বই পোঁকাদের খোঁজে।

ফারজানা ইসলাম লিনু

“পৃথিবী হউক বইয়ের “….. শ্লোগানটাকে ফলপ্রসূ করার জন্য অনেক দিন থেকে ঘরে বাইরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিশেষ করে স্কুলের বাচ্চাদের ও নিজের সন্তানদের ক্ষেত্রে প্রচেষ্টার মাত্রাটা একটু বেশি।

কিছু জায়গায় প্রচণ্ড ভাবে সফল হয়েছি আর কিছু জায়গায় একটু কম। পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি বলবো না।

মাঝেমাঝে হতাশ হই বাচ্চারা কেন বইয়ের প্রতি বিরাগ। শুধু বাচ্চারা না কিছু বাবা মা ও বিরক্ত হয়ে আমাকে ফোন দেন, মিস আপনি নাকি বলেছেন ওকে দশটা বই কিনে দিতে?
হ্যাঁ বলেছি, কিন্তু সমস্যা কি?
কোন সমস্যা নেই, খালি গল্পের বই পড়লে তো পড়াশুনায় লাড্ডু মারবে। আর এত গুলো বই একসাথে কিনে কি করবে?
আমি বলি, গল্পের বই পড়ে যদি পড়াশোনায় লাড্ডু মারে মারুক। আর একসাথে এতগুলো বই কিনে নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকবে। বিশুদ্ধ গন্ধ।

আমিও ছোটবেলায় শুঁকতাম, এখনো শুঁকি।
অভিভাবকরা আমার উত্তরে আশ্বস্ত হতে পারেননা। মনের কোনে চিন্তা তাদের থেকেই যায়।
একটা দামি আই প্যাড দিতে আমাদের বাঁধে না, বই কিনে দিতে বাঁধে। সেই বাঁধা দূর করতে আমি বদ্ধপরিকর।

কিন্তু সময়টা যে প্রযুক্তির। নিত্যনতুন প্রযুক্তি যেমন আমাদের সমৃদ্ধির সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তেমনি কিছুক্ষেত্রে ডুবতে ডুবতে কোন মতে ভেসে আছি আমরা।

মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের পৃথিবীকে করেছে ক্ষুদ্রতর, আরাম আয়েশের ক্ষেত্র হয়েছে বিস্তর প্রসারিত। কিন্তু আমরা হয়েছি সংকীর্ণ।
সংকীর্ণতা দূর করতে আমি বাচ্চাদের বলে যাই, বাবারা বই পড়।
আমাদের ছেলেবেলায় বই এত সহজলভ্য ছিলনা। একটা বই আমরা অনেকবার পড়তাম। বৃষ্টির দিনে কোন কাজ নেই তো বইয়ের তাক থেকে একটা পুরনো বই বের করে পড়া শুরু করতাম। গ্রামের বিদ্যুৎ বছরের বেশির ভাগ সময় নাইওর থাকে, বিশেষ করে কালবৈশাখির সময় ও বর্ষাকালে।

রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে বই পড়াতে মায়েদের বড় আপত্তি। শুধু শুধু কেরোসিনের শ্রাদ্ধ। তারপরও লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। পড়ার বইয়ের ভেতর গল্পের বই রেখে পড়তাম।

স্কুলে ক্লাস চলাকালীন সময়ে লুকিয়ে বই পড়তে গিয়ে হাতেনাতে ধরা খেয়েছি, শাস্তিও পেয়েছি অনেক বার। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না। আমাদের অতিরিক্ত বই পড়া সে সময় অপরাধের শামিল ছিল।

বই পড়ার এই গর্হিত অপরাধে সঙ্গী ছিল সহপাঠী চাচাতো বোন জোছনা ও লিপি । ক্লাসের সময় লুকিয়ে বই পড়ার কারনে একবার তো তিন জনই শাস্তি পেলাম স্কুলের বি,এস,সি স্যারের কাছে। তারপরও বই পড়া থামেনি

