বিএনপির গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তনের এটাই শেষ সুযোগ

অধ্যাপক হারুন–অর–রশিদ:: ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জাতির প্রত্যাশা ছিল এই নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক হয়। তা–ই হচ্ছে, নিবন্ধিত এমনকি অনিবন্ধিতরাও ভিন্ন উপায়ে এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

এখন পর্যন্ত নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ সহনশীল। যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে নির্বাচনের আগে তিন-চারজন নিহত হয়েছে। একটি প্রাণহানিও কাম্য নয়। তবে আমাদের দেশ ও ভারতে নির্বাচনের যে অভিজ্ঞতা, তাতে দেখা যায়, শত চেষ্টা সত্ত্বেও নির্বাচনকালীন সহিংস ঘটনা ঘটে। আমাদের স্থানীয় নির্বাচনেও এর চেয়ে অধিকসংখ্যক প্রাণহানি ঘটে থাকে।

এখন প্রায় সর্বত্র আলোচনার বিষয় হচ্ছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। আমি বলব, এটা আপেক্ষিক বক্তব্য। এবারের পরিবেশ, পরিস্থিতি বহুলাংশে ভিন্ন। প্রধান বিরোধী দল এবং কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছে, প্রতিকূল অবস্থানে থেকে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এই প্রতিকূল অবস্থা বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন জোটের সৃষ্টি, তাদের রাজনৈতিক কৃতকর্মের ফল। গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ পরিহার করে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তারা যে সহিংস কর্মকাণ্ড ও সন্ত্রাসের তাণ্ডব চালায়, তাতে প্রায় ৫০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২২ সদস্য নিহত হন। এসব ঘটনায় অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অনেকে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে যায়। খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের মতো শীর্ষ নেতা দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় বিএনপি খাদের কিনারে নয়, খাদের গভীর গহিনে তারা পতিত। সহিংস কর্মকাণ্ডের ফলে দলটি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আর এমনি অবস্থার মধ্যে তাদের নির্বাচনে আসতে হয়েছে। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

তারপরও বলব, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন যেন নির্বিঘ্ন হয়। প্রত্যেক ভোটার যেন ভোট দিতে পারে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু এর অন্তরায় হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে নিয়ে নির্বাচনের মাঠে আসার বিষয়টি। নিবন্ধিত দল না হওয়ায় এবার জামায়াতকে ছাড়ার সুযোগ ছিল বিএনপির। কিন্তু আবারও প্রমাণিত হয়েছে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আত্মিক, আদর্শিক ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের। জামায়াতের ২২ প্রার্থীকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়েছে।

এ দেশের মানুষ খুবই রাজনৈতিক সচেতন এবং ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। আসন্ন নির্বাচনে যে বিপুলসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি ঘটবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই নির্বাচনকে আমি দেখি বিএনপিকে গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তনের সর্বশেষ সুযোগ হিসেবে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা মনে পড়ছে। তখন শিল্পী-সাহিত্যিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন জুগিয়েছিল। আজকের সমর্থনও প্রায় একই পর্যায়ের। প্রায় সব ব্যবসায়ী সংগঠন, শিক্ষক-সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা—সবাই উন্নয়নের পক্ষে এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছে।

সুষ্ঠু নির্বাচন করা নির্বাচন কমিশনের জাতীয় ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। তাঁদের দায়িত্ব পালনের ওপর জাতির অনেক কিছু নির্ভর করে। তাঁরা এমন কিছু করবেন না, যা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল বা ঘোলাটে করে। সম্প্রতি সিইসি এবং একজন কমিশনারের পারস্পরিক বাক্যবিনিময় অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। মতপার্থক্য থাকলে নিজেরা সমাধান করবেন, এভাবে গণমাধ্যমের সামনে হাজির হওয়া উচিত নয়।

একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হরণ, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা, জাতির পিতাকে হত্যা, জিয়াউর রহমান, মঞ্জুর এবং খালেদ মোশাররফকে হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, দেড় দশকের সামরিক শাসন, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী হওয়া, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা—এসব বিষয় মাথায় রেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে হবে। এসব অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এখনো অনেক সময় লাগবে।

১৯৯১ সালের পর এই প্রথম একটি দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাই এটাও দেখার বিষয়, একটি দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কতটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়।

Advertisement