ফিরে দেখা বৈশাখ আমার

।। মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম রাজু ।।

বঙ্গ সনের প্রথম মাস বৈশাখ, যে কিনা বাঙালীর ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ।

ঘড়ির কাটা আপন গতিতে এগুয়, বৈশাখ আসে বৈশাখ যায়, নতুন কিছু দিয়ে যায়, আবার অনেক কিছু হারিয়েও যায়। ফেলে আসা জীবনের কোনো চিত্র সামনে এলেই পুরাতন মানুষগুলি ক্ষণিকের জন্যে হলেও সেই জীবনে ফিরে যায়। সেরকম একটি চিত্র বা দৃশ্য জুকার মিয়ার কল্যাণে সামনে এসেছে। তাই পিছনে ফিরে তাকানোর চেষ্টা এবং এখানে আসা।

আসুন একটু ঘুরে আসি বন্ধুগণ! বৈশাখ এলেই বাঙালীর ঘরে ঘরে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। কারণ এই মাসেই সোনালী ফসল ধান, কাটা, মাড়াই এবং ঘরে তুলার উৎসবে মেতে উঠে কৃষক-কৃষাণীরা। আগেকার দিনে ধান কাটার পর কাছেই সুবিধাজনক কোথাও মাড়াইয়ের কাজটাও সেরে নেয়া হত। এরপর ধানগুলি কাঁচা’ই বাড়িতে নেয়া হত আর খড় নেয়া হত শুকিয়ে। আর এগুলি বহন করা হত মূলত কাঁটের তৈরি দুই চাকা বিশিষ্ট গাড়ির মাধ্যমে। কষ্ট সাধ্য কাজটি সাধাণত গরু কিংবা মহিষ দ্বারা করানো হত। সাড়ি সাড়ি গরুর গাড়ি…।

বৈশাখের সুঘ্রান আসার আগেই শুরু হত পুরাতন গাড়ি মেরামত আর নতুন গাড়ি তৈরির কাজ। গাড়ির কাট মিস্ত্রিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।
বাড়ির উঠান কিংবা বাজারের দোকান ঘর সবখানেই শুভা পেত গাড়ির চাকা। আর সময় হলেই হাওড়ের রাস্তা, আমাদের ভাষায় গোপাটগুলিতে এসব গাড়ি নেমে পড়তো। নলোয়ার গোপাটে ধান মাড়াই আর বস্তা ভর্তি ধানের গরু এবং মহিষের গাড়ি এখনো আমার চোখে ভাসে। প্রতিটি গোপাটে এসব গাড়ির উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। দুই তিন পাঁচ কিংবা সাতটি গাড়ি, যার যতটা প্রয়োজন তাঁর ততোটাই ছিল। হাওড়ের মেঠোপথে যাবার বেলা খালি আবার ফেরার বেলা কয়েকটি ধানের বস্তা কিংবা শুকনো খড় উঁচু করে ভরে নিয়ে ফিরে আসতো।

দিনের অবসর সময় কিংবা রাতের বেলা গাড়িটি জলে নামিয়ে রাখা হত।
আবার সময় মতো রাস্তায় ফিরিয়ে আনা হত। ছোট বড় সবারই এসব গাড়ি চড়ার সখ দেখা যেত। নিজে কত যে চড়েছি হিসাব নেই।
দুর্বল গাড়ি কিংবা ভাঙা গোপাটের কারণে চাকা ভেঙে যেত, কিন্তু কাজ থেমে যেত না, আবারও গাড়ি চলতো। গাড়িতে বসে মনের আনন্দে কত রঙের গানই গাইতে শোনা যেত।

ওকি গাড়িয়াল ভাই অথবা আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে…. অনেকের মতে বাংলার এসব বিখ্যাত গানের উদ্ভাবন মূলত এই গরু গাড়ি থেকেই হয়েছে। হাওড়ের রাস্তা, বইয়ের পাতা কিংবা বিনোদন জগত সবখানেই গরুর গাড়ির উপস্থিতি, আধিপত্য কিংবা প্রভাব ছিল।

এখন সময় বদলেছে। উন্নতি হয়েছে প্রযুক্তির। কৃষিতেও প্রযুক্তি হাওয়া লেগেছে ব্যাপকভাবে। হাওরের গোপাটে এখন শুধু মেশিন চালিত প্লাষ্টিকের তৈরি চাকার গাড়ি। যান্ত্রিক এই গাড়ির কাছে হেরে গিয়েছে সনাতন আমলের সেই গরু-মহিষের গাড়ি। সেদিন যে পথে শত শত গাড়ি চোখে পড়তো, কালক্রমে আজ সেই পথে একটা দুইটা গরু বা মহিষের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেদিন হয়তো বেশি দুরে নয় যেদিন গরুর গাড়ি থাকবে চোখে দেখা মানুষটির মনের গহিনে, মোবাইলের মেমোরী আর শোভা পাবে কোনো জাদুঘরে। নিষ্ঠুর প্রযুক্তি কি এভাবেই গিলে খাবে গ্রাম বাংলার সেই সনাতন বা প্রাচীন ঐতিহ্যকে?

লেখক : সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী।

Advertisement