বইয়ে ঠাসা লাইব্রেরি ছিল স্কুলে। কিন্তু আমরা কয়েকজন ছাড়া বই তেমন একটা কেউ পড়তো না। প্রতি সপ্তাহে বই নিয়ে আবার নিজেদের মধ্যে চালাচালি করে পড়তাম।

পুরনো বই গুলোর ভেতর শুকনো গোলাপের পাপড়ি থেকে শুরু করে অনেক বছর আগের প্রেম পত্র পর্যন্ত পাওয়া যেত। ছদ্ম নাম বা নাম বিহীন এসব পত্রে সমকালটাই ছিল মহাকাল।

বইয়ের বিশেষ বিশেষ লাইনের নিচে দাগ টানা থাকতো কখনো। পাতায় পাতায় মজার মজার কথাও লিখা থাকতো। লিখা থাকতো বই নিয়ে নানা মন্তব্য। আহারে বিদগ্ধ পাঠক! কত গুরুত্ব দিয়ে পড়েছে বইটা।

একবার বইয়ের ভেতর খুব পরিচিত হাতের লিখা চোখে পড়লো। কয়েক পৃষ্ঠা পরপর একটা কোটেশন দিয়ে মজার কিছু লাইন লিখা সাথে বার বছর আগের দিন, মাস,সাল।

প্রতিটা লাইনের নিচে লিখা আমাকে জানতে অমুক পৃষ্ঠায় যান। সেই পৃষ্ঠায় আবারও বই নিয়ে একটা সুন্দর মন্তব্য।

কিন্তু পাঠকের পরিচয় নেই। লিখাটা অনেক পরিচিত। কৌতুহল রাখতে পারছিনা। পুরো বইটা শেষ করে অবশেষে পাঠককে পাওয়া গেল। পাঠক আর কেউ নন আমার বই পোঁকা বড় ভাই। যার বইয়ের তাক থেকে চুরি করে বই পড়ে বই পড়ার শুরুটা হয়েছিল আমার। মাঝেমাঝে অতি তুচ্ছ বিষয়ও আমাদের অনেক ভালো লাগে। সেদিনের পাঠকের পরিচয় পাওয়ার পর ভালোলাগাটাও ছিল সে রকম।

হাত ঘুরে ঘুরে উজালা গ্রন্থাগারের বই আসতো আমাদের হাতে। ঐতিহ্যবাহী এই লাইব্রেরির বইগুলো পড়েছি সেও এক সৌভাগ্য মনে হয়।

বিয়েতে উপহার হিসেবে বই দেয়ার প্রচলন অনেক আগের। মকছুদুল মোমিন বা মুসলিম পরিবারে স্বামী স্ত্রীর কর্তব্য শীর্ষক বই বিয়ের উপহার হিসেবে বেশি প্রাধান্য পেত।

তারপর ছিল রোমেনা আফাজ বা কাসেম বিন আবু বক্করের বই। শরৎচন্দ্রের বইও থাকতো দু-একটা। গ্রামে কারো বিয়ে হলে আমি আর জোছনা বউ দেখার জন্য আকুলি বিকুলি করতাম। উদ্দেশ্যটা বউ দেখা নয়, বিয়েতে উপহার হিসেবে পাওয়া বই গুলো। নতুন বউয়ের কাছ থেকে বইগুলো হ্যাংলার মত চেয়ে নিয়ে আসতাম। বইয়ের প্রতি আগ্রহ দেখে কেউ কেউ বইগুলো আমাদের মুক্তহস্তে দিয়ে দিতেন। নিজের বইয়ের ভান্ডারে গোটা দুয়েক বই যোগ হওয়াতে কি যে খুশি লাগতো তখন।

দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দা পরবর্তিতে হুমায়ুন আহমেদ আমাদের ভুবনকে সযত্নে আগলে রেখেছিলেন।

