‘ভুল গণতন্ত্র’ চর্চা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

:: সোহরাব হাসান ::

রমনা পার্কের পূর্ব পাশের সড়ক ধরে দক্ষিণে এগোলে কাকরাইল মসজিদ পার হতে বাঁ দিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের যে বিশাল ভবনটি আছে, তার সামনে বড়সড় ফলকে লেখা, ‘শেখ হাসিনার মন্ত্র উন্নয়নের গণতন্ত্র’। এ ধরনের স্লোগান দেশের আরও অনেক স্থানে আছে।

উন্নয়নের গণতন্ত্র স্লোগানের রচয়িতারা ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা পরিষ্কার নয়। হতে পারে তাঁরা বলতে চেয়েছেন উন্নয়নের জন্যই গণতন্ত্র। কিন্তু অবনতির জন্য পৃথিবীর কোনো দেশে গণতন্ত্র আছে বলে আমাদের জানা নেই। কথাটির আরেকটি অর্থ হতে পারে উন্নয়নই গণতন্ত্র। তাহলে প্রশ্ন উঠবে, উন্নয়ন বলতে আমরা কী বুঝব?
মানুষ তো শুধু আহার-নিদ্রা ও সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য বাঁচে না। মানুষ চিন্তা করে, ভাবে এবং সেই ভাবনা প্রকাশ করে। মানুষ নিজের মতের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়, অন্যের যুক্তি খণ্ডন করে। তাহলে মানুষের সার্বিক উন্নয়ন তো তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাদ দিয়ে হতে পারে না। গণতন্ত্রের যে উন্নয়ন সেটি হলো মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার, কথা বলার বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো একসময় সবাইকে একমতে ও এক পথে চালানোর কর্তৃত্ববাদী শাসন চালু করে নিজেদের অস্তিত্বই বিপন্ন করেছে। এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। বনেদি গণতান্ত্রিক এবং গণতন্ত্র হতে চাওয়া অনেক দেশ এখন সেই পথ অনুসরণ করে চলেছে।

ফলকে খোদিত ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ কথাটি বিশেষভাবে মনে পড়ল সম্প্রতি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করার ঘটনায়। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের সবার জন্য আনন্দসংবাদ। এত দিন আমরা গরিব ছিলাম। এখন আর গরিব থাকব না। জাতিসংঘ বলেছে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের পঙ্ক্তিভুক্ত হলেও আগামী ছয় বছর অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত তারা আমাদের অর্থনীতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবে।

অতীতে কোনো কোনো স্বল্পোন্নত দেশ উন্নয়নশীল সড়কে এসে থমকে গেছে। আমাদেরও যাতে এই অবস্থায় পড়তে না হয়, সে জন্য দক্ষতার সঙ্গে সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এখন বাংলাদেশ যে স্বল্প সুদে ঋণ, অনুদান ও বাণিজ্যসুবিধা পাচ্ছে, তা অনেকটা কমে যাবে এবং সেই কমে যাওয়ার সুবিধা পূরণ করতে হবে বাড়তি বিনিয়োগ দিয়ে। আর বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন হবে সুদক্ষ জনবল, মজবুত অবকাঠামো এবং সর্বক্ষেত্রে সুশাসন। আর দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে, দেশ পরিচালনার প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ ফলকে উদ্ধৃত উন্নয়নের গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের উন্নয়ন জরুরি।

এসব কথা বললে সরকারি দলের বন্ধুদের অনেকে ভ্রু কোঁচকাতে পারেন। এ কারণে আমরা নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে সাক্ষী মানছি। তাঁকে নিশ্চয়ই আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী মানুষ বলে চিহ্নিত করবেন না। তিনি মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

এখন দেখা যাক সেই অমর্ত্য সেন উন্নয়ন বলতে কী বোঝান। তিনি বলেছেন, ‘উন্নয়ন মানে কেবল কিছু বস্তু জড়ো করে যাওয়া বোঝায় না। মোট জাতীয় উৎপাদনে শিল্পের উন্নয়ন বা প্রযুক্তির উন্নতি বা সমাজের আধুনিকীকরণ-এগুলো অবশ্যই মূল্যবান, অনেক সময়ে অতি গুরুত্বপূর্ণও বটে, কিন্ত এদের মূল্য নির্ভর করে এগুলো মানুষের জীবন এবং স্বাধীনতার জন্য কতটা কী করতে পারল, তার ওপর। যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যাঁদের নিজেদের নির্বাচনের অধিকার রয়েছে, তাঁদের কাছে শেষ অবধি প্রশ্ন এটাই দাঁড়ায় যে, যা তাঁদের কাছে মূল্যবান, তা করার বা পাওয়ার স্বাধীনতা তাঁদের আছে কি না? এই আর্থে উন্নয়ন মানে মানুষের সক্ষমতার প্রসার।’ (ফার্স্ট বয়দের দেশ, আনন্দ, কলকাতা, ২০০৭)

