বছর শেষ হচ্ছে কোভিডের সদ্য গবেষণালব্ধ বিজ্ঞান‌‌ ভিত্তিক একটি সুখবর দিয়ে

Dr. Zaki Rezwana Anwar FRSA

অমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি আসার পর থেকেই দুটো কারণে আমরা চিন্তিত ছিলাম। প্রথমটি হচ্ছে অমিক্রনের উচ্চ সংক্রমণের হার এবং দ্বিতীয়টি হল অমিক্রনের ভ্যাকসিনকে ফাঁকি দেওয়ার সম্ভাবনার কথা।
প্রথম দিকেই ল্যাবরেটরিতে ইনভিট্রো (টেষ্ট টিউবে) পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা জেনে গিয়েছিলাম যে প্রচলিত ভ্যাকসিন অমিক্রনের বিরুদ্ধে কম এন্টিবডি তৈরী করে। তবে আমরা এও বলেছিলাম যে, স্পাইক প্রোটিনে এতগুলো মিউটেশন হওয়াতে অমিক্রনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি কম তৈরী হলেও ভ্যাকসিন শরীরে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী T cell ও B cell তৈরী করে কিনা সেটা জানতে হলে আমাদের বেশ কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে ইন্সিটিউট  অফ ইনফেকশাস ডিসিস এন্ড মলিকিউলার মেডিসিনের একটি গবেষণার ফল জানা গেছে যা নতুন বছরে প্রকাশিত হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার গবেষণাটিতে  অংশগ্রহণকারীদের তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথম গ্রুপটিকে জনসন এন্ড জনসনের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল; দ্বিতীয় গ্রুপটিকে ফাইজারের  ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল; আর তৃতীয় গ্রুপটি কোনো ভ্যাকসিন নেয়নি, তবে তারা সদ্য অমিক্রন দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আরোগ্য লাভ করেছিল।
সুখবর হচ্ছে এই তিনটি গ্রুপের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অমিক্রনের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন দু’ধরনের ( CD4 এবং CD8)  শক্তিশালী T cell তৈরী করে। প্রথম ধরনের T cell (CD4) সরাসরি ভাইরাসটিকে ধ্বংস করে ফেলে এবং দ্বিতীয় ধরনের T cell (CD8) B cell-কে এন্টিবডি তৈরী করতে সাহায্য করে। এটি শুধু যে ভ্যাকসিন দ্বারা তৈরী ইমিউনিটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়, এটি অমিক্রন দ্বারা আক্রান্তদের (natural immunity) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অমিক্রনের বর্তমান উচ্চ সংক্রমণের ভেতরে এটা যে কত বড় একটি স্বস্তিদায়ক সংবাদ ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
এ কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকা ও বৃটেনে আমরা দেখেছি অমিক্রনে আক্রান্ত হলেও বেশীরভাগ লোক গুরুতর অসুস্থ হয়নি বা তাদের হাসপাতালে কম যেতে হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, বৃটেন ও ইসরাইল- এই তিনটি দেশেই হাসপাতালে ভর্তি অমিক্রন রোগীদের ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে। বিযষয়টি হচ্ছে হাসপাতালে ভর্তি অমিক্রন রোগীদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে incidental case অর্থাৎ তারা অন্য কোনো কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী তাদের টেষ্ট করায় অমিক্রন ধরা পড়েছিল। হাসপাতালে অমিক্রন রোগীদের অল্প সংখ্যকই ভর্তি হয়েছিল অমিক্রনজনিত জটিলতার কারণে (true case)। সদ্য পাওয়া গবেষণার ফলাফলের সাথে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ব্যাপারে এই পর্যবেক্ষণটির  মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ শক্তিশালী T cell তৈরীর হওয়ার কারণেই বেশীরভাগ আক্রান্তদের অবস্থা বেশী গুরুতর হয়নি। আরো একটি সুসংবাদ হচ্ছে অমিক্রনের ক্ষেত্রে ক্রস রিয়েকটিভিটি ক্ষমতা বেটা বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মতই।
এই ক্রস রিয়েকটিভিটির বিষয়টি পাঠকদের একটু ব্যাখ্যা না করলেই নয়। বৃটিশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার যিনি ভ্যাকসিনের প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত ছিলেন তাঁর একটি অভিজ্ঞতার গল্প বললেই বোঝা যাবে এই ক্রস রিয়েকটিভিটির বিষয়টি। তিনি তাঁর গোয়ালিনীর ছেলে জেমস ফিপসের হাতের মাংসপেশীতে গরুর বসন্ত (cow pox) রোগের জীবাণু  ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তা থেকে জেমস ফিপসের দেহে cow pox – এর বিরুদ্ধে immunity তৈরীর হয়েছিল। Small pox ও cow pox- এর মধ্যে মিল থাকায় জেমস ফিপসের দেহে cow pox এর পাশাপাশি small pox এর বিরুদ্ধেও immunity গড়ে উঠেছিল। । যেমন ফ্লুর একটি ভ্যারিয়েন্টের সাথে আরেকটি ভ্যারিয়েন্টের মিল থাকায় ফ্লুর ক্ষেত্রে আমাদের দেহে কিছুটা ক্রস ইমিউনিটি তৈরী হয়। একেবারে অন্য ধরনের ভাইরাস হলে অবশ্য জেমস ফিপসের দেহে ক্রস ইমিউনিটি তৈরী হতো না, যেমন ১৯১৮/১৯১৯ সালে যখন তথাকথিত স্পেনিস ফ্লু প্যান্ডেমিক হয় তখন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটি নতুন ছিল এবং তার বিরুদ্ধে কোনো ক্রস ইমিউনিটি ছিলনা।
অমিক্রনের ভয়াবহতার চাইতেও বর্তমানে বেশী চিন্তার কারণ হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে ষ্টাফ সঙ্কট যেটি আরো প্রকট হয়েছে সবার একসঙ্গে আক্রান্ত হওয়া এবং অনেকের একসঙ্গে আইসোলেশনে যাওয়ার কারণে। তবে বৃটেনে আগামী কয়েকদিনের মৃত্যুর সংখ্যা দেখে কোনো উপসংহারে পৌঁছোনো ঠিক কাজ হবে না। কারণ ক্রিসমাস ও নতুন বছরের ছুটীতে অনেক ড্যাটা বিশেষ ক’রে মৃত্যুর হিসেব প্রতিদিন সরকারি ভাবে রেজিষ্টার করা হয়ে উঠে না। ছুটীর কারণে কখনো দু’তিন দিনের হিসেব একসাথে করা হয়ে থাকতে পারে। তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর থেকে আবার নিয়মিত হিসেব পাওয়া যাবে এবং ততদিনে অমিক্রন ডেল্টাকে প্রায় বিতাড়িত ক’রে ফলবে ( প্রথমে লন্ডনে ও ধীরে ধীরে লন্ডনের বাইরে), আর তখনই হয়তো আমরা দেখতে পাব যে সংক্রমণের হার বেশী থাকলেও দেখা যাবে মৃত্যুর হারের নিম্নগতি। দক্ষিণ আফ্রিকার মতই হয়তো বৃটেনে সংক্রমণের হারও নেমে আসবে। ২০২২ সালে পৃথিবী সুস্থ্য হয়ে উঠবে সে প্রত্যাশা-ই আমরা কোরতে চাই।
লেখক : Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA একজন চিকিৎসক, সংবাদ পাঠক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
Advertisement