বেদনা বিধুর জুন

।। কামাল মেহেদী।।
ক্যালেন্ডারের একটি মাসে কতোটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার পর সেই মাসটি ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকার মর্যাদা অর্জন করে, তা আমার জানা নেই। শুধু এইটুকু জানি ২০১৭ সালের জুন মাসটি কোনোভাবেই ভুলার নয়। ভুলা যাবে না। ভুলতে পারবো না। শুধু আমি নয়, বৃটিশ জনগন, বৃটিশ ইতিহাস এবং বিশ্ববাসি কেউই, ২০১৭ সালের জুনকে ভুলে থাকতে পারবে না। ম্যানচেস্টারের আত্মঘাতি বোমার ক্ষত নিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় জুন মাসটি আমাদের জীবনে প্রবেশ করেছিল। এরপর লন্ডনব্রিজের সন্ত্রাসী হামলা, মধ্যবর্তী নির্বাচন, গ্রেনফেল টাওয়ারের ভয়াবহতা এবং ফিন্সবারী পার্ক মসজিদের সামনে মুসল্লিদের উপর ভ্যান দেওয়ার ঘটনা! বিশেষ ২৪ তলা ভবনের ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়া শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষের আর্তচিৎকার বিভিষিকাময় দৃশ্য কোনোভাবেই এই জীবনে ২০১৭ সালের জুনকে ভুলতে দেবে না।

ম্যানচেস্টারের আত্মঘাতি হামলা


২২শে মে ছিল সোমবার। ম্যানচেস্টার এরিনায় হলিউড স্টার এবং কিশোর-কিশোরীদের স্বপ্নের গায়িকা এরিয়ানা গ্র্যান্ডের কনসার্টে জড়ো হয়েছিলেন তার ভক্তরা। ম্যানচেস্টার এরিনা প্রায় ২১ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। কনসার্ট চলার ফাঁকে আত্মঘাতি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় মুসলিম নামের কলঙ্ক, কুলাঙ্গার লিবিয়ান অরিজিনি সালমান আবেদি। ২২ বছর বয়সের সালমান নিজের সঙ্গে ২৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। পুরুষ-মহিলা, কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে ৮ বছরের শিশুও রয়েছে তাতে। এই ঘটনায় আহত হন প্রায় ২শ ৫০ জন। লিবিয়ার সাবেক শাসক গাদ্দাফি বিরোধী পরিবারের সন্তান ছিল সালমান আবেদি। ভয়াবহ এই শোক কাঁধে নিয়েই ক্যালেন্ডারের পাতায় মে মাসকে বিদায় জানিয়ে জুন মাসে প্রবেশ করি। আশা ছিল ২২শে মের শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে জেগে উঠবো আমরা। কিন্তু সেটা আর হল কই? জুন মাসটি প্রবেশ করতে না করতেই ঘটে গেল আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা। আবারো প্রাণ হারালেন নিরাপরাধ মানুষ। আবারো বিব্রত হন ইউকের মুসলিম কমিউনিটি।

লন্ডনব্রিজ সন্ত্রাসী হামলা :


৩রা জুন শনিবার। সামারের আলোঝলমলে সন্ধ্যা। থেমস নদীর উপর লন্ডন ব্রিজে পর্যটক এবং স্থানীয় মানুষের ভীড়। ফুটপাতের উপর পথচারীদের ভ্যান চাপা অতঃপর ছুরি দিয়ে কুপিয়ে মানুষ হত্যার চেস্টা… হামলাকারী শাজাদ খুরাম বাট, রাশিদ রেডাউন এবং জাগবা ইউসেফ। লন্ডন ব্রিজ এবং পাশ্ববর্তী বারা মার্কেটে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে ৮ জনকে হত্যা করে এই তিন কুলাঙ্গার। তাদের হামলায় আহত হন আরো প্রায় ৪৮জন। এর মধ্যে ২১ জনের অবস্থা ছিল গুরুতর। রাত প্রায় ১০টার দিকে এই হামলা চালায় মুসলিম নামধারী এই তিন কুলাঙ্গার। ১০টা ৬ মিনিটের মধ্যে স্বশস্ত্র পুলিশ এসে তিন কুলাঙ্গারকে গুলি করে হত্যা করে। মে মাসের ম্যানচেষ্টার এরিনার শোকে যোগ হয় লন্ডন ব্রিজ হামলা। এই দুই শোকাবিভুত ঘটনার মাঝেই জাতিকে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্যে।

