ব্রিটেন সরকারের কড়াকড়িতে বাংলাদেশী ষ্টুডেন্টরা দিশেহারা

বাংলাদেশ থেকে আমরা একটি চাকচিক্যময় সুখের বিলেত আমরা দেখে থাকি। নিয়ন আলোর ঝলমলে বিলেতের সুখের মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে কতো যন্ত্রনা, বাস্তবতা। সেই কঠিন বাস্তবতার গুমড়ে উঠা কান্না কেউ শুনেনা। সাংবাদিক আ স ম মাসুম এক সময়ের চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের মতো নিজের মেধা মননের যোগ সূত্রের মধ্য দিয়ে নিজেকে মানুষের নিকট গ্রহনযোগ্য করে তুলেছেন ৷ বাস্তবতা, জীবন বোধ এবং সমসাময়িক বিষয় সৃজনশীল উপস্থাপনের মধ্যদিয়ে সমাজের দৰ্পন হিসাবে  উঠে আসে আ স ম মাসুমের লেখনীতে ৷ ব্রিটবাংলার পাঠকদের জন্য বিলেতের যাপিত জীবনের সত্য ও বাস্তব চিত্র নিয়ে নিয়মিত আয়োজন  ” বাস্তবতার বিলেত-

বাস্তবতার বিলেত:চতুর্থ

এক সময় ব্রিটেনে পড়তে আসা ছাত্রদের বেশ আলাদা চোখে দেখা হতো বাংলাদেশে। বিলেত পাশ করাদের কদর ছিলো চাকুরী থেকে বিয়ে সব জায়গায়। তবে ২০০৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের মানি ম্যাকিং ষ্টুডেন্ট স্কিম টায়ার ফোর সেই ধারনা পাল্টে দেয়। কোন ইংলিশ টেষ্ট নেই, শুধুমাত্র এসএসসি পাশ আর ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যাংক ষ্টেইটমেন্ট দেখাতে পারলেই ভিসা নিশ্চিত এমন এক অপূর্ব সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ ঝাপিয়ে পড়ে ব্রিটেনে!
২০০৮ সালে ব্রিটেন যে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে সেখান থেকে উঠার জন্য এমন এক আত্ন বিধ্বংসী স্কিম হাতে নেয় ব্রিটিশ সরকার। এক বছরে তারা শুধুমাত্র ওভারসীজ ষ্টুডেন্টদের কাছ থেকে ৮ বিলিয়ন পাউন্ড সংগ্রহ করে।
২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টায়ার ফোর স্কিমে লক্ষাধিক বাংলাদেশী ষ্টুডেন্ট এসেছিলেন। তখন সিষ্টেমের ফাকে যেমন মেধাবী ছাত্ররা এসেছেন না বুঝে তেমনি অনেক সেভেন এইট পাশ লোকও এসেছেন সার্টিফিকেট ও ব্যাংক ষ্টেইটমেন্ট জাল করে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশী মালিকানাধীন শতাধিক কলেজ গড়ে উঠে। তখন অনেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক হোন চোখের পলকে। শুধুমাত্র বাংলাদেশী কমিউনিটিতে তখন ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ডের লেনদেন হয় এই টায়ার ফোর ষ্টুডেন্টদের নিয়ে শিক্ষা বানিজ্যে।
২০০৯ সালে টায়ার ফোর স্কিমে ব্রিটেনে আসা ছাত্র সাইম রহমান বলেন, সরকারী চাকুরী ছেড়ে এসেছিলাম সোনার হরিনের আশায়। এখন অবৈধ হয়ে চোরের মতো পালিয়ে কাজ করি। না বুঝে নিজের ভবিষত নিজেই নষ্ট করলাম।
একই সময়ে এমসি কলেজের অর্থনীতি অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আরিফ হোসেন চলে আসেন ব্রিটেনে। আজ তিনিও অবৈধ। আরিফ বলেন, ১ মাস পরেই অনার্স ফাইনাল ছিলো। সেটা না দিয়ে হুজুগের মাথায় চলে আসলাম ব্রিটেনে। এখন অবৈধ হয়ে আছি। দেশে গিয়েতো জীবনের নস্ট করা ৮ বছর ফেরত পাবো না।
যখনই ব্রিটিশ সরকার অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উঠে দাড়ায় তখনই এমন সব নিয়ম আরোপ করে যে টায়ার ফোর স্কিমে আসা ৮৫ শতাংশ অবৈধ হয় পড়ে। এদের বড় একটি অংশ চলে যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে,একটি অংশ এখনও ব্রিটেনে অবৈধ হিসাবে রয়ে গেছে। কিছু অংশ আবার ফিরে গেছে বাংলাদেশে। ২০১৪ সালে ব্রিটিশ হোম অফিস টোয়েক নামে একটি ইংরেজী ভাষা কোর্সকে অবৈধ ঘোষনা করলে ৪৮ হাজার ষ্টুডেন্টের ভিসা বাতিল করে।
কিন্তু সেই যে ব্রিটিশ সরকার বিদেশী ষ্টুডেন্টদের ক্ষেত্রে যে কড়াকড়ি আরোপ করেছে তাতে মেধাবী এবং সত্যিকারের স্টুডেন্টরা সবেচেয়ে বেশী কষ্ট করছেন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে তারা আজকে চোখে অন্ধকার দেখছেন।
বাংলাদেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে মাষ্টার্স করতে এসেছিলেন মারুফ আহমেদ। কিন্তু হোম অফিসের নানা মারপ্যাচে পড়ে জীবন অতিষ্ট তার। তিনি বলেন, এখন এমন অবস্থায় আছি যে, না পারছি দেশে ফেরত যেতে আবার না পারছি থাকতে।
বাংলাদেশী ষ্টুডেন্ট কন্সালটেন্সী করেন আবিদুর রহমান বলেন, বর্তমান নিয়মে একজন ষ্টুডেন্ট কলেজে যদি ফাউন্ডেশন কোর্সে পড়তে আসে তাহলে দিতে হয় বছরে বাংলাদেশী টাকায় ৩ লাখ ২০ হাজার থেকে ৪ লাখ। সেই সাথে আইইএলটিএস ৫.৫ পয়েন্ট থাকতে হবে। ব্রিটেনে একজন ষ্টুডেন্টের থাকা, খাওয়া এবং ট্রাভেল বাবদ খরচ হয় বছরে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা থেকে ৮ লাখ টাকা। আবার কলেজের আওতায় ভিসা নিয়ে আসলে থাকবেনা কোন কাজের অনুমতি। মানে বছরে প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকার পুরোটাই নিজে বহন করতে হবে।