কিন্তু বাংলাদেশ তো বটেই অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের শাসকেরাও মানুষের সক্ষমতার বিষয়টি উপেক্ষা করে থাকেন। ব্যক্তির স্বাধীনতা পদে পদে খর্ব করেন।

অমর্ত্য সেন এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি বাক্স্বাধীনতাকে মানুষের সক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে অভিহিত করেছেন। এই খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ বাক্স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে অতি আবশ্যকভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। আমরা তাঁর সেই বিখ্যাত মতবাদের কথাও মনে করতে পারি, যে দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। কারণ, সংবাদমাধ্যম জানিয়ে দেয় কোথায় খাদ্যের ঘাটতি আছে, কোথায় দ্রুত খাদ্য সরবরাহ করা দরকার। এ প্রসঙ্গে তিনি পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় চীনে দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ লোকের মারা যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। তাঁর লেখায় ঔপনিবেশিক ভারতে একাধিকবার দুর্ভিক্ষের উদাহরণও রয়েছে।

তাঁর মতে, স্বাধীন ভারতে যে দুর্ভিক্ষ হয়নি তার কারণ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে। সে সময় বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু দুর্ভিক্ষ থামানো যায়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্তের কারণে। বাংলাদেশ কিউবায় পাট বিক্রি করেছে-এই ‘অপরাধে’ দেশটি চালবাহী জাহাজ ফেরত নিয়েছিল।

অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যমের ওপর লাগাম টানার ফলে যেসব তথ্য সুপ্ত হয়ে যায়, তা একনায়কতান্ত্রিক সরকারকেই ভুল পথে চালিত করে। এটা অবশ্যই সত্য যে সংবাদমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ কেবল নাগরিকদেরই অন্ধকারে রাখে না, সরকারের কাছেও অতি জরুরি তথ্য পৌঁছাতে দেয় না।’

অমর্ত্য সেন সংবাদমাধ্যমকে শুধু তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে দেখেননি। মানবকল্যাণ তথা আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে তার অপরিসীম অবদানের কথা বলতে গিয়ে এর অন্তর্নিহিত মূল্য, তথ্যগত মূল্য, সুরক্ষাজনিত মূল্য এবং গঠনমূলক মূল্যের উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ‘মানুষ যেভাবে বেঁচে রয়েছে, বাস্তবিক যে স্বাধীনতা তারা পাচ্ছে, তাকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের মূল্যায়ন করা যায় না।’ এর অর্থ স্বাধীন গণমাধ্যম কেবল কণ্ঠহীন মানুষের হয়েই কথা বলে না, প্রকৃত তথ্য দিয়ে সরকার তথা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদেরও সহায়তা করে।

সংবাদমাধ্যমের নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এটা কেবল সাংবাদিকতার সততা; বরং নিরপেক্ষতার বিষয় নয়। যদিও এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। প্রয়োজন আগ্রহ ও উদ্যম, নতুনভাবে চিন্তার ক্ষমতা, যা অল্প পরিচিত বিষয়গুলোকেও তুলে আনতে পারে।’ অমর্ত্য সেন সংবাদমাধ্যমের কাছে অনেক বেশি দাবি করেছেন।

ভারতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও অর্থনীতিবিদ কেনেথ গলব্রেথ সংবাদমাধ্যমকে অভিহিত করেছেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা’ হিসেবে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা একে অপরকে ক্ষতি করার জন্য নয়, বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করার জন্য। অমর্ত্য সেন গলব্রেথের বক্তব্য সমর্থন করে বলেছেন, ‘যেটা দরকার তা কোনো একটি ক্ষমতাকে অবলুপ্ত করা নয়। প্রয়োজন হলো একটি ক্ষমতার মোকাবিলা করার জন্য আরেকটি ক্ষমতার ব্যবহার্য।’ সেই অর্থে শুধু সংবাদমাধ্যমে নয়, নাগরিক সমাজ ও সরকারের বাইরে থাকা বেসরকারি সংগঠন ও সংস্থাগুলোও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা।’ গণতান্ত্রিক শাসকেরা এই প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাকে ভয় না পেয়ে স্বাগত জানান। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা মনে করেন, ‘যারা আমার সঙ্গে নেই তারাই দেশের শত্রু’।

যে আমার সঙ্গে নেই সে দেশের শত্রু এবং যে আমার সঙ্গে আছে, সে কামরুল হাসানের ভাষায় ‘বিশ্ববেহায়া’ হলেও তাকে সাদরে বরণ করে নিতে হবে, তার অবৈধ ক্ষমতা দখলকে ঘটা করে উদ্যাপন করতে দিতে হবে, এই স্ববিরোধী ও আত্মঘাতী রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে আমরা কবে বেরিয়ে আসতে পারব? আদৌ পারব কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement