ব্রিটেনে ঘোড়া দৌড়ে, বাঙ্গালীর সংসার পুড়ে

বাংলাদেশ থেকে আমরা একটি চাকচিক্যময় সুখের বিলেত আমরা দেখে থাকি। নিয়ন আলোর ঝলমলে বিলেতের সুখের মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে কতো যন্ত্রনা, বাস্তবতা। সেই কঠিন বাস্তবতার গুমড়ে উঠা কান্না কেউ শুনেনা। সাংবাদিক আ স ম মাসুম এক সময়ের চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের মতো নিজের মেধা মননের যোগ সূত্রের মধ্য দিয়ে নিজেকে মানুষের নিকট গ্রহনযোগ্য করে তুলেছেন ৷ বাস্তবতা, জীবন বোধ এবং সমসাময়িক বিষয় সৃজনশীল উপস্থাপনের মধ্যদিয়ে সমাজের দৰ্পন হিসাবে  উঠে আসে আ স ম মাসুমের লেখনীতে ৷ ব্রিটবাংলার পাঠকদের জন্য বিলেতের যাপিত জীবনের সত্য ও বাস্তব চিত্র নিয়ে নিয়মিত আয়োজন  ” বাস্তবতার বিলেত

————————————————————————

বাস্তবতার বিলেত : তৃতীয়

‘ঘোড়ার ঘর’ ব্রিটেনের বাংলাদেশীদের অনেকের ঘরে ঘরে এক আতঙ্কের নাম!

Pic:BritBangla

ঘোড়ার দৌড়ে যাদের আসক্তি হয়েছে তাদের সংসার পুড়েছে। ব্রিটেনে জুয়া খেলার দোকানকে বাংলাদেশীরা বলে থাকেন ঘোড়ার ঘর! মূলত ঘোড়ার দৌড়ের উপর বাজি ধরা হয় বলেই এমন নাম। বাংলাদেশে যেমন মোড়ে মোড়ে রয়েছে চায়ের দোকান তেমনি ব্রিটেনের মোড়ে মোড়ে রয়েছে মদ আর জুয়ার দোকান! লাইসেন্সকৃত মোট ৯ হাজার জুয়ার ঘর রয়েছে পুরো ব্রিটেনে। বছরে ১৪ বিলিয়ন পাউন্ডের জুয়া খেলা হয় ব্রিটেনজুড়ে। বাংলাদেশী টাকায় সেটা প্রায় ১ লক্ষ ৫৪ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের এক তৃতীয়াংশ!
সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী যে এলাকায় বাস করেন সেই টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ৩ লক্ষ বাসিন্দার এই কাউন্সিলে রয়েছে মোট ৯০টি জুয়ার দোকান। এই কাউন্সিলে বাংরাদেশী রয়েছেন লক্ষাধিক যা মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ।

কাউন্সিলের জুয়া বিষয়ক রিপোর্টে বলা হয়েছে শুধুমাত্র টাওয়ার হ্যামলেটেই রয়েছে ৬ হাজার নিয়মিত জুয়ারী। এর মধ্যে অন্তত ৩ হাজারের বেশি বাংলাদেশী জুয়ায় আসক্ত।
জুয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে বাংলাদেশী নারী, পুরুষের আনাগোনা! জুয়ায় আসক্তদের বড় একটি অংশ হচ্ছেন ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী।

এছাড়া অনেক বয়স্ক লোকও নিয়মিত এইসব জুয়ার ঘরে গিয়ে থাকেন। গত কয়েকদিন বাংলাদেশী অধ্যুাষিত মাইল এন্ড থেকে শুরু করে হোয়াইটচ্যাপেল, কমার্সিয়াল ষ্ট্রিট, পপলারের কোরাল, ল্যাডব্রকস, উইলিয়াম হিলস ইত্যাদি বাজির দোকানে ঘুরে দেখা গেছে অসংখ্য বাংলাদেশীর আনাগোনা। বাজি ধরছেন ঘোড়ার দৌড়ে, কেউবা ফুটবলে বাজি ধরছেন। তবে মজার বিষয় হচ্ছে দুনিয়ার এমন কোন বিষয় নেই যেখানে বাজি ধরা হয় না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, বাংলাদেশের নির্বাচন সবই থাকে বাজির দৌড়ে।
পপলারের কোরার নামের বাজির দোকানে কথা হয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিয়মিত একজন বাংলাদেশী বাজিকরের সাথে। তিনি জানান, এটি একটি নেশা। প্রতিদিন এসে বাজি ধরে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এটাই নেশা। নেশার জন্য টাকা আসছে না যাচ্ছে সেটার পরোয়া করেন না।
কমার্সিয়াল রোডের উইলিয়াম হিলস নামের অপর এক বাজির দোকানে দেখা গেলো একজন ৪৫ বয়োসোর্ধ্ব মহিলা বাজির ফরম পূরন করছেন। কথা বরতে গেলে তিনি রাজি হোননি।
রাশনা বেগম নামের এক গৃহবধু জানালেন স্বামী ট্যাক্সি চালিয়ে প্রতিদিন যা রোজগার করেন তা সবই চলে যায় জুয়ায়! সন্তানদের নিয়ে সরকারের সামাজিক ভাতা নিয়ে কোন রকমে দিন চলছে তাদের। স্বামী মাঝে মধ্যে সরকার থেকে প্রাপ্ত সামান্য ভাতার উপরও হামলা চালায়। না দিলে মারামারি আর সংসারের অশান্তি।
আরেক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গৃহবধূ জানালেন, স্বামী রেষ্টুরেন্টে শেফ। কিন্তু সপ্তাহান্তে বেতন পেয়েই চলে যায় ঘোড়ার ঘরে। এমনকি বিয়ের সময় প্রাপ্ত সকল সোনাদানা সবই গেছে ঘোড়ার ঘরে। কিংডম সলিসিটরস এর প্রিন্সিপাল ব্যারিষ্টার তারেক চৌধুরী বলেন, সারা বছরে যেসব ডমেষ্টিক ভায়োল্যান্সের কেইস আমরা পাই তার একটি অংশ জুয়া খেলার অশান্তি থেকে সৃষ্ট। অল্পতে টাকার মালিক হওয়ার প্রবনতা থেকে জুয়ার দিকে আসক্তি বাড়ে অনেকের। যার শেষ পরিণতি হয় ভয়াবহ।
জুয়া নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জানা গেছে আরো ভয়াবহ তথ্য! লাইসেন্সড জুয়ার ঘরের বাইরেও বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেকেই নিজের ঘরেই জুয়ার আসর বসিয়ে থাকেন। টাওয়ার হ্যামলেটস, নিউহ্যাম বিভিন্ন এলাকায় এইসব ঘরোয়া আসরের মূল অংশগ্রহনকারী অনেক নামীদামী ব্যবসায়ী, রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত কমিউনিটির কিছু নামকরা মানুষ। মূলত যারা রাস্তার পাশে বা মোড়ের বাজির দোকানে যেতে পারেননা চক্ষুলজ্জার কারনে তারাই এসব আসরের মূল টার্গেট। এইসব আসর ঘিরে ইষ্ট লন্ডনের বিভিন্ন গ্যাং নানা ধরনের বানিজ্য করে থাকে। মূলত জুয়ার আসরে টাকা শেষ হয়ে গেলে তাতক্ষনিক টাকার জোগান দেয়ার জন্য কিছু গ্যাং রেডি থাকে। সময়মতো সেই টাকা সুদসমেত ফেরত না দিলে নানা ধরনের বিপদ নেমে আসে। তবে এসব ঘরোয়া আসরে মূলত বিভিন্ন ধরনের তাস খেলার উপর বাজি ধরা হয়।
বৈধ হোক আর অবৈধ জুয়ার আসর হোক। ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বছরে ১৪ বিলিয়ন পাউন্ড জোগান দেয়া বাজির ঘোড়ার দৌড়ে একটি বড় অংকের টাকা যে বাংলাদেশীদের পকেট থেকে যাচ্ছে সেটা নি:সন্দেহে বলা যায়। আর এই বাজির ঘোড়ার দৌড়ে পুড়ছে অনেক বাংলাদেশীর সংসার।

আ স মাসুম:ম্যানেজিংএডিটর,ব্রিটবাংলা টুয়েন্টি ফোর।

Advertisement