বিশ্ব আর্থিক সংকট-পরবর্তী এক দশক এবং বাংলাদেশের আর্থিক খাত

ড. আতিউর রহমান

বিশ্ব আর্থিক সংকটের প্রথম ধাক্কা লেগেছিল ২০০৭ সালের ২২ জুন। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত সেই সময়ের বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম বিনিয়োগ ব্যাংক ‘বিয়ার স্টার্নস’ ওই দিন থেকে পড়তে শুরু করে।

খেলাপি ঋণের চাপে ওই ব্যাংক ৪.২ বিলিয়ন ডলারের এক ঋণ কর্মসূচি তার ‘হেজ ফান্ড’কে দেওয়ার পরিকল্পনা প্রকাশ করে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর পুরো আর্থিক খাতে এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। এক বছরের মাথায় জেপি মর্গান চেইজ ব্যাংক ও মার্কিন সরকার ‘বিয়ার স্টার্নস’কে উদ্ধার করে। কিন্তু এর পরপরই ২০০৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘লেহম্যান ব্রাদার্স’ অক্কা পায়। আরো বহু বড় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যালান্স শিট খেলাপি ঋণের চাপে বিপর্যস্ত বলে বাজারে তথ্য আসতে থাকে। শুরু হয় আস্থার সংকট। অনেক বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সরকার উদ্ধার করবে বলে যে আস্থা জনমনে ছিল তা সহসাই ভেঙে পড়ে। এর পরের গল্প আমাদের সবারই জানা। যুক্তরাষ্ট্রের পুরো আর্থিক খাত নিয়ে টানাটানি শেষ না হতেই ইউরো অঞ্চলের বন্ড মার্কেটে সংকট দেখা দেয়। গ্রিস, স্পেন, আয়ারল্যান্ডসহ ইউরোপজুড়ে চলে তাণ্ডব। জাপানের অবস্থাও তথৈবচ। আর এসবের প্রভাব বিশ্বজুড়েই পড়তে থাকে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্ব আর্থিক মন্দার এই ধাক্কা তাদের মতো করে সামলে নেয়। বিশেষ করে এর এক দশক আগে এশীয় আর্থিক সংকট মোকাবেলার সময় তাদের যে শিক্ষাটি হয়েছিল, তা বেশ কাজে লাগে। ম্যাক্রো অর্থনীতির মৌল কাঠামো শক্তিশালী রেখে নানা মাত্রিক অন্তর্ভুক্তিমূলক মাইক্রো অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করে এশিয়ার দেশগুলো তাদের আর্থিক খাত স্থিতিশীল ও সম্মুখমুখী রাখতে সক্ষম হয়। ভারতের সংকট মোকাবেলার ধরন ছিল সন্তোষজনক। এমনকি বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশও তার ম্যাক্রো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অটুট রেখে নানা উদ্ভাবনীমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক কর্মসূচি চালু করে বিশ্ব আর্থিক মন্দাকে সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে বিশ্বের নজর কেড়েছিল। সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালার যে সমন্বয় ঘটিয়েছিল, তার সুফল দেশবাসী পেয়েছেন। এখনো পাচ্ছেন। ম্যাক্রো অর্থনীতির প্রায় সব সূচকের স্থিতিশীলতা রক্ষা করেও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত, বিশেষ করে রপ্তানি খাতের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যত নিজেকে একটি উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছিল। সরবরাহ ও চাহিদা তৈরির উভয় কাজে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাফল্য দেখিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের বাড়ন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, টাকার বিনিময় হার আশাতীতভাবে স্থিতিশীল ছিল। যার সুফল সামাজিক সূচক যেমন দারিদ্র্য নিরসন, গড় জীবনের আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার, ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার ইত্যাদি ক্ষেত্রে পড়েছে। এসবের কারণে সমাজে বেশ খানিকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে।
উন্নয়নশীল বিশ্বের এত সাফল্য সত্ত্বেও হালে বিশ্ব আর্থিক সংকট মোকাবেলায় বড় দেশগুলোর সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাফল্য নিয়ে অর্থনীতিবিদরা ফের প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। আর কে না জানেন, বিশ্ব আজ এক সুতায় গাঁথা। উন্নত বিশ্ব ও উদীয়মান বিশ্বের কোনো বিশেষ দেশে যদি আর্থিক সংকট ফের দেখা দেয়, তাহলে বিশ্বজুড়েই এর কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য। এই প্রেক্ষাপট মনে রেখেই আমরা সমকালীন বিশ্ব আর্থিক খাতের গতি-প্রকৃতি অনুধাবনের চেষ্টা করছি এই নিবন্ধে।

