বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা ও ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি

ড. আকমল হোসেন :: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সাধারণত ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান প্রশাসনের অধীন খুব একটা বদলায় বলে লক্ষ্য করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বাড়ার সঙ্গে মিল রেখে এ দুটি দল তাদের পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করে এসেছে। মার্কিন নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্বের স্বার্থের ওপর কোনো হুমকি মেনে না নেওয়ার নীতির ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি এ সময় থেকে রূপায়িত হয়ে এসেছে। তাদের আদর্শিক প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন-গণচীনকে প্রতিহত করা এবং ‘মুক্ত দুনিয়া’কে রক্ষা করা এ বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির মূল উপাদান ছিল। এর জন্য সব ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মোটামুটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এ ছকে প্রয়োগ করা হয়েছে।

সোভিয়েত ব্যবস্থার ভাঙন এবং দুনিয়াজুড়ে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা দুর্বলতার প্রেক্ষাপটে সনাতনী চিন্তার বদলে ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা’ চালু করার কথা মার্কিন প্রশাসন জোরেশোরে বলতে থাকে। তবে এ বিশ্বব্যবস্থা মূলগতভাবে ভিন্ন বলে চিহ্নিত করা যাবে না। বরং নতুন বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা আগের মতো গুরুত্ব পেয়েছে। তবে সমাজতান্ত্রিক হুমকির স্থলে তাদের উপলব্ধিতে ভিন্ন জায়গা থেকে হুমকি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করা হতে থাকে। নতুন হুমকির তালিকায় সাদ্দামের ইরাক, লিবিয়ার গাদ্দাফি, ইসলামী বিপ্লবী ইরান ও উত্তর কোরিয়া স্থান পায়। প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়রের ভাষায় ‘শয়তানের অক্ষ’ ইরাক, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে প্রতিহত করা তার প্রশাসনের জন্য ফরজ হয়ে পড়ে। তার জন্য তখন ‘রেজিম চেঞ্জ’ ও ‘প্রিএমটিভ স্ট্রাইক’ নীতি হিসেবে বাঞ্ছনীয় হয়ে ওঠে। পাশাপাশি অরাষ্ট্রীয় হুমকি ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’ মোকাবেলা করা রাষ্ট্রীয় হুমকির মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। ওসামা বিন লাদেন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে গুরুত্ব পেতে থাকে তার ক্রমান্বয়ে প্রভাব বিস্তারের কারণে।

পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হিসেবে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের বস্তুত পার্থক্য না থাকলেও কূটনৈতিক কৌশলের বেলায় ভিন্নতা দৃশ্যমান হয়। রিপাবলিকান প্রশাসন ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের তুলনায় রক্ষণশীল আচরণ করে। বুশ জুনিয়র প্রশাসন যেমন রেজিম চেঞ্জ ও প্রিএমটিভ স্ট্রাইককে পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসন পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছে, যা তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট ওবামার থেকে মৌলিকভাবে শুধু পৃথকই নয়, এমনকি আগের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টদের থেকেও ভিন্ন। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারে বলার চেষ্টা করেছেন যে, আগের প্রশাসনগুলোর সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষমতা-প্রতিপত্তি হারিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব হারানোর পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তার এ অভিযোগের তীর অবশ্য রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ওপরই ছুড়তে চেয়েছেন। তার নির্বাচনী স্লোগান ছিল- ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নির্বাচিত হলে আমেরিকার হূতমর্যাদা ফিরিয়ে আনবেন। তার আগের প্রশাসন, তার ভাষায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক, দু’দিক দিয়েই দেশকে দুর্বল করেছে। শ্বেতকায় ডানপন্থি ভোটাররা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাকে নির্বাচিত করায় তিনি তার প্রতিশ্রুত শক্তিশালী আমেরিকা গড়ার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন বলে মনে হতে পারে।

নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে পররাষ্ট্রনীতিতে যে পরিবর্তনগুলো তিনি এনেছেন, তা বিশ্বে নতুন করে অস্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলা কোনো অতিকথন হবে না। পরিবর্তনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :প্যারিস জলবায়ু চুক্তি (২০১৬) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার, ট্রান্স আটলান্টিক পার্টনারশিপ চুক্তি ত্যাগ, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পরমাণু ইস্যুতে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি (এ বছর দেশটির সঙ্গে একই ইস্যুতে আলোচনা শুরু করা), জেরুজালেম নগরীতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তর করে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণার প্রতি স্বীকৃতিদান, ফিলিস্তিনিদের সাহায্যের জন্য জাতিসংঘের সাহায্য এজেন্সিতে যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল বন্ধ করে দেওয়া, ইরানের প্রতি বৈরিতা প্রকাশ করে ছয় জাতি ইরান পরমাণু চুক্তি (২০১৫) থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং দেশটির ওপর নতুন করে অবরোধ আরোপ করা, চীন থেকে আমদানি পণ্যের ওপর কঠোর শুল্ক্ক আরোপ। প্যারিস চুক্তি ও ইরান পরমাণু চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ তার ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে অনুমোদন না পাওয়ায় তাদের সঙ্গে সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি হতে দেখা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এক দীর্ঘ ও জটিল কূটনৈতিক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রও অংশীদার ছিল। প্যারিস চুক্তি পরিত্যাগ করার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবেলার কাজটি কঠিন হয়ে পড়ল। অন্যদিকে ইরান পরমাণু চুক্তিও দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ফল হিসেবে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার জন্য এ চুক্তির ইতিবাচক প্রভাব চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ইউরোপীয় দেশগুলো, চীন ও রাশিয়ার কাছে বোধগম্য ছিল।

নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ হুমকি ও দুর্গতির জন্য অভিবাসীদের দায়ী করে এসেছেন। আগের প্রশাসনগুলোর নীতি থেকে সরে এসে অভিবাসন প্রশ্নে তিনি কঠোরতা দেখাতে শুরু করেছেন। এ সম্পর্কিত বক্তব্যে তার তীব্র জাতিবিদ্বেষ ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে সাতটি মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশের অভ্যন্তর ও বহির্বিশ্বে সমালোচনা সৃষ্টি করেছিলেন। এ ইস্যুতে আদালত তাকে বাধা দেওয়ারও চেষ্টা করেছে। অভিবাসন প্রশ্নে তার অবস্থান এসব মুসলিম প্রধান দেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে, বলাই বাহুল্য।

ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতিতে যেসব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, সেসব অত্যন্ত রক্ষণশীল বলা যাবে, যা আগের প্রশাসনের মেয়াদকালে ছিল না। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্ত সমর্থকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও বিরোধীরা তীব্র সমালোচনা করেছে। পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতিতে ট্রাম্পের গৃহীত অনেক পদক্ষেপ বিতর্ক সৃষ্টি করায় তিনি সংশ্নিষ্ট মন্ত্রীদের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।

ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির সমর্থক দেশগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব ও মিসর উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত মিত্র হিসেবে তার সমর্থক। এ দেশ তিনটি ইরানের প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়ে থাকে। অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন যে অবস্থান নিয়েছিল, ট্রাম্পের সময় তাও পরিবর্তিত হয়েছে। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণার প্রতি সমর্থন দেখাতে দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার কাজটি ফিলিস্তিনিরা ভালোভাবে নেয়নি। ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সম্প্রতি ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছেন তার জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজ করার জন্য। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র আর দ্বিরাষ্ট্র সমাধান এগিয়ে নিতে চায় না। ফিলিস্তিনিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘকে তহবিল বন্ধ করে দিয়ে ট্রাম্প অভূতপূর্ব এক সিদ্ধান্ত নিলেন, যা সমস্যার জটিলতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।

সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement