বঙ্গবন্ধু, ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্রলীগ

। । অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। ।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঐতিহ্য, সফলতা, সংগ্রাম, আন্দোলন, গৌরব ও বিজয়গাথার ৭০ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ ৪ জানুয়ারি ২০১৭। ১৯৪৭-এর আগস্ট কলকাতার প্রগতিশীল তরুণ নেতা শেখ মুজিব তার সমমনাদের নিয়ে চলে এলেন ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৪ সাল থেকেই ঢাকায় ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ নেতার সক্রিয় অংশগ্রহণে খাজা নাজিমউদ্দীন এবং আহছান মঞ্জিল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী ধারা গড়ে উঠেছিল। ১৯৪৭-এর আগস্টের পর শেখ মুজিব এবং তার অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসঙ্গী ঢাকায় এসে এতে যোগদান করায় সে প্রতিবাদী ধারা আরও জোরদার হয়ে উঠল। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তান কালের রাজনৈতিক কর্মকা-ের শুরু ১৫০ নম্বর মোগলটুলির ‘পার্টি হাউস’ থেকে। তার সমকালীন রাজনৈতিক সহযোগী তরুণ রাজনীতিক কমরুদ্দীন আহমদ তার গ্রন্থে এ সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘আবুল হাশিম সাহেবের প্রেরণা পেয়ে পার্টি হাউস গঠন করা হলো ১ এপ্রিল, ১৯৪৪ সালে ঢাকার ১৫০ নম্বর চক মোগলটুলিতে। তিনতলা বাড়ির নিচতলায় কাগজের দোকান হায়দার সাহেব নামে এক ভদ্রলোকের। দোতলায় অফিস আর তিনতলায় সর্বক্ষণ কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা এবং কনফারেন্স রুম।’ ১৯৪৭ সালের আগস্টের পর ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে পার্টি অফিসকে কেন্দ্র করে আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী অনুসারী তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা একত্রিত হতে থাকেন।
এই অফিসটি ঢাকায় অবস্থিত থাকলেও সারা পূর্ববাংলায় নাজিমউদ্দীন সরকারবিরোধী যুবকরা রাজনীতির ক্ষেত্রে তাকেই অবলম্বন করে নিজেদের প্রাথমিক কাজকর্ম পরিচালনা করেন। ১৯৪৩-এর আগস্টের পর শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, শওকত আলী, মুহম্মদ আলমাস, মোহাম্মদ আউয়াল প্রমুখ নাজিমউদ্দীনবিরোধী তরুণ কর্মীরা এই অফিসকে কেন্দ্র করে ‘পূর্ববাংলার নতুন রাজনীতি গঠন’ চিন্তায় নিযুক্ত ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সমমনা সাথীরা কলকাতা থেকে এসে সেই রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করেন।

কমরুদ্দীন আহমদ তার গ্রন্থে বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা থেকে অনেক ছাত্র এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে থাকে এবং শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মোগলটুলি অফিসে ওয়ার্কার্স ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। শামসুল হক সাহেব ওই ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কনভেনর হন।
ছাত্রকর্মীরা শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এর কারণ বিশ্লেষণে কমরুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘শেখ সাহেব শামসুল হকের তুলনায় সে যুগে অনেক বেশি বাস্তবধর্মী ছিলেন, তিনি প্লেটোর মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রতিমূর্তি ছিলেন না। তিনি সেই যুবক বয়সেও অ্যারিস্টেটলের মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা প্রতিমূর্তির মতো ছিলেন। আদর্শের চেয়ে দৈনন্দিন জীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রতি তার দৃষ্টি ছিল বেশি। শেখ সাহেব তত্ত্বের বা মতবাদ প্রচারের চেয়ে বাস্তবজীবনের সংগ্রামে বেশি বিশ্বাসী ছিলেন। তাত্ত্বিক আলোচনার সময় ব্যয় না করে কর্মরত থাকায় বিশ্বাস করতেন। তার চোখে-মুখে একটা দীপ্তি ছিল। কর্মীদের মধ্যে, ভবিষ্যৎ যে তার হাতের মুঠোয় আসতে বাধ্য সে বিশ্বাস জন্মানোর ক্ষমতা তার ছিল, যেসব কর্মী তার সান্নিধ্যে যেত তাদের সঙ্গে একটা কল্পনার সুখী সমাজের স্বপ্ন সৃষ্টি করার শক্তি ছিল।’
যে সংগঠনটি ‘তৎকালীন পূর্ববাংলায় আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তনের’ শুভ সূচনা করে, ছাত্রযুব কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে এবং যা গঠনে শেখ মুজিব তার সমমনা তরুণদের সঙ্গে মিলে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা হলো গণতান্ত্রিক যুবলীগ। প্রকৃতপক্ষে এই সংগঠনটির জন্ম হয় ১৯৪২ সালে কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হলে। শেখ মুজিব, কাজী মোহাম্মদ ইদরিস, শহীদুল্লা কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রমুখ তৎকালীন ছাত্র ও যুবকর্মীরা পাকিস্তানে এবং বিশেষ করে পূর্ববাংলায় তাদের রাজনীতির ধারা ঠিক করার জন্য বৈঠকে মিলিত হয়ে যে আলোচনা করেন, সিদ্ধান্ত নেন তারই ধারাবাহিকতায়। ‘পূর্ববঙ্গ ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই বৈঠকটি ছিল ঐতিহাসিক। কারণ পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও তার উপযুক্ত সংগঠন গড়ার জন্য এই বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।’ শেখ মুজিবসহ এই ছাত্রনেতারা ঢাকায় এসে ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে ছাত্রযুব নেতা কমরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ, নূরুদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ‘আলোচনায় সম্পূর্ণ মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পূর্ববাংলায় নতুন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মকা- শুরু করা ও নীতিনির্ধারণের জন্য একটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য তারা একমত হন। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন পূর্ববাংলার ছাত্রযুব কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। এই লক্ষ্যে পূর্ববাংলাকে কতগুলো এলাকায় ভাগ করা হয়। উপরোক্ত নেতৃস্থানীয় ছাত্র যুবকর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক সফর শুরু করেন। সব অঞ্চল থেকেই আশাতীত সাড়া পাওয়া যায়। এমন অবস্থায় ১৯৪৭ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মীদের এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের তারিখ ঠিক করা হয়। কিন্তু তখন এই ধরনের সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি ছিল না। সে পরিস্থিতি সম্বন্ধে গণতান্ত্রিক যুবলীগের অন্যতম উদ্যোক্তা কমরুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘তখন সাহেবে আলম (খাজা নাজিমউদ্দীনের ভাই) ঢাকার গু-াদের নিয়ে আমাদের (প্রগতিশীল ছাত্র গ্রুপ) আক্রমণের চেষ্টা করছে। এমনকি শেরেবাংলা একে ফজলুল হক সাহেব নিরাপত্তার জন্য কাদের সরদার সাহেবের একটি ঘরে বাস করেছেন এবং সেখানে বসেই ওকালতি করেছেন।
কলকাতা থেকে দেশ বিভাগের (১৯৪৭) পর পরই যারা ঢাকায় চলে আসেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুর রহমান চৌধুরী, জহিরুদ্দিন, নূরুদ্দিন আহমেদ, কাজী গোলাম মাহবুব, কাজী আহমেদ কামাল প্রমুখ। তারা সবাই ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী। শেখ মুজিব ঢাকায় এসেই গণতান্ত্রিক যুবলীগের সঙ্গে যুক্ত হন। শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, কমরুদ্দীন আহমদ, নইমুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ এবং অলি আহাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের এখানেই ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়। মুজিব ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ওই সময় পূর্ববাংলায় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিরোধের সূত্রপাত হয়। শেখ মুজিব রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে দৃঢ় ভূমিকা নিয়েছিলেন। এ সময় শেখ মুজিবের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মকা-ের মধ্যে ’৪৮-এর ভাষা আন্দোলনে খাজা নাজিমউদ্দীনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ এবং কারাবরণ উল্লেখযোগ্য।
যেহেতু রাজনীতিতে তখন তরুণরা সক্রিয়, বলিষ্ঠ এবং অগ্রগামী ভূমিকা রাখতে শুরু করেন তাই এসব ঘটনা তাদের মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। এদের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষত রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তরুণদের বিদ্রোহী করে তোলে। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি তাতে বলেছেন, ‘তখন একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল মুসলিম লীগ। আমরা ভাষার ওপর আঘাত সহ্য করতে পারলাম না, এর ফলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ওই সময় পূর্ববাংলার প্রতি পাকিস্তান সরকারের আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গি পূর্ববাংলার ছাত্রনেতাদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ সুষ্টি করে।’ বাংলাদেশকেন্দ্রিক ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যারা উদ্যোগ নেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ওই সময়ের আর একজন ছাত্রনেতা ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বক্তৃতায় ছাত্রলীগের জন্ম প্রক্রিয়ার বিস্তৃত বিবরণ দেন। তিনি, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও কয়েকজন নিখিল পূর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক খাজা নাজিমউদ্দীন সরকারের সমর্থক শাহ আজিজুর রহমানের কাছে যান। তারা তাকে ওই সংগঠনের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বানের অনুরোধ জানালে তিনি তাতে রাজি হননি। মোগলটুলির কর্মী শিবিরের কর্মীদের শেখ মুজিবুর রহমান নতুন ছাত্র সংগঠনের প্রস্তাব দেন এবং প্রস্তাবে সমর্থন দিতে আহ্বান জানালে সবাই সাড়া দেন। নেতৃস্থানীয় কর্মীদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, নইমুদ্দীন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, আবদুল মতিন প্রমুখ সভায় যোগদান করেছিলেন। এই সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। অলি আহাদ এবং মোহাম্মদ তোয়াহা সংগঠনের ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেওয়ার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করলে শেখ মুজিবুর রহমান তার বিরোধিতা করে বলেন, এই সময় এটা বাদ দেওয়া সঠিক পদক্ষেপ হবে না, সরকার এর ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। তবে পরে সময় অনুকূল হলে বাদ দেওয়া হবে। আবদুল মতিন শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য সমর্থন করেন। ‘মুসলিম’ শব্দটি রাখা হলো। ছাত্রলীগের বিদ্রোহী নেতাকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল মিলনায়তনে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিলিত হয়েছিলেন। সভাপতিত্ব করেন নাজমুল করিম। এ সভায়ই পুরনো নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নাম থেকে ‘নিখিল’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। বিদ্রোহী গ্রুপটি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে পরিচিত হয়। নইমুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে এই সংগঠনের অস্থায়ী কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। পুনর্গঠিত ছাত্রলীগের শুধু নতুন কমিটি হলো না, নতুনভাবে আদর্শায়িতও হলো এই ছাত্রলীগ। দলের নাম ‘মুসলিম’ শব্দটি থাকলেও ছাত্রলীগের এই অংশের অধিকাংশ নেতাই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। ফলে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে আর এর উত্তরাধিকার ঐতিহ্য থাকল না, নতুনভাবেই ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি কার্যত ভিন্ন একটি ছাত্রলীগ জন্ম নিল।
নতুন আদর্শে ছাত্রলীগের জন্ম পূর্ববাংলার শুধু ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসেই নয়, জাতীয় রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এটিকে ১৯৪৭-পূর্ব সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বলিষ্ঠ অবস্থান বলে অভিহিত বা চিহ্নিত করা যেতে পারে। নতুন কেন্দ্রীয় অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটির তালিকা নিম্নরূপ :
নইমুদ্দীন আহমদ (রাজশাহী), আহ্বায়ক; সদস্যÑ আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী (চট্টগ্রাম), শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর), আজিজ আহমদ (নোয়াখালী), আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া), সৈয়দ নুরুল আলম (ময়মনসিংহ), আবদুল মতিন (পাবনা), দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), মফিজুর রহমান (রংপুর), অলি আহাদ (ত্রিপুরা), নওয়াব আলী (ঢাকা), আবদুল আজিজ (খুলনা) এবং নুরুল কবির (ঢাকা শহর)।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে এসব ছাত্রনেতা ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আবেদন’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্রে নতুন ছাত্র সংগঠন গড়ার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে প্রচারের জন্য বিলি করেন।
১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠক ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কী হবে সেই বিষয়ে আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বন্ধু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা হলো বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তখন বোঝা যাচ্ছিল বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস সভা করে এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল। সভায় ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করা হয় এবং সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জেলা সফর করে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আন্দোলন সংগঠিত করা হয়। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা পূর্ববাংলার ছাত্র সমাজকে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনের মাধ্যমে সংগঠিত করে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরিত্র উপলব্ধিতে সহায়তা করে, সর্বোপরি বৃহত্তর জাতীয় রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমান্বয়ে জাতীয় রাজনীতির কর্মকা-ে মনোনিবেশ এবং সম্পৃক্ত হয়ে জাতীয় রাজনীতিকের ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকেন। এ সময়টি ছিল শেখ মুজিবের জন্য জাতীয় রাজনীতিতে উত্তরণকাল। তিনি একদিকে ছাত্র সংগঠনের কর্মকা-ে যুক্ত ছিলেন, অপরদিকে জাতীয়ভাবে প্রয়োজনীয় সমস্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছিলেন। শেখ মুজিবসহ তরুণ নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও জনমত গড়তে থাকেন।