বিদায় ২০২০ : ব্রিটেনসহ বিশ্বের স্মরণীয় কিছু ঘটনা

কামাল মেহেদী : বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর চীনের উহান থেকে শুরু হয়েছিল করোনা ভাইরাসের। এ কারণে এই ভাইরাসের নামকরণ হয় কোভিড ১৯। ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারী কোভিড ১৯ কে গ্লোভাল হেলথ ইমার্জেন্সি ঘোষণা করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। আর এই এক মাসেই চায়নায় মারা যান ২১৩ জন। সংক্রমিত হয় বিশ্বের প্রায় ১৮টি দেশে। ৩১শে জানুয়ারী ব্রিটেনে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়।
অন্যদিকে ২০১৬ সালের জুনের পর থেকে ব্রেক্সিট ছিল ব্রিটিশ রাজনীতির নিত্যদিনের সঙ্গি। এরই ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বরে ¯œ্যাপ জেনারেল ইলেকশনের মধ্য দিয়ে ২০১৯ সালকে বিদায় জানিয়েছিল ব্রিটিশ জনগন। সংসদে একক সংখ্যা ঘরিষ্টতা নিয়ে আসা ব্রেক্সিটিয়ার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের হাত ধরে ২০২০ সালের ৩১শে জানুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ ত্যাগ করে ইউকে।

জানুয়ারীতে রাজকীয় দায়িত্ব থেকে প্রিন্স হ্যারি এবং মেঘানের অব্যাহতি ছিল বেশ আলোচিত।

ফেব্রুয়ারীতে প্রধানমন্ত্রী বরিসের কেবিনেটের রদবদলও ছিল আলোচিত। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী উপদেষ্টাদের বরখাস্ত না করে নিজেই চ্যান্সেলার পদ ত্যাগ করেন সাজিদ জাভিদ। দায়িত্ব নেন ঋসি সোনাক। অন্যদিকে হোম সেক্রেটারী প্রীতি পাটেল সরকারী আচরণবিধি লঙ্ঘণ করেছেন বলে অভিযোগ করে পদত্যাগ করেন হোম অফিসের সিনিয়র কর্মকর্তা স্যার ফিলিপ রতম্যান। ফেব্রুয়ারীতেই বাবা হবার সুসংবাদও দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এ মাসেই করোনায় প্রথম ব্রিটিশ নাগরিকের মৃত্যু হয়।
মার্চের ১১ তারিখে করোনা ভাইরাসকে আনুষ্ঠানিকভাবে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আর ২৩শে মার্চ ব্রিটেনে জাতীয় লকডাউনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।