শুরুতেই বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রফেসর ড. কৌশিক বসুর একটি সাম্প্রতিক লেখায় বর্ণিত আশঙ্কার কথা বলতে চাই। ‘প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে’র অক্টোবর ১৮, ২০১৭ সংখ্যায় ড. কৌশিক বসু ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো একযোগ কাজ না করলে বিপদে পড়বে’ শিরোনামে লিখেছেন যে বিশ্ব অর্থনীতি ধীরে ধীরে হলেও বাড়ছে। আইএমএফ বলছে, এ বছর বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৫ শতাংশ। গত বছর তা ছিল ৩.২ শতাংশ। তবে এটিই শেষ কথা নয়। বিশ্বের বড় বড় সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত দশকজুড়েই খুব শিথিল মুদ্রানীতি পরিচালনা করেছে। শূন্য অথবা মাইনাস সুদের হারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে গিয়ে যে তারল্যের মহাসমুদ্র তারা তৈরি করেছে এর ফাঁদে বিশ্বকে পড়তেই হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে শুধু একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ ঢাললে এমনটি হতো না। বহু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এই অর্থ ঢেলেছে। সবাই মিলে গত ৯ বছরে ৩২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ বাজারে ছেড়েছে। সুদের হার কম রেখে আলাদা আলাদাভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো লাভবান হলেও বিশ্বের অর্থনীতির জন্য তারা সামষ্টিকভাবে এক বিরাট ঝুঁকি বা ফাঁদ তৈরি করেছে। কোনো একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে তার মুদ্রাকে নরম করে রপ্তানিকে উৎসাহ দিতে পারলেও সবাই মিলে তা করলে ব্যাংকিং খাতের ওপর বিরাট তারল্যের চাপ সৃষ্টি হবেই। তাই ইউরোপের ব্যাংকগুলোর ‘ইক্যুইটি মূল্য’ কমছে তো কমছেই। তা ছাড়া সামান্য অথবা নেগেটিভ সুদের হারের কারণে গ্রাহকদের কাছে নগদ অর্থ ধরে রাখার যৌক্তিকতা কমে যাচ্ছে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাই বাড়তি লাভের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের দিকে ধাবমান হচ্ছে। ফলে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ গত এক বছরেই বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০০৮ সালের আগ দিয়ে মর্টগেজ ঋণের বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাও কিন্তু এমনটিই ছিল। তাই ফের আরেকটি বিশ্ব আর্থিক সংকটের ঝুঁকি দিন দিনই যেন বাড়ছে।

এমন ঝুঁকির মধ্যে যাঁরা পেনশনভোগী তাঁরা তাঁদের পেনশন তহবিলের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত। তাই তাঁরা আরো বেশি করে বিকল্প সঞ্চয়ের পথ খুঁজছেন। এই ধারা যদি আরো সক্রিয় হয়, তাহলে তাঁদের ভোগের পরিমাণ কমতে থাকবে। ভোগ কমলে চাহিদাও কমবে। আর চাহিদা কমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও কমবে। মূল্যস্ফীতিও কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়বে না। অথচ ‘কোয়ান্টেটিভ ইজিং’ বা বাড়তি অর্থ ঢালার উদ্দেশ্য ছিল এর বিপরীত। ড. বসু আরো লিখেছেন, বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো একক দেশের পক্ষে এই ফাঁদ থেকে বেরোনোর সুযোগ নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এই নেতৃত্ব দিতে পারত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় সে সম্ভাবনার গুড়েবালি পড়েছে। তা ছাড়া জি-২০-এর দেশগুলোও এখন উন্নত ও উদীয়মান বড় অর্থনীতিগুলোর মুদ্রা ও রাজস্বনীতির ভেতর সমন্বয়ের সক্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে হয়তো প্রধান অর্থনীতিগুলোর মুদ্রা ও রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয় উদ্যোগ নেওয়ার সময় এসে গেছে। আর সে রকম সমন্বিত উদ্যোগ না নিতে পারলে প্রতিটি বড় অর্থনীতিই শুধু যে বিপাকে পড়বে তা-ই নয়, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোও এবার বিশ্ব আর্থিক মন্দার ঝাপটা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবে না। কেননা বাণিজ্যিক অর্থায়ন এখন আগের চেয়ে আরো বেশি করে সংযুক্ত হয়ে পড়েছে। তাই ফেডের মতো প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার সামান্য হেরফের হলেই চঞ্চল ডলার উল্টো পথে দৌড়াতে শুরু করবে। তৈরি হবে আর্থিক অস্থিতিশীলতা।

