বিলেতে বঙ্গবন্ধু – ৫

এরেঞ্জ ঢাকা, ২৫ জুলাই, ৭.৩০ এ এম, ফ্লাইট পিআইএ-৭০৪!
আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রবাসী ছাত্র জনতাকে বিক্ষুব্দ করে তুলে।

তারা শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড তৈরি করে তাদের কার্যক্রম শুধু আইনী সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তারা অনেকবার পাকিস্থান হাই কমিশন অবরোধ ও দখল করে কালো পতাকা উত্তোলন করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা দেয়া, হাইড পার্কের স্পিকার্স কর্নারে সভা করে আইয়ূব খানের মুন্ডুপাত করা ইত্যাদি করে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করে পাকিস্থান সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে চাপের মুখে রাখেন।

১৯৬৮ সালের ৭ জুলাই এটিএম ওয়ালী আশরাফ, আনিস আহমদ, সুলতান মাহমুদ শরীফরা মিলে ১৮ জন ছাত্র পাকিস্থান হাইকমিশন অবরোধ করে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আদায়ের ঘোষনা দেন।

একই দিন সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক পাকিস্থান হাই কমিশনের চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয় অবরোধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার কারণে।

৮ জুলাই আবারো ঢাকা থেকে টেলিগ্রাম আসে যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ১৬ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।

১৪ জুলাই বিশাল এক সমাবেশের আহবান করা হয় পাকিস্থান হাই কমিশন ঘেরাওয়ের জন্য। ১২ জুলাই বিবিসি জানায় , ১৪ জুলাইয়ের পুরো কর্মসূচি তারা কাভার করবে। ১৪ জুলাই বিশাল এক মিছিল নিয়ে ঘেরাও করা হয় পাকিস্থান হাই কমিশন, আইয়ূব খানের কুশপুত্তলিকা দাহ, আইয়ূব খানের রচিত সংবিধান, তার আত্নজীবনী ফ্রেন্ড নট মাষ্টার ইত্যাদি পুড়ানো হয়। এই সমাবেশে কিছু ভাড়া করা পাকিস্থানী চেষ্টা করে হামলা চালানোর। এতে আহত হোন জাকারিয়া খান চৌধুরী।

সেদিনের বিক্ষোভ মিছিল, সভা সবকিছুই ব্রিটিশ মিডিয়া খুব ফলাও করে প্রচার করে। সেই সময় বাঙ্গালীরা জানতে পারেন যে, ২১ জুলাই অবকাশ যাপনের জন্য ব্রিটেনে আসছেন আইয়ূব খান। ফলে ২২ জুলাই মশাল মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে মিনহাজ উদ্দিন বলেন, মশাল মিছিলে আইয়ূব খানের অত্যাচার, শোষনের খতিয়ান নিয়ে আব্দুল বাসিতের ১০ পৃষ্টার ‘ব্ল্যাক বুক’ পুস্তিকা ২২ জুলাইয়ের মিছিলে বিলি করা হয়। একই দিন আমরা টমাস উইলিয়ামের ঢাকায় যাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করে নিরাপত্তা জনিত কারণে তার নাম প্রকাশ না করে ঢাকায় টেলিগ্রাম পাঠালাম : এরেঞ্জ ঢাকা, ২৫ জুলাই, ৭.৩০ এ এম, ফ্লাইট পিআইএ-৭০৪!
এদিকে আইয়ূব খান লন্ডনে এসে কোথায় উঠেছেন সেটা প্রথমে জানা না গেলেও ২৩ জুলাই জানা যায় তিনি উঠেছেন ক্লারিজ হোটেলে।

সেদিনের সেই ঘটনা আজো জ্বল জ্বল করছে সুলতান মাহমুদ শরীফের স্মৃতিতে, তিনিসহ মিনহাজ উদ্দিন, জাকারিয়া খান চৌধুরী, আব্দুল আজিজ বাগমার, সুবিদ আলী টিপু প্রমুখের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ জন সংগ্রামী ছাত্র জনতা ক্লারিজ হোটেল অবরোধ করেন, আইয়ূব খানের পদত্যাগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নি:শর্ত মুক্তি দাবি করেন।