এদিকে এপ্রিলে ব্রিটেনে করোনা মোকাবেলায় জাতিকে উৎসাহিত করতে ভাষণ দেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রাণী সাধারণত বছরের ৪টি বিশেষ দিনে ভাষণ দিয়ে থাকেন। তাই এ ভাষণ ছিল ব্যতিক্রম। এদিকে ১২ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। আর শতবর্ষী ক্যাপ্টেন মুড়ের শত কদম হেটে এনএইচএসের জন্যে ৩২ দশমিক ৮ মিলিয়ন পাউন্ড ফান্ড রেইজ যেমন আলোচিত ছিল টিক তেমনি আলোচিত ছিল চ্যানেল এসের এম্বেসেডর হিসেবে বাড়ির আঙ্গিনায় রোজা রেখে শত কদম হেটে এনএইচএস এবং করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে বর্ষীয়ান কবি দবিরুল ইসলাম চৌধুরীর ফান্ড রেইজিংও। এপ্রিল থেকেই পিপিই স্বল্পতার কারণে হাসপাতাষের ডাক্তার, নার্স এবং কেয়ার ওয়ার্কার মৃত্যুর ঘটনা বেশ আলোচিত ছিল। অন্যদিকে এপ্রিলে লেবার লিডার জেরেমি করবিনের স্থলাভিষিক্ত হন স্যার কিয়ার স্টারমার।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর মে মাসে আইল অব ওয়াইটে পরীক্ষামূলকভাবে এনএইচএসের কন্টাক্ট ট্রেইসিং অ্যাপের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা বাতিল করা হয়। মে মাসেই লকডাউন আইন ভেঙ্গে আলোচনায় আসেন প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কিত সাবেক উপদেষ্টা ডমিনিক কামিংস।
দীর্ঘ লকডাউনের পর জুনে স্কুল খুলতে শুরু করে। ১৫ জুন থেকে ধীরে ধীরে লকডাউন শীথিল হতে থাকলেও সরকারী নিষেধ উপেক্ষা করে সমুদ্র সৈকত এবং ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্স আন্দোলনে লোকসমাগম বাড়তেই থাকে। জুনেই প্রথম বিস্ট্রলে ১৬ এবং ১৭ শতকের দাস ব্যবসায়ীর মুর্তি ভাঙ্গে ব্ল্যাক লাইভ মেটার্স আন্দোলনকারীরা।
তবে জুনে বড় অর্জন ছিল মার্কাস রাশফোর্ডের। তার ক্যাম্পেইনের ফলে ফ্রি স্কুল মিল বহাল রাখার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
জুলাই মাসে লকডাউন ধীরে ধীরে আরো শীথিল হতে থাকে। এ মাসে রাজকীয় একটি বিয়ে ছাড়া বিশেষ কিছু ছিল না। তবে জুলাই থেকেই দ্বিতীয় দফায় করোনা সংক্রমনের হার বাড়ার আশঙ্কায় লকডাউনের চাপ দিতে শুরু করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
অগাস্টে জিসিএসই এবং এলেভেল পরীক্ষা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের মুখে আবারো ইউটার্ন মারে সরকার। এলগারোদিম সিস্টেম নয় শিক্ষকদের পূর্বে দেওয়ার নাম্বারের ভিত্তিতে জিসিএস এবং এল লেভেলের ফলাফল ঘোষণা করা হয়।
করোনা সংক্রমন বাড়তে থাকায় সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডে রোল অব সিক্স জারি করেন প্রধানমন্ত্রী। অক্টোবওে বৃটেনে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। পাশাপাশি ইংল্যান্ডে তিন স্তরের করোনা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। অক্টোবরে বর্ষীয়ান এমপি জেরেমি করবিনকে লেবারপার্টি থেকে বরখাস্তের সংবাদটিও ছিল আলোচিত। এন্টিসেমিটিজম ইস্যুতে বরখাস্ত হওয়ার পর তাকে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
তবে রোল অব সিক্স এবং টিয়ার সিস্টেম বাদ দিয়ে নভেম্বরের ২ তারিখ থেকে দ্বিতীয় দফায় ইংল্যান্ডে জাতীয় লকডাউন জারি করেন প্রধানমন্ত্রী। তবে ডমিনিক কামিংসে টেন ডাউনিং স্ট্রীট ত্যাগের ঘটনাও কম আলোচিত হয়নি নভেম্বর। অন্যদিকে ব্রিটিশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর্কেডিয়া গ্রুপের প্রশাসন নিয়োগের ঘটনাও আলোচিত ছিল। ফ্রি স্কুল মিল খ্রিষ্টমাস পর্যন্ত বহাল রাখার জন্যে মার্কাস রাশফোর্ডের ক্যাম্পোইনের কাছে নভেম্বরেও সারেন্ডার করেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
একুশ শতকের ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগ ছিল ডিসেম্বরের আলোচিত ঘটনা। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ব্রিটেন ফাইজার-বায়োনট্যাকের করোনা ভ্যাকসিন সাধারণের মধ্যে প্রয়োগ করে। এদিকে ডিসেম্বরেই ব্রিটেন থেকে করোনার নতুন রূপ শনাক্ত হয়। ফলে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় ফ্রান্স। অন্তত ৪০টি দেশ ব্রিটেনের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ করে। অন্যদিকে নতুন রূপে করোনার ব্যাপক সংক্রমন ঠেকাতে লন্ডনসহ ইংল্যান্ডের বেশির ভাগ এলাকায় আরোপ করা হয় সর্বোচ্চ বিধি-নিষেধ টিয়ার ফোর। স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ওয়েলস এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে ক্রিষ্টমাস পার্টিকে সীমিত এবং কঠোরতার মধ্য নিয়ে আসা হয়।