এ প্রসঙ্গে চীনের অর্থনীতির ঝুঁকির কথা এসে যায়। তার আগে উন্নত অথচ অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতি অস্ট্রেলিয়ার কথা বলি। অস্ট্রেলিয়াতে বাড়ি কেনার ধুম পড়ে গেছে। নানা ধরনের কর সুবিধা ও সুদের হার নিম্নগতির কারণে গৃহায়ণ ঋণ হু হু করে বাড়ছে। অথচ বেতন বা মজুরি বাড়ছে না। তাই ঊর্ধ্বমুখী বাড়ির দাম শোধ করা গৃহমালিকদের পক্ষে একসময় সম্ভব হবে না। যেমনটি যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালের দিকে ঘটেছিল। বাড়ি ফেলে মানুষ পালিয়ে গিয়েছিল।

এবারে চীন প্রসঙ্গে আসি। ইউরোপের অর্থনীতি এখনো জেগে ওঠেনি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধীরলয়ে বাড়ছে। গ্রিস বা ইতালির মন্দ ঋণের পাহাড় দৃশ্যমান। ঠিক এই সময় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। দেশটিতে ‘ছায়া ব্যাংকিং’ (ব্যাংক নয়, অথচ ব্যাংকের মতো কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত) প্রবল। তা ছাড়া জিডিপির ৩০০ শতাংশ ঋণগ্রস্ত দেশটি নিয়ে আইএমএফসহ বিশ্ব আর্থিক সংগঠনগুলোর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এমনকি চীনের সরকারও তার দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার প্রশ্নে চিন্তিত। চীনের প্রবৃদ্ধি এখন কমছে। এর সঙ্গে আর্থিক অস্থিতিশীলতা যোগ হলে পুরো বিশ্বে, বিশেষ করে এশিয়ায় বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাব্রিয়েল ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা অংশীদার রিচার্ড ভেইগ মনে করেন, আগামী পাঁচ বা ১০ বছর ধরে চীনের অর্থনীতি নিম্নমুখী ধারাতেই থাকবে। তাঁর মতে, দুটি কারণে চীনে আর্থিক সংকট দেখা দিতে পারে। এক. ব্যক্তি খাতের ঋণের হার জিডিপির অনুপাতে আগামী পাঁচ বছরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। দুই. ব্যক্তি খাতের মোট ঋণ জিডিপির অনুপাতে ওই সময়ে ১৫০ শতাংশেরও বেশি হারে বেড়ে যেতে পারে। তিনি মনে করেন, এ দুটি কারণে চীনে আর্থিক সংকটের আশঙ্কা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সত্যি হতে পারে।