কয়েক ঘন্টা অবরোধ থেকে শেষ পর্যন্ত হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে ক্রয়ডনের সেলসডন হোটেলে আশ্রয় নেয় আইয়ূব খান।
২৭ জুলাই সেই খবর ছাত্র জনতা জেনে দলে দলে বিশাল মশাল মিছিল নিয়ে সেই হোটেলও ঘেরাও করে তারা। শত শত মানুষের মশাল মিছিলের ঘটনা সেদিন ইংরেজদের মারাত্নক দৃষ্টি আকর্ষন করে।

ফলে আইয়ূব খানকে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। সেই ঘেরাও কর্মসূচির নেতৃত্বেও ছিলেন মিনহাজ উদ্দিন, জাকারিয়া খান চৌধুরী, সুবিদ আলী টিপু প্রমুখও।
এইসব আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড এর কার্যক্রম খুব গোপনে পরিচালিত হতে থাকে। পরিকল্পনা যাতে ফাস না হয় এবং সংস্লিষ্টরা যাতে বিপদে না পড়েন তাই সকল যোগাযোগ খুব গোপনে করা হতো। সকল প্রস্তুতি সম্পন্নর পর টম উইলিয়ামসের মামলা পরিচালনার খবর লন্ডন টাইমসে প্রকাশ করা হয়। এসময় পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আইনী লড়াইয়ের জন্য এগিয়ে আসেন ব্রিটেন থেকে পড়া শেষ করে ফেরত যাওয়া ব্যারিষ্টার কে জেড আলম, ব্যারিষ্টার শাখাওয়াত হোসেন, ব্যারিষ্টার আবুল খায়ের খান ও ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ।

তখন পর্যন্ত পাকিস্থানের আর কোন আইনজীবি এগিয়ে আসেননি। টমাস উইলিয়ামের ঢাকায় যাওয়ার খবর দেশ বিদেশে আলোড়ন তুলে। শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবের পক্ষে আইনী লড়াইয়ের জন্য আব্দুস সালাম খানের নেতৃত্বে আইনজীবিদের একটি প্রতিরক্ষা কমিটি তৈরি হয়। সেখানে ছিলেন, বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ, হামিদুল হক চৌধুরী, একে এম ব্রোহী। তখন টমাস উইলিয়ামের সহকারী ও সচিব হিসাবে কাজ করেন ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম ও ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ।
টমাস উইলিয়াম ২৫ জুলাই ঢাকায় পৌছান এবং ৩০ জুলাই ষড়যন্ত্র মামলার স্পেশাল ট্রাইবুনাল বেআইনিভাবে গঠিত হয়েছে পূর্ব পাকিস্থানে হাইকোর্টে আবেদন করেন এবং যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেন।

হাইকোর্টের এক রায়ে ট্রাইবুনালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে প্রবাসী বাঙ্গালীরা শুধুমাত্র আইনজীবি পাঠিয়ে বসে থাকেন নি। তাদের আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। ৬ আগষ্ট লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় টমাস উইলিয়ামের যক্তি তর্ক ও শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার তুলে ধরা হয়। এভাবে দেশে বিদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আন্দোলন রূপ নেয় গন অভ্যূথ্থানে! শেষ পর্যন্ত প্রবল চাপের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্তদের মুক্তি দেয়া হয়।
বিলেতে বাংলার রাজনীতি বইয়ের লেখক ও গবেষক ফারুক আহমদ বলেন, এই পুরো ঘটনা অন্যভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা গোড়াপত্তন করেন ১৯৫০-৬০ এর দশকে লন্ডনে অধ্যয়নরত প্রবাসী ছাত্র ও লন্ডন প্রবাসী বাঙ্গালীরা। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে সংকটময় মূহুর্তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় টমাস উইলিয়ামের নিয়োগের ব্যাপারে প্রবাসী বাঙ্গালী ও ছাত্র সমাজ এগিয়ে না এলে বঙ্গবন্ধু ও বাংলার ইতিহাস, বাঙ্গালীর ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো!

তথ্যসূত্র : বিলেতে বাংলার রাজনীতি, লেখক : ফারুক আহমদ

Advertisement