অন্যদিকে দীর্ঘ প্রায় ১১ মাস পরে খ্রিষ্টমাসের আগের দিন সম্পন্ন হয় ব্রেক্সিট পরবর্তী বাণিজ্য চুক্তি। ৩০ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে এমপিরা অনুমোদন দেন এই চুক্তির। একই দিন অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনিকার করোনা ভ্যাকসিনের অনুমতি দেয় ব্রিটেন। আর বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর ব্রেক্সিট পরবর্তী বাণিজ্য চুক্তিটি আইনে পরিণত হয়।
এদিকে করোনা ভাইরাসের বাইরে বিশ্বে আরো কয়েকটি ঘটনা বেশ আলোচিত হয়েছে। এরমধ্যে একটি হল ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত অষ্ট্রেলিয়ার জঙ্গলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা। প্রায় ৪৬ মিলিয়ন একর ভূমি আগুনে পুড়ে। এতে ৩৪ জন মানুষসহ কোটি কোটি বণ্য প্রাণী মারা যায়।
তবে বছরের শুরুতেই অর্থাৎ ৩ জানুয়ারী ইরাকের বাগদাদে মার্কিন ড্রুন হামলায় ইরানের জেনারেল কাশিম সুলায়মানিকে হত্যার ঘটনা আরব বিশ্বকে জ্বালাময়ি করে তুলে। ৮ জানুয়ারী তেহরানে ইরানিয়ান ইসলামিক রেভোলেশনারী গার্ডের গুলিতে ইউক্রেনিয়ান যাত্রীবাহি বিমান ভূপাতিত হয়। এতে ক্রুসহ ১শ ৭৬ জন যাত্রী নিহত হন। আর ১০ জানুয়ারী পরলোকে গমন করেন ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাইদ। তিনি আরব বিশ্বে সবচাইতে দীর্ঘমেয়াদী সুলতান ছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ট ট্রাম্প সব সময়ই মিডিয়ায় আলোচিত ছিলেন। তবে ফেব্রুয়ারীতে ক্ষমতার অপব্যহারের অভিযোগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শুনানি ছিল বেশ আলোচিত।

ফেব্রুয়ারীতে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দিল্লীতে ১০ দিনব্যাপি দাঙ্গায় অন্তত ৫৪ জন নিহত হন। আহত হন প্রায় দুশ মানুষ। এদিকে পাকিস্তানের বিমান বিধ্বস্তে ১০৪ জন নিহতের সংবাদও বেশ আলোচিত ছিল। ২৫মে, মার্কিন পুলিশের হাতে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ব্ল্যাক লাইভ মেটার্স আন্দোলন।

করোনার ভয়াবহতার মাঝেই ৪ অগাষ্ট, লেবাননের রাজধানী বৈরুতের ভয়াবহ বিস্ফোরনের ঘটনা ঘটে। এতে ২ শ ৪ জন নিহত হন। প্রায় ২ হাজার ৭শ ৫০ টন রাসায়নিক দ্রব্য মজুদের গুদামের বিস্ফোরণের ফলে আহত হন ৬ হাজার ৫শ’র বেশি মানুষ। প্রায় ৩ লাখের বেশি মানুষ হোমলেস হন।

আর ৩ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় আলোচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনে মার্কিন ইতিহাসে দুটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এর মধ্যে একটি হল কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের ভোট কারচুপির অভিযোগ এবং মার্কিন ইতিহাসে প্রথম মহিলা এবং কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাস।
অন্যদিকে ফ্রান্স এবং অষ্ট্রিয়ায় ঘটে সন্ত্রাসী ঘটনা। কার্টুন একে মহানবী সা কে অবমাননার প্রতিবাদ হয় বিশ্বব্যাপি। ২৭ শে নভেম্বর ইরানিয়ান বিজ্ঞানীকে হত্যার বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচিত হয়।

বিদায়ী বছরে সর্বশেষ ফুটবলের কিংবদন্তী ম্যারাডোনার মৃত্যু কাঁদিয়েছে বিশ্ববাসীকে।

Advertisement