এমন বিশ্ব বাস্তবতায় বিশ্বনেতাদের যেসব বিচক্ষণ নীতিমালার প্রতি সমর্থন দেওয়ার কথা, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় তা আশা করা মুশকিল। বরং তিনি উল্টোপথের যাত্রী। তাই এ সময়টায় ম্যাক্রো অর্থনীতির মাইক্রো পাটাতন শক্তিশালী না করে তিনি পুঁজিকে ছায়া ব্যাংকিংয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারেন। চীনে এই প্রবণতা আগে থেকেই প্রবল। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারে একদিকে চীনে ব্যাপক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ঘটলেও এসবের তত্ত্বাবধায়ন বা মনিটরিং খুবই দুর্বল। তাই সব মিলে বিশ্ব অর্থনীতি এক বিপজ্জনক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়েই ভুল খাতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, ব্যাংকারদের আগের মতোই সেলিব্রিটিদের মতো বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, অস্বচ্ছতার জন্য তাদের কাউকে জবাবদিহির মুখোমুখি করা হচ্ছে না, সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েই চলেছে, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব বিদ্যমান, রেগুলেটরি স্ট্যান্ডার্ডস এখনো যুগোপযোগী হয়নি, রেগুলেশন থাকলেও সেসবের পরিপালন লক্ষ করা যাচ্ছে না এবং আর্থিক প্রতিবেদন জনসম্মুখে স্পষ্ট করে প্রকাশ করা হচ্ছে না। এসবের কারণে গুণমানের ঋণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্যও জনগণ জানতে পারছে না। এসবের নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থার ওপর পড়ছে। তাই ড. কৌশিক বসুর মতো অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা—আরেকটি বিশ্ব আর্থিক সংকট কি তাহলে আসন্ন? এ প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে আর্থিক খাত নিয়ে দুনিয়াজুড়েই অস্বস্তি বাড়ছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই। আগেই যেমনটি বলেছি, অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশের আর্থিক খাত ২০০৮ সাল-উত্তর বিশ্ব আর্থিক মন্দা বেশ দক্ষতার সঙ্গেই মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে। বলা যায়, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের মাধ্যমে এক নয়া ধাঁচের উন্নয়নমুখী আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, বিভিন্ন আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারি গড়ে তুলে পিরামিডের নিচের দিকের মানুষগুলোর নাগালের মধ্যে আর্থিক লেনদেন পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেগুলেটরি আওতায় রেখে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, অ্যাপভিত্তিক লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ডিজিটাল রূপান্তর, মানবপুঁজির মানবিক রূপান্তর, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও সামাজিক দায়বদ্ধ ঋণ ও অন্যান্য সেবা পরিচালনায় বিচক্ষণ সব সংস্কার, গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নে অভিযোগ মীমাংসার প্রযুক্তি ও মানবিক সুব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থিক ভুবনে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। এ দেশের কৃষক, খুদে উদ্যোক্তা, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা, সবুজ উদ্যোক্তা, রপ্তানিকারকদের জন্য সস্তায় সহজে প্রাপ্য নানামুখী ঋণ কর্মসূচি চালু করে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সারা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পথশিশুসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার অংশীদার করা সম্ভব হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজে উদ্যোগ নিয়ে বর্গাচাষিদের অংশীদারির ভিত্তিতে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করেছে। বহুমুখী এসব কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি যেমন বেগবান হয়েছে, তেমনি আর্থিক গণতন্ত্রায়নের মাত্রাও বেড়েছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে আর্থিক স্থিতিশীলতায়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ক্রমবর্ধমান রিজার্ভ, স্থিতিশীল বিনিময় হার, বাড়ন্ত আর্থিক গভীরতা ও প্রসারতা এই স্থিতিশীলতাকে আরো জোরদার করেছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিচক্ষণ ও সাহসী নেতৃত্ব এবং সরকারের উঁচু মহলের নীতি সমর্থনের কারণে। আশা করছি, কোনো কারণেই যেন এই ধারা বিঘ্নিত না হয়। হালে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিয়ে বেশ কিছু অস্বস্তিকর পরিস্থিতির খবর গণমাধ্যমে উঠে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেগুলেশন উপেক্ষা করে ঋণ কেনাবেচা, ব্যাপক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, বিশেষ গ্রুপের কাছে বহু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা কেন্দ্রীভূত হওয়া, এমনকি নতুন লাইসেন্স পাওয়া কয়েকটি ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা ও তারল্য সংকট দেখা দেওয়ায় আর্থিক খাত নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। এ বিষয়গুলোর দিকে দ্রুত নজর না দিলে আর্থিক খাতকে ঘিরে যে ভরসার পরিবেশ গড়ে উঠেছিল, তা কিন্তু দ্রুতই উবে যেতে পারে। আর তেমনটি ঘটলে ফের আর্থিক মন্দা ঘটার যে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, তা ঠেকানো বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে যেতে পারে। তাই আর্থিক মন্দা ঠেকাতে কয়েকটি দিকে রেগুলেটরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

এক. যেকোনো মূল্যে উৎপাদনশীল খাতে ঋণদানে ব্রতী এবং ঝুঁকিপূর্ণ অনুৎপাদনশীল খাতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঋণ প্রদানে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে ভোক্তা ঋণ যেন অতিরিক্ত হারে না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ জন্য বিচক্ষণ মুদ্রানীতির কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে যখন খাদ্য মূল্যস্ফীতিসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন যথোপযুক্ত মুদ্রানীতি চালু রেখে বাজারের অতিরিক্ত তারল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

