ভোটের ফলে নানা অমিল–অসংগতি

মহিউদ্দিন :: নিবন্ধন না থাকায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থীরা অংশ নেন বাম জোটের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতীক নিয়ে। ৩০ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণ শেষে বেসরকারি ফলাফলে চট্টগ্রাম-১০ আসনে তাদের প্রার্থী সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মারুফের প্রাপ্ত ভোট শূন্য দেখানো হয়েছিল। এখন নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে দেখানো হয়েছে ২৪৩টি ভোট।

কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে এ তথ্য তুলে ধরেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। তাতে বলা হয়, চট্টগ্রাম-১০ আসন ছাড়া আরও চারটি সংসদীয় এলাকায় বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফলের সঙ্গে ইসির প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের মিল নেই। নির্বাচনের পরপরই রিটার্নিং কর্মকর্তার সই করা এ চার আসনের ফলাফল সংগ্রহ করেছিল সুজন।

সুজন বলছে, ঢাকা-১০ আসনে তাৎক্ষণিক ফলাফলে ভোট পড়ার হার ছিল ৬৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। কিন্তু ইসির ফলে দেখানো হয়েছে ৭৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, যা ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। ঢাকা-১১ আসনে এটি ছিল ৬০ দশমিক ৪৬ শতাংশ আর পরে ইসির ফলে দেখানো হয়েছে ৬২ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা ২ দশমিক ১৯ শতাংশ বেশি। চট্টগ্রাম-৮ আসনে বেসরকারি ফলাফলে ভোটের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর ইসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এটি ৭৬ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা ২ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ-৩ আসনে বেসরকারি ফলাফলে ভোটের হার ছিল ৯৩ দশমিক ২৮ শতাংশ কিন্তু ইসির প্রকাশিত ফলাফল বলছে ৯৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা ১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ বেশি।

ফলাফলে এই অমিল-অসংগতির বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ইসি নিজে কিছু করেনি, রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো ফলাফল প্রকাশ করেছে। কোনো অসংগতি থাকলে যে কেউ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করতে পারেন। এদিকে ইসির প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফল অনুযায়ী মাগুরা-২ আসনের থৈপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কোনো ভোট পায়নি নৌকা। অথচ রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য বলছে, ওই কেন্দ্রে ধানের শীষ কোনো ভোটই পায়নি; বরং কেন্দ্রটিতে বৈধ ভোটের শতভাগই পেয়েছে নৌকা।

ভোটের জোয়ারেও স্বল্প ভোট

সুজন জানায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ার গড় হার ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ। এর মধ্যে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। অধিক হারে ভোট পড়া কেন্দ্রের সংখ্যা বেশি হলেও স্বল্প ভোট পড়ার চিত্রও আছে। ৯৩১টি ভোটকেন্দ্রে ৫০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে। ৫টি আসনের ১১টি ভোটকেন্দ্রে ৫ শতাংশের কম, ১০টি আসনের ২০টি ভোটকেন্দ্রে ৬ থেকে ১৯ শতাংশ, ৪৮টি আসনের ৩০১টি ভোটকেন্দ্রে ২০ থেকে ৩৯ শতাংশ এবং ৫৯৯টি ভোটকেন্দ্রে ৪০ থেকে ৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে যশোর-৩ আসনের যশোর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এই ভোটকেন্দ্রের ২ হাজার ১৮৬ জন ভোটারের মধ্যে মাত্র ২৯ জন ভোট দিয়েছেন। এ কেন্দ্রে ভোট পড়ার হার ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

আলোচনায় বাতিল ভোট

সুজন বলছে, আগের কয়েকটি নির্বাচনের চেয়ে বেশি না হলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে বাতিল ভোটের আধিক্যও লক্ষ করা গেছে। মোট বাতিল হয়েছে ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬৯০টি ব্যালট। ভোট বাতিলের গড় হার ১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। তবে শতভাগ ভোট পড়া ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে বাতিল ভোটের হার ছিল ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ ছাড়া ৩৪২টি ভোটকেন্দ্রে ১১ থেকে ৬১ শতাংশ পর্যন্ত ভোট বাতিল হয়েছে। এর পাশাপাশি ৪ হাজার ৭৯৫টি কেন্দ্রে কোনো ভোটই বাতিল হয়নি। সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ ভোট বাতিল হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের ‘নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ ভোটকেন্দ্রে।

ভোটের আগে-পরের অভিযোগ

সুজন বলছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের নানা অভিযোগ আগে থেকেই উঠেছিল। এর মধ্যে মনোনয়ন-বাণিজ্য, নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাদান, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পোলিং এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বা মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, ভোটের আগের রাতে মহাজোট প্রার্থীদের প্রতীকে ভোট দিয়ে বাক্স ভরে রাখা, কোনো কোনো কেন্দ্রে বেলা ১১টার মধ্যেই ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, ভোটারদের প্রকাশ্যে সিল মারতে বাধ্য করা, দীর্ঘ সময় লম্বা লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ না করা, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ব্যবহার, নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততার অভিযোগ উল্লেখযোগ্য ছিল। কেন্দ্রভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশের পর অনেক অভিযোগ যৌক্তিক বলে মনে করছে সুজন।

৯ জুলাই সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফল বিশ্লেষণ তুলে ধরে সুজন। ওই অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, অনিয়ম প্রমাণে আর কিছু দরকার হবে না। ইসির তথ্যই বলে দিচ্ছে, কমিশন জালিয়াতি করেছে।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল তদন্তের দাবি

ইসির প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের মধ্যেই অনিয়মের খনি আছে বলে মনে করছে সুজন। এসব অনিয়মের তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিটির দাবি করেছে সুজন। ফলাফল বিশ্লেষণ করে বেশ কয়েকটি নেতিবাচক দিক তুলে ধরে এ দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। ফলাফল বিশ্লেষণ প্রকাশের অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান নির্বাচনের অনিয়ম তদন্ত করে দায়ীদের বিচার নিশ্চিত করার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানান।

সুজন বলছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। এই নামের মধ্যেই জড়িয়ে আছে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের অঙ্গীকার। আর এই গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপই হচ্ছে নির্বাচন। তাই নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগসমূহ তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। না হলে নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। (শেষ)

Advertisement