৮ জুনের মধ্যবর্তী নির্বাচন :


গত ১৮ এপ্রিল হঠাৎ করেই ৮ জুনের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী থেরিজা মে। ৫৯ বছর বয়সী থেরিজা মে ২০১০ সাল থেকে টোরি সরকারের হোম সেক্রেটারী ছিলেন। ২০১৬ সালের জুনে ইইউ রেফারেন্ডামে রিমেইন ক্যাম্পেইন পরাজিত হবার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরন পদত্যাগ করেন। এরপর দলীয় এমপিদের ভোটে টোরি লিডার নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন থেরিজা মে। কিন্তু অন্য সবার চাইতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার চ্যালেঞ্জ ছিল ভিন্ন। এখনো সেই চ্যালেঞ্জের মধ্যেই আছেন তিনি। তাকে ব্রেক্সিট নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। ২০১৯ সালের ভেতরে সব দেনা-পাওনা বুঝে নিয়ে ইইউ ত্যাগের নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী থেরিজা মেকে। বিশাল একটি গুরু দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। আর তাকে বলা হবে বিণাভোটের প্রধানমন্ত্রী! সেটা কি আর হয়? ৮ জুনের নির্বাচনের আগে থেরিজা মে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন দলীয় এমপিদের ভোটে। জনগণের ভোটে নয়। ১৯১৬ সাল থেকে ইউকেতে ২৪টি প্রধানমন্ত্রীর টার্ম কেটেছে। এর মধ্যে ১২টি টার্মেই জাতীয় নির্বাচন ছাড়া প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেন। সাধারণ মানুষের ধারণা, থেরিজা মে ব্রেক্সিটের মতো কঠিন ইস্যুটি একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই সম্পন্ন করতে চান। তাই হঠাৎ করেই মধ্যবর্তী নির্বাচন দেন তিনি। লিডারশীপ নিয়ে অভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলায় থাকা লেবার ভালো সুযোগ করতে পারবে না বলেও এক ধরনের অহমিকা ছিল টোরির মধ্যে। অনেকের ধারণা এই সুযোগটাও কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন থেরিজা মে। কিন্তু ৮ জুনের নির্বাচনে তাঁর অবস্থা হয় লেজে-গোবরে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরনের নেতৃত্বে টোরি পার্টি ৩৩১টি আসনে জয় লাভ করে একক সংখ্যাঘরিষ্টতা নিয়ে বৃটিশ পার্লামেন্টে সরকার গঠন করেছিল। আর থেরিজা মের নেতৃত্বে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ১৩টি সিট হারিয়ে একক সংখ্যাঘরিষ্টতা হারায় টোরি। ৩১৮টি সিট নিয়ে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের অখ্যাত রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেটিক ন্যাশনালিষ্ট পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে হয়েছে টোরিকে। অন্যদিকে মধ্যবর্তী নির্বাচনে লেবার লিডার জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবার ৩০টি নতুন সিটে জয়লাভ করে। ২৬২টি সিট নিয়ে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের অবস্থানে আছেন জেরেমি। ২০১৫ সালের নির্বাচনে ২৩২টি সিটে পাশ করেছিল লেবার পার্টি। মধ্যবর্তী নির্বাচনে ৪ সিট বেড়েছে লিবডেমের। ২০১৫ সালের নির্বাচনে ছিল মাত্র ৮টি। অন্যদিকে ২০১৫ সালের নির্বাচনে ৫৬সিট নিয়ে বেশ দাপুটে অবস্থানে ছিল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি। আর ৮ জুনের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ২১টি সিট হারিয়ে মুকুটহীন প্রিন্সেসে পরিনত হন এসএনপি নেত্রী। ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর আকস্মিক মধ্যবর্তী নির্বাচনে টোরি আর এসএনপির সিট হারানোর বেদনা এবং জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবারের সিট বৃদ্ধির উল্লাসের কারণেই রাজনৈতিক স্মৃতি ফলকে ২০১৭ সালের জুন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু এই জয়-পরাজয়ের মাঝেই জুন বিদায় নেয়নি। নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে যখন কফির আড্ডা এবং টিভি-টকে নানান ব্যাখ্যা বিশ্লেষন চলছে, ঠিক তখনই ঘটে গ্রেনফেল ট্রাজেডি।

গ্রেনফেল টাওয়ার ট্রাজেডি :


পূর্বের সব শোক, ট্রাজেডি আর আলোচনাকে চাপিয়ে দিয়েছে গ্রেনফেল ট্রাজেডি। ওয়েস্ট লন্ডনের কেনসিংটন এবং চেলসি বারার নর্থ কেনসিংটনের বহুতল ভবন-গ্রেনফেল টাওয়ারের অগ্নিকান্ড কেনো এখনো জাতীয় দুর্যোগের মর্যাদায় পায়নি এনিয়েও বিতর্ক চলছে। ১২৯টি ফ্ল্যাটের ২৪ তল ভবনটি জ্বলতে দেখেছে বিশ্ববাসী। আগুনের ভয়াবহতার সঙ্গে মানুষের আর্তচিৎকার মিশে একাকার হবার দৃশ্যের কথা মনে হলে গা শিউরে উঠে। এ পর্যন্ত ৮০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। ৬ মাসের শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ বেশ কয়েকজনকে সনাক্ত করেছে পুলিশ। কিন্তু প্রথম থেকেই বলা হচ্ছে এই ভবনে প্রায় ৪শ থেকে প্রায় সাড়ে ৬শ মানুষের বসবাস ছিল। অগ্নিকান্ডে ৮০ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করলেও আরো অনেকে এখনো নিখোঁজ। তাদের ব্যাপারে কিছু বলতে পারছে না পুলিশ। তবে বলা হয়েছে আগামী বছরের আগে গ্রেনফেল টাওয়ারের হতাহতের সঠিক সংখ্যা বলতে পারবে না পুলিশ। ভবনের ৪ তলায় একটি হটপয়েন্ট ফ্রিজ থেকে এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে বলে প্রাথমিক তদন্তে বের হয়েছে। তবে আরো তদন্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চলছে পাবলিক ইনকোয়ারী। অন্যদিকে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন চালাচ্ছে পুলিশ। অগ্নিকান্ডের পর কেনসিংটন এন্ড চেলসি কাউন্সিলের চীফ এক্সিকিউটিভ, কাউন্সিল লিডার পতদ্যাগ করেছেন। অন্যদিকে এখনো নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধ্যানে পোড়া ভবনের নীচে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন স্বজনরা। গ্রেনফেল টাওয়ার ট্রাজেডিতে যখন পুরো দেশ মর্মাহত। টিক তখনই ফিন্সবারী পার্ক মসজিদে ঘরে আরেক ঘটনা।

ফিন্সবারি পার্ক হামলা :


১৮ জুন, রোববার রাত ১২টা ১৫ মিনিটে তারাবী নামাজ শেষে ঘরে ফিরছিলেন নর্থ লন্ডনের ফিন্সবারী পার্ক মসজিদের মুসল্লিরা। ফুটপাতে মুসল্লিদের উপর ভ্যান চালায় ৪৮ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী। এই হামলায় ৫১ বছর বয়সী বাঙালী মকমর আলী নিহত হন। আহত হন আরো ১১ জন। সেভেন সিস্টার রোডে অবস্থতি ফিন্সবারি পার্ক মসজিদের মুসল্লিদের উপর এই হামলায় হতবাক বনে যান লন্ডনের মুসলিম কমিউনিটির মানুষ। হামলাকারীকে গণধুলাই পুলিশে দেন উপস্থিত মুসল্লিরা। গত শুক্রবার জানাযা শেষে নিহত মরকম আলীকে গার্ডেন অব পিসে দাফন করা হয়েছে। ঘটনাটি ১৮ জুন রাত ১২টার ঘটার কারণেই বলা হয় ১৯শে জুন ঘটেছে।

গত জুন মাসে এই বড় বড় ঘটনাগুলোর পাশাপাশি কিছু এসিড হামলার ঘটনাও নাড়া দিয়েছে লন্ডনের মুসলিম কমিউনিটিকে। ২১শে জুন ইস্ট লন্ডনের নিউহ্যামে ইউনির্ভাসিটি পড়–য়া মুসলিম মহিলা এবং তার কাজিনের উপর এসিড হামলার ঘটনায় তোলপাড় হয়েছে।
ঘটনাবহুল জুন। ভুলার নয়।

Advertisement