দুই. কোন খাতে কত ঋণ যাচ্ছে, বাস্তবে সেসব ঋণের ব্যবহার কতটা হচ্ছে তা নিরন্তর তত্ত্বাবধায়ন ও মনিটর করে যেতে হবে। প্রয়োজনে গুণমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চলমান ঋণ কর্মসূচির প্রভাব নিরূপণে ব্যাংগুলোকে উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে।

তিন. অংশীদারদের সঙ্গে আলাপের মাধ্যম মুদ্রানীতি প্রণয়নের চলমান ধারাকে আরো জোরদার করতে হবে। ম্যাক্রো অর্থনীতির মৌল কাঠামোকে সর্বদাই শক্তিশালী রাখতে হবে।

চার. ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতা আরো বাড়ানো এবং তাকে স্বাধীনভাবে তার কাজ পরিচালনায় সরকারকে উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে। একমাত্র শক্তিশালী, স্বাধীন ও দক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষেই সম্ভব গুণমানের ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা, খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা, ব্যাংক পরিচালকদের যোগসাজশে অনাকাঙ্ক্ষিত ঋণ প্রদানে রশি টেনে ধরা, খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা, প্রভিশন ঘাটতি কমিয়ে ফেলা, ব্যাংকের ব্যালান্স শিট পরিষ্কার রাখা, ব্যাংকের জনশক্তির দক্ষ ও সুস্থ সংস্কৃতির প্রসার ঘটানো। মোদ্দা কথা, ব্যাংকিং খাতের কেন্দ্রীভবন ছাড়াও উপর্যুক্ত অনৈতিক কর্মকাণ্ডের লাগাম টানা বর্তমানে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

পাঁচ. প্রযুক্তির এই যুগে আর্থিক খাতে ‘ফিনটেক’ ব্যবহারে অনীহার সুযোগ নেই। তবে তা হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেগুলেটরি আওতার মধ্যে। একই সঙ্গে এর ব্যবহারিক ঝুঁকির দিকটিও মাথায় রাখতে হবে।

ছয়. আগামী দিনের অর্থনীতি যেমন প্রযুক্তিনির্ভর হবে, তেমনি সবুজায়নের দিকেও ধাবিত হবে। তাই এই দুই দিকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেগুলেটরি চোখ তীক্ষ ও সহায়ক হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সামাজিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবেলার উদ্দেশ্যে যুগোপযোগী নীতিমালা জারি করেছে। সবুজ অর্থায়নের জন্য অর্ধশতাধিক সবুজ পণ্য চিহ্নিত করেছে। পর্যাপ্ত পুনরর্থায়নের সুযোগও সৃষ্টি করেছে। সময় এসেছে এসব নীতিমালার পর্যাপ্ত পরিপালনের এবং কার্যকর বাস্তবায়নের।

সাত. মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বয় আরো নিবিড় হতে হবে এবং সব সময়ই ‘ফিসকাল প্রুডেন্স’ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো অবস্থায়ই যেন রাজস্বনীতির কারণে মুদ্রানীতি পরিচালনায় কোনো বাধার সৃষ্টি না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের খেয়াল রাখতে হবে। ‘ফিসকাল ডেফিসিট’ সর্বদাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। তা না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। দুর্নীতিও বাড়বে।

আট. পার্টনারশিপ মডেলে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিঋণ, সবুজ অর্থায়ন, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানি উন্নয়ন ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। এই অংশীদারি যেন বজায় থাকে। সেদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সজাগ থাকতে হবে।

নয়. বিশ্বায়নের এই যুগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ফোরামগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাতে এর জনশক্তির দক্ষতাও বাড়বে।

দশ. মানবিক পুঁজি গঠনে প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও জ্ঞানের লেনদেনের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এই দিকগুলোকে সহায়তা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বর্তমানে চালু সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে।

এগারো. বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ট্রেড ফাইন্যান্স’ অনলাইনে ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে মনিটর করে থাকে। এনবিআরও অনলাইন ‘এসিকুডা’ চালু করেছে। দুদক এই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে কাজ করে বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচারের পথ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘বিএফআইইউ’ এখন বেশ সক্রিয়। তাকেও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে একযোগে অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যেতে হবে।

আরো অনেক কিছুই বলা যেত। তবে মোটা দাগের এসব নীতি সমর্থন ও কার্যক্রম চালু রাখা গেলে ফের কোনো বিশ্ব আর্থিক মন্দা এলেও আমরা আগের মতোই তার সঠিক মোকাবেলা করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর

Advertisement