বইষ আইতাছে বইষ…

।। মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম রাজু ।।

কৃষি প্রধান গ্রামীণ জনপদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলবান এক প্রাণীর নাম মহিষ। কোনো কোনো দেশে একে বলে জামুস। ইংরেজরা বলে বাফুন। আমাদের পাশের দেশের কেউ বলে বেস্, আবার কারো কারো ভাষায় এরাম মাডু। বাংলাদেশে কেউ মইষ, আর সিলেটি বেটা বেটিন্তে খইন বইষ, নর হলে বয়রা, নারী হলে বয়রী। সিলেট থেকে একটু ভাটিতে গেলে শুনবেন কাহানা আর কাহিনী। যে যাই বলুক না কেনো চিনে সবাই। কারণ এক কালে গ্রাম বাংলার ঘাসের মাঠ হোক আর বাজারের হাট, সবখানেই প্রাণীটির উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
মহিষ সাধারণত দুই রঙের দেখেছি। সাদা এবং কালো। তবে কালোটাই বেশি। সাদা খুবি কম দেখা হয়েছে। অতীতে হাল চাষের ক্ষেত্রে প্রাণীটির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিলের তলা কিংবা পাহাড়ের টিলা লাঙ্গলটা ধরে রাখতে পারলেই হলো।
উঁচু নিচু জমি সমান করতে চান, মৈ’টা ঠিক মতো ধরে রাখুন আর দুই তিনজন মৈ’য়ে চেপে বসুন, দেখবেন টান কারে কয়!

বৈশাখে ধান মাড়াই করতে চান? কয়েকটা চক্কর দিন,
ধানের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে, খেয়াল রাখবেন
যদি একবার তার পা আপনার পায়ের উপর পড়ে যায়,
তাইলে কিন্তু দিনের তারা দেখে ফেলবেন!

ধান খর কিংবা অন্য কিছু বহন করাতে চান? ভালো একটা গাড়ি বানান, নইলে কিন্তু চুড়মার হয়ে যাব।
ধানের বস্তা যতগুলি সম্ভব দিতে পারেন দিন, গাড়িটা টিকলেই হলো, শুকনা পথ হোক আর ভেজা পথ হোক, তার যেন গায়েই লাগেনা! আমার বাবা বলতেন, মহিষ অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলে, এমন শক্তিশালী।
আবার খেয়াল রাখতে হবে। যদি তার মাথায় গরম লেগে যায়, তাইলে কিন্তু আপনাকে কিছু না বলেই গাড়িসহ জলে নেমে যাবে!

আর এদের পুরুষের লড়াই! অর্থাৎ বয়রায় বয়রায় মারামারির কথা আর কি বলব! একজন আরেক জনকে দেখলেই যেন জ্বলে পুড়ে উঠে। সুযোগ পেলেই বিশ্ব যুদ্ধ শুরু করে দেয়। যেন বাঁচা মরার লড়াই! হারাতে পারলে তাড়াতে তাড়াতে এলাকা ছাড়া করবে।
অমুকের বয়রা এখন গ্রাম বা এলাকার সরদার, এমন কথাও শোনা যেত।
সুযোগ পেলে আবার রাতের বেলা গিয়েও আক্রমন চালাবে। এজন্যই মহাজনেরা এমনভাবে পুরুষকে বেঁধে রাখেন যাতে করে চাইলেই প্রাণটা বাঁচাতে পারে। পুরুষ মহিষের নাখ ছিদ্র করে দড়ি পেচানো হয়, যাকে বলা হয় নাখা বা নাখতা।
কেউ পানিতে নামিয়ে নাখা দিত আবার কেউ গাছে লটকিয়েও নাখা পরাতে দেখা যেত।

বর্ষাকালে এরা মাঠ কিংবা জমির আইলে ডুবে ডুবেও খাবার খেতে পারে। এক এলাকা থেকে সাতরিয়ে অন্য এলাকায় চলে যেতে পারে। মৃত কিংবা জবাই করা মহিষের শিং এর মাথা কেটে বাজানো হত শিঙা। যার সুর বা শব্দ বেশ দুর পর্যন্ত যেত। বাজিয়েছিও।

মহিষের গোস্ত অনেকেই খেতে চান না। একবার একটি জিয়াফতি খানা শেষে একজন বলছেন, পেটে খালি আল্লোয়ার! অর্থাৎ জিয়াক্ষত বা শিরনি খাওয়ার পর তা পেঠের মধ্যে কি যেন করছে! এ কথা শুনে সঙ্গে থাকা আমার এক ভাগ্নে বলল, আল্লোয়াইব নায়নি-বা। বইষে আর গরুয়ে খাইছো। এখন পেঠের ভেতরে একটা আরেকটারে দৌঁড়াইতাছে!

মহিষ সাধারণত ঘরে রাখা হয় না। খালি জায়গায় রাস্তার কিনারে বেঁধে রাখা হয়। আমাদের এলাকায় এক কালে কম বেশি সবখানেই চোখে পড়তো দল বেঁধে ঘাস খাচ্ছে মহিষ।
বাচ্চাদের বইষ আইতাছে বইষ, এই কথা বলে ভয় দেখানো হত। এজন্যই কইতাম বইষ আইতাছে বইষ বইষ, ঠেংগা লাঠি লইছ।

সময় বদলেছে মানুষের রুচিও বদলে গেছে এখন। কৃষিতেও লেগেছে বিজ্ঞানের ছোঁয়া। যান্ত্রিক মেশিন হাওড়ে নেমে যাওয়াসহ নানান কারণে মহিষ লালন পালন বা এর প্রয়োজনিয়তা কমে গেছে।
এখন গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেও মহিষের দেখা পাওয়াটা দুষ্কর। আমাদের এলাকায়ও অনেক মহিষ ছিল। এখন কমে গেছে।
সে বছর বৈশাখের শেষে ইছিপুরের দক্ষিণের হাওড়ে কয়েকটি মহিষকে খাবার খেতে দেখা ছিলাম। ২৬.০৫.২০১৯. বিকেলে হাজারি বাড়ির পূর্বের গাছের সামান্য পূর্বে সড়কের দক্ষিণে দুটিকে পেয়েছিলাম।

লেখক : সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী।

Advertisement