যেহেতু কাজের অনুমতি নেই তাই কাজ করা অবৈধ। তাই কেউ যদি নগদ বেতনে কোন প্রতিস্টানে কাজ করেন এবং ধরা পড়েন তাহলে ব্রিটেনের সাময়িক জেলে নিয়ে সেখান থেকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসাদের জন্য আবিদ জানান, কেউ যদি কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসে তাহলে তাকে আইইএলটিএস ৬ থেকে ৭ পয়েন্ট তুলতে হবে। সেই সাথে বছরে টিউশন ফি দিতে হবে বছরে ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা। আর থাকা খাওয়া বাবদ খরচ মিলিয়ে সেটা বছরে হবে প্রায় ২০ লাখ টাকা। তবে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসলে সপ্তাহে ২০ ঘন্টা কাজের সুবিধা রয়েছে। সেই হিসাবে বছরে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা রোজাগারের সম্ভাবনা রয়েছে।
এরপর রয়েছে আরো হাংগামা। যদি কেউ পড়ার বিষয় পরিবর্তন করে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে চায় তাহলে সেটা আর এখন ব্রিটেনের ভিতর থেকে বাড়ানো যায় না। নিজ দেশে গিয়ে আবার আবেদন করতে হয়। সেই ক্ষেত্রে ভিসা না দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক।
শুধুমাত্র ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসলে ব্রিটেনে ওয়ার্ক পারমিট নেয়ার সুযোগ এখনও আছে তবে সেটও অনেক শর্তসাপেক্ষে । আগে ব্রিটেনে অনার্স করার পর ২ বছরের পোষ্ট ওয়ার্ক পারমিট দেয়া হতো যার মাধ্যমে দুই বছর ফুল টাইম কাজ করে টাকা জমিয়ে অনেকে আবার মাষ্টার্স করতে পারতেন। তারপর আবার ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ ছিলো। বর্তমানে যে সব সিষ্টেম আরোপ করেছে সেভাবে আর ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। বর্তমানে ১০ বছর টানা বৈধ ভিসায় লেখাপড়া করার রেকর্ড থাকলে ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে ভবিষতে সেটারও পরিবর্তন করার কথা ভাবছে সরকার।
তরুন আইনজীবি , সলিসিটর মিজানুর রহমান শিপু বলেন, প্রতি মাসে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ টি কেস আমাদের কাছে আসে শুধুমাত্র বাংলাদেশ থেকে আসা ষ্টুডেন্টদের। হোম অফিসের নানা নিয়মের ফেরে পড়ে বাংলাদেশী ছাত্ররা দিশেহারা

আ স ম মাসুম ম্যানেজিংএডিটর,ব্রিটবাংলা টোয়েন্টিফোর

 

Advertisement