজ্ঞা নেই।’ সুষ্ঠু নির্বাচনের যদি সঠিক সংজ্ঞাই না থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশনেরই বা কী দারকার। একসময় নির্বাচনের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে ‘আমার নির্বাচন আমি করব, যেমন খুশি তেমন করব। তুমি বলার কে?’ এই ‘তুমি বলার কে মার্কা’ নির্বাচনের জন্য তো নির্বাচন কমিশনের
দরকার হয় না।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যদি আইনের বরখেলাপ ঘটতে থাকে, এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর জবরদস্তি চালাতে থাকে, তাহলে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। রফিকুল ইসলাম সাহেব যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের সংজ্ঞাই না জানেন তাহলে এই দায়িত্ব নিলেন কেন? তাঁর দাবি, ‘কমিশন দেখে নির্বাচন আইনানুগ হয়েছে কি না? ইসি আইনের মধ্যে থাকতে চায়। আইনানুগ নির্বাচন হলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়।’
নির্বাচন কমিশনের একজন পদাধিকারী হিসেবে তাঁর জানা থাকার কথা যে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে, কোনোটাই বেআইনি ঘোষিত হয়নি। এমনকি সামরিক শাসনামলে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনকেও আইনানুগ বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে— এমন দাবি কেউ করবেন না।
এবারের সিটি নির্বাচনে অপর দুটিতে সমান সমান লড়াই হলেও সিলেটে বিএনপি কিছুটা বেকায়দায় আছে বলে ধারণা করা যায়। সিলেটে দলের মনোনীত প্রার্থী আরিফুল হকের বিরুদ্ধে একজন বিদ্রোহী প্রার্থী ও জোট শরিক জামায়াতে ইসলামীর একজন প্রার্থীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্য দুই সিটির একটিতে আওয়ামী লীগের মিত্র জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিয়েছে। এতে নিজ নিজ দল ও জোটের ভোট ভাগ হয়ে যেতে পারে। এই নির্বাচনে যে দলই জিতুক, নতুন নেতৃত্ব আসছে না। আওয়ামী লীগ থেকে দুজন সাবেক মেয়র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর বিএনপি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সদ্য বিদায়ী
দুই মেয়র। একমাত্র ব্যতিক্রম বরিশালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থী ও দলের গুণাগুণ বেশি আলোচিত হয়। কিন্তু এবারের নির্বাচনে স্থানীয় সমস্যা ও দাবিদাওয়া অনেকটাই উপেক্ষিত। দুই প্রধান দলই জাতীয় ইস্যুকে সামনে এনেছে। তাদের যুক্তি-পাল্টাযুক্তি ভোটারদের কতটা প্রভাবিত করে, তার ওপরই নির্ভর করছে ফলাফলটি কেমন হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গাজীপুর-খুলনার ব্যর্থতা ও দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে মোটামুটি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব নয়। তবে কমিশনের কথা, কাজ ও আচরণে জনগণের মধ্যে এই প্রতীতি জন্মাতে হবে যে তারা কারও হুকুমে চলে না। বরং রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের হুকুমে চলে।

Advertisement