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির পতাকাবাহী এই সংগঠন ৭০ বছরের দীর্ঘ পথচলায় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন এবং রক্ষার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থেকেছে নিয়ামক শক্তি হিসেবে। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, সর্বোপরি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের চালিকাশক্তির ভূমিকায় রচিত হয়েছে দেশ ও জাতির সব গৌরবগাথা।
স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর দেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী জাতির সংকটে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে শত বাধা-বিপত্তি এবং ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে। কখনো কখনো ছাত্র রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, প্রশ্ন তোলা হয় এর ভূমিকা নিয়ে। সমালোচনা, পর্যালোচনা হতে পারে তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা অপরিসীম। আলোচনা হতে পারে কীভাবে ছাত্র রাজনীতিকে আরও আদর্শবান করা যায়, আরও কার্যকর করা যায় এবং কীভাবে কলুষমুক্ত করা যায়। যুগ যুগ ধরে তারুণ্য সমাজকে উদ্দীপ্ত করে। তরুণ ছাত্র সমাজ কোনো পরাভব মানে না, সততা, ন্যায়নিষ্ঠায় হয় বলীয়ান এবং ত্যাগের মহিমায় হয় উচ্চকিত। এ ভূখ-ের সব আন্দোলন-সংগ্রাম-যুদ্ধে-পুনর্জাগরণে ছাত্র রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেÑ যেখানে প্রধান নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ কর্মীদের অসম সাহস এবং ত্যাগী মনোভাবের কাছে বারবার পরাভূত হয়েছে স্বৈরাচার, মৌলবাদী শক্তি এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্র।
আজকের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একই ধারায় বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নে জীবনের সফল ঝুঁকি নিয়ে বাঙালি জাতির জন্য একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লড়াই-সংগ্রাম করে চলেছেন, জাতিকে নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছেন রূপকল্প-২০২১ এবং ২০৪১-এর উন্নত বাংলাদেশের। লক্ষ্যমাত্রা মেপে-মেপে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশÑ পরিগণিত হয়েছে বিশ্ববাসীর কাছে এক উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। বাধা-বিপত্তি এবং ষড়যন্ত্র ওতপ্রোতভাবে আছেই। গোটা বিশ্ব এক ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাদেশও সেখানে বিচ্ছিন্ন নয়। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মেধার, চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রযুক্তির, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তো আছেই। পাশাপাশি আছে জঙ্গিবাদ।
অতীতের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অগ্রসৈনিকের ভূমিকা রেখেছে ছাত্রলীগ এবং এর অসংখ্য নেতাকর্মী। বঙ্গবন্ধুকে যেমন আগলে রেখেছে ছাত্রলীগ সব আন্দোলন-সংগ্রাম-মুক্তিসংগ্রামে ঠিক একইভাবে তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আগলে রেখে বাস্তবায়ন করতে হবে আধুনিক উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন।
বাড়াতে হবে ছাত্রদের মর্যাদা, সাধারণ মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক। চিরকাল সাধারণ মানুষের ছাত্রদের প্রতি আলাদা শ্রদ্ধা আছেÑ তা যেন কোনোক্রমেই ক্ষুণœ না হয়। ছাত্র রাজনীতি যেন কখনো অপব্যবহারের শিকার না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ছাত্রকে সর্বদা মেধা বিকাশে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে শানিত হতে হবে, পিতা-মাতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে থাকতে হবে সচেতন। দেশপ্রেম থাকবে সব কর্মকা–চেতনার প্রেরণা।
জাতির পিতার নিজ হাতে গড়া, মানবতার জননী জননেত্রী শেখ হাসিনার লালিত ছাত্রলীগের তারুণ্যের খরস্রোতধারায় ভেসে যাবে সব অন্যায়, অবিচার, ষড়যন্ত্র আর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিÑ বাস্তবায়িত হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার আধুনিক উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন।
 অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান : ভাইস চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement