ফিলিস্তিনের সাহসী নারীরা

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: আহেদ তামিমি। ১৭ বছর বয়সী এই কিশোরী ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্মের বিদ্রোহের প্রতীক, যে কিনা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার ওপর ইসরায়েলের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানানোর অপরাধে আট মাস জেল খেটেছে। গত ডিসেম্বরে ইসরায়েলি সেনারা বাড়ি থেকে তামিমির ভাইকে ধরে নিতে এলে সে তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে এক সেনাকে চড় মারে তামিমি। এ জন্য তাকে সে সময় গ্রেপ্তার করা হয়। গত মার্চে বিচার শেষে তামিমিকে আট মাসের কারাদণ্ড দেন ইসরায়েলি আদালত। গত জুলাই মাসের শেষ নাগাদ তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

তামিমির গল্প আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করেছে। অথচ ফিলিস্তিনে আরও বহু মেয়ে ও নারী আছেন, যাঁরা ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনের কারণে কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছেন এবং অনেকে তামিমির মতোই সাহসী। কিন্তু তাঁদের কথা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সেভাবে প্রচার পায়নি।

পশ্চিমা গণমাধ্যমে ফিলিস্তিনি নারীদের খবর যে পরিবেশিত হয় না, তা নয়। তবে তাঁদের ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনের বা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নিপীড়নের শিকার হিসেবে দেখানো হয়। তাঁদের পরিবর্তনের এজেন্ট হিসেবে খুব কমই দেখানো হয়। আমি এখানে গাজার চারজন ফিলিস্তিনি নারীর গল্প তুলে ধরব, যাঁরা প্রচণ্ড সাহসী এবং অনেক সংগ্রাম করলেও গণমাধ্যমে তাঁদের কথা আসেনি। এই নারীরা সংসারের ভরণপোষণের ব্যয় বহন করেছেন, গান শিখিয়েছেন, গাজা-ইসরায়েল সীমান্তে গিয়ে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই অবরুদ্ধ কঠিন জীবনের সব কষ্ট সহ্য করেছেন এবং করে যাচ্ছেন।

তাঁদের একজন হচ্ছেন লামিয়া আহমেদ। গত ২৭ জুলাই লামিয়ার স্বামী গাজি আবু মোস্তফা যখন গাজা সীমান্তের কাছে একজন ইসরায়েলি সেনার গুলিতে নিহত হন, তখন লামিয়া স্বেচ্ছা প্যারামেডিক হিসেবে গুলিতে আহত এক ফিলিস্তিনিকে সেবা দিচ্ছিলেন। লামিয়া নয় ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। তাঁর পরিবার এখন গাজা উপত্যকার দক্ষিণে খান ইউনিস শহরে বসবাস করছে। আগে তারা বির আল সাবা শহরে বসবাস করত। ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে তারা সেখান থেকে উৎখাত হয়, লামিয়া তাঁর অধিকারে বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, তাঁর পরিবারের অধিকার আছে নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার। আর এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে লামিয়া গত ৩০ মার্চ ভূমি দিবসে গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন আন্দোলনে যোগ দেন। লামিয়া শুধু আন্দোলনেই যোগ দেননি, তিনি প্রতি শুক্রবার স্বেচ্ছা প্যারামেডিক হিসেবে আহত ফিলিস্তিনিদের সেবা দিচ্ছেন। জীবনযন্ত্রণায় বিধ্বস্ত হলেও ভেঙে পড়েননি লামিয়া। এসব দুঃখ-কষ্ট তাঁকে আরও শক্তিশালী ও সহনশীল করেছে।

রিম খুব ছোটবেলা থেকে তাঁর প্রিয় বাদ্যযন্ত্র উদ বাজিয়ে আসছেন। যুদ্ধের এত ডামাডোলের মধ্যেও তিনি তাঁর বাদ্যযন্ত্রটি হাতছাড়া করেননি। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলার সময় রিম প্রতিদিন বাড়ি থেকে সা’ইদ ইল-মাশাল কালচারাল সেন্টারে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নেওয়া ভীতসন্ত্রস্ত শিশু ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ বাজিয়ে গান শোনাতেন। পাশাপাশি তিনি তাদের গানও শেখাতেন। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও রিম তাঁর কাজ চালিয়ে যান। যুদ্ধে যেসব শিশু আহত বা পঙ্গু হয়েছে, তাদের সেবা দেন। অন্যান্য তরুণ শিল্পীর সঙ্গে মিলে নাটক বানান ও সংগীতের আয়োজন করেন। শিশুরা যাতে যুদ্ধের আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারে, সে জন্য সেসব নাটক ও সংগীত তাদের সামনে পরিবেশন করেন। সেই থেকে রিম চেষ্টা করছিলেন গাজা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে, যেখানে তিনি তাঁর গানের চর্চা চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু তাঁর অনুরোধ ইসরায়েল বারবারই প্রত্যাখ্যান করেছে। অবশেষে ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ রিম গাজা ছাড়তে সমর্থ হন। তিনি বর্তমানে ইউরোপে আছেন। সেখানে পড়াশোনা
শেষ করে তিনি নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।

ফিলিস্তিনের আরেক সাহসী নারীর নাম শায়মা। গাজা উপত্যকার আল কুদস ওপেন ইউনিভার্সিটিতে তিনি স্নাতক শ্রেণিতে পড়ালেখা করছিলেন। ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর তাঁর পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে শায়মা সবার বড়। তাঁর বিয়েও ঠিক হয়েছিল। স্নাতক পাস করার পর তাঁর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত ১২ মার্চ তাঁর মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়ে। এ খবর প্রকাশ হওয়ার পর তাঁর বিয়ে ভেঙে যায়। টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচারের পর তাঁর শরীরের অর্ধেক অবশ হয়ে যায়। তাঁর কথা বলা ও চলাফেরা প্রায় বন্ধ থাকলেও তিনি তাঁর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। এখন টিউমার পুরোপুরি অপসারণের জন্য তাঁর আরও একটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। কিন্তু ১২ আগস্ট গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে যে ইসরায়েল অধিকৃত ভূমিতে কোনো ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা হবে না। এখন শায়মা অপেক্ষা করছেন চিকিৎসার জন্য গাজার বাইরে যেতে অনুমতি পাওয়ার।

দৌলাত ফিলিস্তিনের আরেক সাহসী নারী। পেশায় কেশবিন্যাসকারী এই নারী গুরুতর অসুস্থ বাবাসহ ১১ জন সদস্যের একটি পরিবারের ভরণপোষণের ব্যয় বহন করতেন। তাঁর অন্য ভাইবোনেরা সবাই বেকার। ২০০৬ সালে একদল নারীর সঙ্গে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ জানানোর সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। কয়েক মাস চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন এবং তাঁর প্রতিদিনের সংগ্রাম শুরু করেন। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। চলতি বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র তেলআবিব থেকে তার দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করলে অন্যদের সঙ্গে তিনিও বিক্ষোভ করেন। এ সময় ইসরায়েলি সেনারা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালালে তাঁর ডান ঊরুতে গুলি লাগে। এরপর থেকে তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। এখন আর তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না। চিকিৎসার জন্য গাজার বাইরে যাওয়ার অনুমতি এখনো তাঁর মেলেনি। কিন্তু তাতে মনোবল হারাননি দৌলাত। তিনি এখনো আশাবাদী যে একদিন তিনি সুস্থ হবেন এবং আবার পরিবারের ভরণপোষণের ব্যয় বহন করবেন।

প্রকৃতপক্ষে আহেদ, রিম, শায়মা ও দৌলাত—তাঁরা সবাই সব ফিলিস্তিনি নারীর অনুপ্রেরণা। শত দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যেও তাঁরা যেভাবে টিকে আছেন, তা সত্যিই অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়।

Advertisement