সিলেটে এসে নিজে বই কিনে পড়া শুরু করলাম।

পাঠচক্রের নিয়মিত ক্রেতা, নিউ নেশনে ও বইপত্রে নিত্য যাতায়াত। প্রতিমাসেই আমার আর লিপির বই কিনা চাই।
গর্ভধারিনী পড়ে ভাবি আনন্দ, জয়ীতা, সুদীপদের মত না বলে নিরুদ্দেশ হব একদিন। পালটে দেব এই দুনিয়ার বড় না হউক ছোট এক অংশ।
সাতকাহনের স্বর্গছেড়া বাগানে দিপাবলিকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি কত। পুর্বপশ্চিমের পিকলুর মৃত্যুতে ব্যথিত হয়েছি অনেক। কালবেলার অনিমেষ, যে ছিল বেচারা চারু মজুমদারের একনিষ্ঠ অনুসারী।

আদর্শ ও রাজনীতির জন্য জলাঞ্জলি দিয়েছিল ভালবাসা। অনুপ্রাণিত হয়েছি অনিমেষ, মাধবীলতার দৃঢ়তায়। যদিও মাধবীলতার জন্য বুকের কোনে পুষে রাখা কষ্টটা এখনো খানিকটা আছে। হায়রে দুরবীন, মানবজমিন আর পার্থিব একাধিকবার পড়েও তৃপ্ত হইনি।

ম্যাক্সিম গোর্কির মা, টলস্টয়ের আনা কারানিনা, ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল, কাউকে ভুলিনি। এই বইগুলোর ভেলায় ভেসে জীবনের কঠিনতম পথ পাড়ি দিয়েছি অনেকটা নির্বিঘ্নে। বই মন ভালো করে দেয়, দুশ্চিন্তা সরিয়ে রাখে, আনন্দ দেয়, আবার বই কাঁদায়ও। কত বইয়ের পাতায় চোখের জল শুকিয়ে যে নুন হয়েছে এখনো মনে হয় খুঁজলে পাওয়া যাবে।

এই বয়সেই কেঁদে বুক ভাসিয়েছি খালেদ হোসেইনির ‘এ থাউজেন্ড এসপ্লেন্ডিড সান’ ও আনিসুল হকের ‘মা’পড়ে। তারপরও পড়া থেমে নেই। নিজের বই পড়ার কিছু সঙ্গী আছে বটে, চাই সেই সঙ্গীদের সংখ্যা আরো বাড়ুক।

আমার সঙ্গে যুক্ত হউক একদল বইপোঁকা ছেলে মেয়ে। হাতের ডিভাইসটাকে ক্ষণিকের জন্য সরিয়ে রেখে বইয়ের জন্য বরাদ্ধ হউক আলাদা একটু সময়। অতি ক্ষুদ্র এই প্রয়াসকে সফল করার চেষ্টা ঘর থেকেই শুরু করেছি।

নিজের মেয়েদের বইপড়ার যথেষ্ট আগ্রহ আছে। মাকে দেখে হউক আর নিজের ইচ্ছায় হউক হয়েছে।
পুত্রের বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করতে না পেরে আমি খানিকটা হতাশ ও চিন্তিত। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটা বই হাতে ধরিয়ে দিলে কিছুক্ষণ পরে এসে বলবে বইটা একে বারেই ইন্টারেস্টিং না। আপনাকে আগেই বলেছিলাম আমার জন্য এই বইটা আনবেন না। তারপর ও আনলেন।

আমি তারে বলি তুমি বইটা পুরোপুরি পড়, পড়লে ভালো লাগবে।
আচ্ছা পরে পড়বো এইটা, বলেই অন্য একটা বই খুঁজতে থাকে।
আমিও নিত্যনতুন ফন্দি খুঁজতে থাকি তারে কেমনে বই পড়ানো যায়। ফাঁকতালে শুনিয়ে দেই গল্পের বই না পড়লে এই সুবিধা বন্ধ, সেই সুবিধা অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিছু কিছু স্পর্শকাতর সুযোগ সুবিধার প্রতি সে অতিমাত্রায় আসক্ত থাকায় আমার হুমকি গুলো সাময়িক ভাবে কিছুটা কাজ দেয়। পুত্র আমার চাপে পড়ে গোটা দুয়েক বই পড়ে শেষ করে। মাঝেমাঝে বলে বইটা খুবই মজার।

