বাবা ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি

এস এম এ রাশীদুল হাসানএস এম এ রাশীদুল হাসান

 

:: রোকাইয়া হাসিনা ::

আমার বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশীদুল হাসানকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৮’ প্রদান করা হয়েছে। দেশের জন্য তাঁর আত্মত্যাগে রাষ্ট্রের এই স্বীকৃতি আমাদের জন্য বিশেষভাবে আনন্দদায়ক এ জন্য যে, বাবার এই স্বীকৃতি আমাদের মা দেখতে পেলেন।

বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজাকার, আলবদর ও আলশামস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তার ২২ দিন পরে বাবার গলিত লাশ মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। তাঁর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায়। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে তাঁকে বীরভূমে চলে যেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে ঢাকায় থেকে যান। তিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ব্যক্তি ছিলেন, ছিলেন দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী।

বাবা ১৯৬৫ সাল থেকে নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ছয় দফা দাবি নিয়ে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গনের কথা লিখেছেন। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঘোষণা করেন, তিনি সামনের নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। সেদিন বাবা ডায়েরিতে লিখলেন: ‘দেশের জনগণ ও তাদের স্বার্থ উপেক্ষা করে কেহই বেশি দিন শাসনের আসনে টিকে থাকতে পারে না। সত্যিকার দেশ-শাসকের শক্তির উৎস সব সময় জনগণ, শাসক হবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, তার ওপর জনগণের আস্থাই হবে তার শক্তির ভিত্তি। সত্যিকার শাসক সব সময় জনগণের সেবক, প্রকৃত প্রস্তাবে খাদেম বা ভৃত্য।’

১৯৬৯ সালের মার্চে পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক চলছে। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গেছেন। দেশের মানুষ ফলপ্রসূ কোনো সংবাদ পাচ্ছে না। বাবা ১২ মার্চ ১৯৬৯ সালে লিখলেন: ‘সারা দেশে অশান্তি ও বেদনার্ত ভাব। দেশজননী যেন নতুন জন্মবেদনার প্রহর গুনছে। ড. শামসুজ্জোহার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমাদের ধর্মঘট অব্যাহত রয়েছে। ওদিকে পিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক চলছে। কোনো অগ্রগতির খবর এ পর্যন্ত পাইনি। তবে শুভেচ্ছা ও প্রত্যাশার খবর পাচ্ছি। গভীরতর কোনো লেখাপড়ার কাজ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কাজ করাও বুঝি সম্ভব নয়। অন্তরের প্রার্থনা দিয়ে দেশের মঙ্গল কামনা করছি।’

বাঙালি যে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করবে এবং স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা হবে, তা বাবা ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ১৯৬৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি লিখলেন: ‘১৯৬৯ সন বিদায় নিল। পূর্ব বাংলার ইতিহাসে বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এই বিগত সন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৭০ সনে আমাদের যে আশা ও আনন্দের গুঞ্জনধ্বনি আমরা শুনছি, তার বীজ বোনা হয়েছিল আমাদের শত শত কিশোর ও তরুণের তাজা রক্তে এই ১৯৬৯ সনে। অমর ১৯৬৯! স্বাগত ১৯৭০!’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী বাবাকে গ্রেপ্তার করে এবং বিচারের জন্য ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখে। আমাদের এ দেশে কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না। আমরা ভাইবোন সবাই ছোট ছিলাম। আমার মা পাগলের মতো প্রভাবশালী শিক্ষক ও সেই সময়ের উপাচার্যের কাছে ধরনা দেন এবং বাবাকে মুক্ত করার ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য আবেদন ও নিবেদন করেন। মা বুঝতে পেরেছিলেন এঁরা বাবার মুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী নন। আসলে এরাই বাবাকে হানাদারদের হাতে তুলে দিয়েছে।

বাবা ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হয়েও আচার-আচরণে, চিন্তা-ভাবনায়, বেশভূষায়, কথাবার্তায় পুরোপুরি একজন খাঁটি বাঙালি ছিলেন। বাবার স্বপ্ন ছিল তাঁর মেয়ে বড় হয়ে রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী হবে। পাকিস্তান আমলে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। সে সময় রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থাকতে হতো। তথাপি বাবা আমাকে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে গড়ে তুলছিলেন। বাবা যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন। যেটা ভাবতেন বা ভালো মনে করতেন তা যুক্তি দিয়ে, মেধা দিয়ে অন্তরে ধারণ করতেন। আর সেটা তাঁর কর্মক্ষেত্রে ও সংসারজীবনে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করতেন। তাই সরকারি বাধা সত্ত্বেও বাবা আমাকে রবীন্দ্রনাথের গান শিখতে উৎসাহ দিতেন। বাবা উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালি জাতিসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং বিশ্বের দরবারে বাঙালি হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে রবীন্দ্রনাথ একটি বড় মাধ্যম।

স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার এবং শহীদদের অবহেলা করার নানা প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। শহীদদের ত্যাগকে নানাভাবে খাটো করার অপচেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। জাতি শহীদদের প্রতি সম্মান দেখাতে শুরু করেছে। আশা করি, রাষ্ট্র পর্যায়ক্রমে সব শহীদ বুদ্ধিজীবী ও শহীদের ত্যাগের স্বীকৃতি দেবে।

রোকাইয়া হাসিনা: শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশীদুল হাসানের কন্যা ও রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী

Advertisement