ফাগুনের আগুন

‘জয়যাত্রা’, ‘রূপকথার গল্প’ ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘অজ্ঞাতনামা’ ও ‘হালদা’র পর তৌকীর আহমেদ পরিচালিত নতুন ছবি মুক্তি পাচ্ছে। ছবির নাম ‘ফাগুন হাওয়ায়’। ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে হাতেগোনা দু’একটি ছবির ভিড়ে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ হতে পারে অন্যরকম। লিখেছেন মীর সামী

খু লনার পাইকগাছা। সাল ২০১৮। দৃশ্যধারণ শুরু হয়েছিল একটি স্বপ্নের। একটি ভালোবাসার কাজের। দৃশ্যধারণ হয় শিবসা, কপোতাক্ষ, রূপসা ও পানকৌড়ি নদীর পাড়ে। শুটিং চলে শতবর্ষী রাডুলী হরিশচন্দ্র কলেজে। এখানেই নাসির আর দীপ্তির রসায়নে তৈরি হয় এক সময়ের প্রতিচ্ছবি আর বেদনাগাথা। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ চলচ্চিত্রের দৃশ্যধারণ ছিল সেটি। অভিনেতা নির্মাতা তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় নির্মিত ছবিটি প্রান্তিক পাইকগাছার গোলপাতায় ছাওয়া ঘের ঘিরে থাকা নোনাজল জনপদে চলে টানা ১৮ দিনের শুটিং। এ যেন সময়ের মাঝে সময়ের হারিয়ে যাওয়ার গল্প। ২০১৮ সালের মধ্য ফাগুনে চলচ্চিত্রের সবাই একাকার হয়ে যান ১৯৫২-এর চিত্রায়ণে।

বাঁকবদল বলতে যা বোঝায় তাই যেন তৌকীর আহমেদের ‘ফাগুন হাওয়ায়’। আপনার চলচ্চিত্রে নদী, নারী কিংবা নৌকা অবধারিত। এখানেও তাই দেখা যাচ্ছে। আর বিষয় হিসেবে এবার ‘৫২ কেন, এ প্রশ্নে তৌকীর আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘বাংলাদেশকে নদী, নারী ও নৌকা ছাড়া কল্পনা করা যায় না। আমি বাংলাদেশের গল্প বলতে চেয়েছি, আমার সব নির্মাণে তাই এসব ইমেজ- মেটাফোর অবধারিত।’ ‘৫২ কেন- এ বিষয় সম্পর্কে তৌকীর আহমেদ বলেন, ‘এই চলচ্চিত্র আমার আট বছর আগে করার কথা ছিল। অনুদানের জন্য জমা দিয়েছিলাম। পাইনি। তবে এখন করতে পারছি তাই ভালো লাগছে। কারণ ভাষা আন্দোলন নিয়ে বা একে উপজীব্য করে স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো সিনেমা হয়েছে কি-না আমার জানা নেই। আমার বিশ্বাস, আমাদের স্বাধিকার আদায়ের প্রথম সোপান ভাষা আন্দোলন নিয়ে এ সিনেমা বাংলাদেশের সিনেমায় নতুন সংযোজন হবে।’

ফাগুন হাওয়ায় দীপ্তি চরিত্রে অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় এটি তার দ্বিতীয় অভিনয়। প্রথমটি ‘হালদা’। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ অভিনয় এবং নিজের চরিত্র নিয়ে তার অভিমত- “আমি আগেও বলেছি আমাদের সিনেমায় যারা জেনে কাজ করেন তাদের মধ্যে তৌকীর আহমেদ অন্যতম। তার সঙ্গে হালদায় কাজের পর থেকে মুখিয়ে ছিলাম তার পরের নির্মাণে কাজের জন্য। কারণ তার চলচ্চিত্রে গল্প মুখ্য ভূমিকায় থাকে। অন্য কিছু নয়। আমার সৌভাগ্য যে আমি কাজটি করেছি। এটা দারুণ অভিজ্ঞতা। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ আমার চরিত্র মেডিকেল কলেজপড়ূয়া এক সনাতন ধর্মাবলম্বী মেয়ের। যে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করে। পর্দায় অন্য এক তিশাকে খুঁজে পাবেন সবাই এটা আমার বিশ্বাস।”

অন্যদিকে ‘পোড়ামন-২’ দিয়ে সিনেমায় যাত্রা শুরু করা সিয়াম আহমেদ অভিনয় করেছেন নাসির চরিত্রে। তৃতীয় চলচ্চিত্রে একদম অন্য লুকে অন্য ঘরানায়। একটু বেশি ঝুঁঁকি নিয়ে ফেলা নয় কি?

এ প্রশ্নে সিয়ামের উত্তর, ‘এটি বললে অনেকে ভাববে হয়তো বাড়িয়ে বলছি। তবে সত্যি বলছি, আমি অভিনয় করতে ভালোবাসি। মনের তাগিদে অভিনয় করি, নিছক জীবিকার তাগিদে নয়। তাই নিজেকে নানাভাবে বাজিয়ে দেখতে চাই। আর তৌকীর ভাইয়ের সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ কে হারাতে চাইবে। যার কাছ থেকে শুধু শেখাই যায়।’ ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নিজের অভিনীত চরিত্র সম্পর্কে সিয়ামের অভিমত, ‘আমার চরিত্রের নাম নাসির। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে গ্রামে ফিরে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করে। চলচ্চিত্রের জন্য আমার লুক বদলেছি। আমার বাবার তরুণ বয়সের ছবির আশ্রয় নিয়েছি। পড়াশোনা করেছি। বাকিটা পর্দায় দেখবেন দর্শক। আশা করি নিরাশ হবেন না তারা।’

এই চলচ্চিত্রের খলচরিত্র পাকিস্তানি পুলিশ কর্মকর্তা জামশেদ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘লগন’খ্যাত ভারতীয় অভিনেতা যশপাল শর্মা। যার সঙ্গে প্রথম মিটিংয়ে তৌকীর বলেছিলেন, ‘তুমি তো অর্ধেক পাকিস্তানি লুকের। দারুণ উর্দু বল। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে নেওয়ার ইচ্ছা নেই।’ কিন্তু যশপালের নিজেরও তো মতামতের বিষয় আছে। পুরো ছবির চিত্রনাট্য চাইলেন। আর পড়েই এই ছবিতে কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার মতে হাস্যরসের মধ্য দিয়ে নির্মম সত্য তুলে ধরার চিত্রনাট্যটি অসাধারণ। যশপালের পরিবারের দেশভাগের শরণার্থী হওয়ার করুণ স্মৃতি রয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল চার। কিন্তু ২০১৭ সালে ‘মুক্তি’ নামে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতা সম্পর্কে জেনেছিলেন। তাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কাজের আগ্রহ তৈরি হয়। জানা গেছে, ফাগুন হাওয়ায় ছবিতে অভিনয়ের আগে তৌকীর আহমেদের ‘হালদা’ এবং ‘অজ্ঞাতনামা’ দেখে তার সঙ্গে কাজে সম্মতি দেন। তৌকীর আহমেদের সঙ্গে কাজ প্রসঙ্গে যশপাল বলেন, ‘তৌকীর আহমেদ জানেন, তার কী করতে হবে। তিনি যা চান, সেটি আদায় করে নেন। স্বল্প বাজেটেও মানের সঙ্গে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। পিরিয়ড পিসকে তুলে ধরতে যা যা দরকার, সব আয়োজন করেছেন। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, এই ছবিটি বাংলাদেশের সম্মান বাড়াবে।

আগেই বলা হয়েছে, ‘ফাগুন হাওয়ায়’ তৌকীরের স্বপ্নের সিনেমা, তাই শিল্পী নির্বাচনে নূ্যনতম কার্পণ্য করেননি এই পরিচালক। ছবিটির পাকিস্তানি পুলিশ অফিসারের চরিত্রে তিনি বেছে নিয়েছেন বলিউড অভিনেতা যশপাল শর্মাকে। ‘লগন’খ্যাত এই তারকাকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে বলেছেন, যশপাল দেখতে অনেকটা পাকিস্তানিদের মতো!

ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত ছবিটি মুক্তি পাবে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি। তবে মুক্তির আগেই ভাসছে প্রশংসার জোয়ারে। ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা। বোর্ডের জ্যেষ্ঠ সদস্য মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘আমরা ছবিটি দেখেছি। চমৎকার ছবি। খুব ভালো লেগেছে। যারাই ছবিটি দেখেছেন, সবাই প্রশংসা করেছেন।’ এর আগে ২০ জানুয়ারি ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির ট্রেলার প্রকাশ হয়। জানা গেছে, ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রাজধানীর ধানমণ্ডির স্টার সিনেপ্লেক্সের সীমান্ত সম্ভার শাখায় ছবিটি দেখবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর।

টিটো রহমানের ছোটগল্প ‘বউ কথা কও’-এর অনুপ্রেরণায় নির্মিত চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। এতে আরও অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, ফজলুর রহমান বাবু, রওনক হাসান, সাজু খাদেম, শহীদুল আলম সাচ্চু, আফরোজা বানু, আজাদ সেতু, হাসান আহমেদ, কল্লোল চৌধুরী প্রমুখ।

Advertisement