আমিও কৌশলে তার সাক্ষাৎকার নিয়ে জানতে চেষ্টা করি আসলেই সে পড়েছে কিনা।
এই যুগের শিশু! ফাঁকি দিতে তারা অনেক কেতাদুরস্ত। মায়েরা ডালে উঠলে তারা উঠে যায় পাতায়। সেও বুঝে গেছে মায়ের পাল্লায় গল্পের বই না পড়ে উপায় নেই। কিন্তু বইয়ের প্রতি যে তার কোন আগ্রহ নেই, তো কি করবে সে? মায়ের মন বুঝানোর জন্য অল্প বিস্তর পড়ে। সতেরো আঠারো বছর থেকে নিজের তিন সন্তান তথা ছাত্রছাত্রীদের সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে মিশে নতুন নতুন সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই প্রতিদিন।

আগের চেয়ে ওদের মনটা পুরোপুরি না হলেও অনেকটা পড়তে পারি।
গত কয়েক দিন থেকে চিন্তা করলাম আমি আমার ছেলের জন্য কিনে আনা বইগুলো পড়বো। বলে রাখা ভালো প্রতিমাসেই সে আমাদের সাথে লাইব্রেরিতে গিয়ে কতগুলো বই বগলদাবা করে নিয়ে আসে। লাইব্রেরিতে গিয়ে সে এমন ভাব করবে যেন বই ছাড়া তার চলেইনা। কখনো কিনে না দিলে সারা রাস্তা ঘ্যানঘ্যান করে, আমার পছন্দমত বই দিলে তো আমি পড়তাম।
আমিও কৌশল বদলে ফেললাম, সে যে বই কিনতে বলে আমি সেটা কিনে দেই। প্রথম দিন বই নিয়ে এসেই স্কুলের পড়া, হোমওয়ার্ক সব তুচ্ছ করে বিশাল আয়োজনে গল্পের বই পড়তে বসে। পরের দিন থেকে বেশিরভাগ বইয়ের অস্তিত্বই খোঁজে পাওয়া যায়না। তো যা বলছিলাম তার জন্য কিনে আনা বইগুলো গত কিছুদিন থেকে প্রবল আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।

আগ্রহের পুরোটাই লোক দেখানো বলতে পুত্রকে দেখানোর জন্য। ওকে দেখলেই বইটা হাতে নিয়ে কপাল কুচকে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে পড়তে থাকি। আমার এই ভঙ্গি দেখে তাও যদি তার পড়ার আগ্রহ হয়। সে আমার কাছে এসে বইটা উল্টে দেখবে, বইটা তার পড়া থাকলে একটা রিভিউ দিবে। আর পড়া না হলে বলবে আপনি পড়েন বইটা।

ভালো হলে আমাকে গল্পটা বলিয়েন।
আমি চোখ ছোট করে বলি, কেন? আমি কেন বলবো? তুমি পড়ে গল্পটা জেনে নিও।
তার সোজাসাপ্টা উত্তর এইটা ঠিক না মা, একজন পড়লেই হয় গল্পটা, একটা গল্প জনে জনে পড়া লাগে নাকি?
হ্যাঁ একটা বই জনে জনে পড়বো। আমাদের পৃথিবী হবে বইয়ের, আমরা হব বইপোঁকা।
আমি প্রবল আগ্রহ নিয়ে একটা বই দিবসের অপেক্ষা করি। যেদিন সবার হাতে থাকবে থাকবে বই।

(পুনশ্চ: লোক দেখানো তথা পুত্রকে দেখিয়ে দেখিয়ে পড়তে গিয়ে আমি সত্যি সত্যি শিশুতোষ বইগুলোর প্রেমে পড়ে গেছি। প্রতিটা বই শেষ না করে উঠতে পারিনা।)

(ফারজানা ইসলাম লিনু গল্প কার ও শিক্ষক কন্টিবিউটর ব্রিটবাংলা)

Advertisement