ভোটের রাজনীতিতে জোটের উদ্দেশ্য

মারুফ মল্লিক :: ভোটের মাঠে জোটের রাজনীতি বেশ জমে উঠেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়ছে দুই প্রধান জোট; মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্ট। মহাজোটকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। অব্যাহত হামলা ও মামলার কারণে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও কর্মীরা মাঠে নামতে না পারলেও মহাজোট খুব একটা স্বস্তিতে নেই। বিএনপি একা মহাজোটকে এতটা অস্বস্তিতে ফেলতে পারত কি না, সন্দেহ আছে।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকরভাবে জোটবদ্ধ হওয়া শুরু সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় থেকে। জিয়াউর রহমানের আমলে, ১৯৭৯ সালের শেষ দিকে সরকারের নীতি ও আদর্শের বিরোধিতা করে ১০-দলীয় ঐক্যজোট করা হয়। তবে এই জোটটি রাজনীতিতে তেমন সফল হতে পারেনি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর এই জোট ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের বিপরীতে একক প্রার্থীও দিতে পারেনি। এরশাদ জমানায় ১৯৮৩ সালের ৩১ জানুয়ারি বামপন্থীদের উদ্যোগে ১৫-দলীয় জোট গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এই জোটে যুক্ত হয় এবং পরে বড় দল হিসেবে এই জোটের নেতৃত্বে চলে আসে। এই জোটে ছিল আওয়ামী লীগ (হাসিনা), আওয়ামী লীগ (মিজান), আওয়ামী লীগ (ফরিদ গাজী), জাসদ, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), ন্যাপ (হারুন), কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশ (সিপিবি), সাম্যবাদী দল (তোয়াহা), সাম্যবাদী দল (নগেন), জাতীয় একতা পার্টি, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল এবং জাতীয় মজদুর পার্টি (সূত্র: বিএনপির সময়-অসময়: মহিউদ্দিন আহমেদ, প্রথমা প্রকাশন: ২০১৬)। বিভিন্ন সময় ১৫-দলীয় জোটে দলের সংখ্যা বেড়েছে বা কমেছে। কিন্তু ১৫ দল নামেই জোটটি পরিচিত ছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৫ দলে ভাঙন দেখা দেয়। মেনন, ইনুর নেতৃত্বে পাঁচ দল বেরিয়ে যায়। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল গঠিত হয়। এই নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ এবং সিপিবি তাতে অংশ নেয়।

অপরদিকে ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে গঠিত হয় ৭ দল। বিএনপির নেতৃত্বে ৭-দলীয় জোটে ছিল কাজী জাফর আহমেদের ইউপিপি, ন্যাপ, ভাসানী, ডেমোক্রেটিক লীগ (রউফ), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, জাগমুই ও বাংলাদেশ বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ। ৭ দলেও সব সময় সাতটি দল ছিল না। কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। যেমন জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান ৭ দল ত্যাগ করে জেনারেল এরশাদের অধীনে প্রধানমন্ত্রীর পদ লাভ করেন। তবে এরশাদের পতনের সময় পর্যন্ত ৭ দল নামেই পরিচিত ছিল এই জোট। কিন্তু এরশাদের পতনের পর বিএনপি একাই নির্বাচন করে। ওই সময়ের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৫ দলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে ৪২টি আসন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু ৫ দল বেশি আসন দাবি করায় শেষ পর্যন্ত তাদের একসঙ্গে নির্বাচন করা হয়নি। জাসদের হাসানুল হক ইনুই ১০০টির বেশি আসন চেয়েছিলেন।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন করে সিপিবি ৫টি আসনে জয়লাভ করে। তাঁদের মধ্যে দুজন বিএনপি ও দুজন পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদকে মূল প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে জোটগুলো গড়ে উঠেছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের জোট গঠনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বৈরাচার এরশাদকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে টানাহ্যাঁচড়া। বিএনপি আমলের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন একটি জোট গড়ে ওঠে। ওই জোটে এরশাদের জাতীয় পার্টিও যোগ দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে জাসদ (রব) ও জাতীয় পার্টি সরকারে যোগ দেয়।

তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকার থেকে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বেরিয়ে যায়। পরে বিএনপির সঙ্গে ৪-দলীয় জোট করে। এদের সঙ্গে ৪ দলে যোগ দেয় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের আগেই এরশাদ জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও জাতীয় পার্টির আরেক অংশ নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে জোটে থেকে যায়।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ মাওলানা আজিজুল হকের নেতৃত্বে জোট থেকে বেরিয়ে যায়। এই অংশের সঙ্গে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ লিখিত চুক্তিও করে। ৪-দলীয় জোটের বিপরীতে গঠিত হওয়া ৮ দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ যোগ দিয়ে ১১-দলীয় জোটে পরিণত করে। ওই জোট গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন বর্তমানের ঐক্যফ্রন্টের নেতা গণফোরামের ড. কামাল হোসেন। ১১ দল পরে ১৪ দল হয়ে মহাজোটে রূপ লাভ করে। ৪-দলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে বিএনপি এরশাদকে জোটে ভেড়ানোর জন্য চেষ্টা করলেও অজ্ঞাত স্থান থেকে এরশাদ পল্টনের মহাজোটের মঞ্চে উপস্থিত হয়ে মহাজোটের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ওই মঞ্চে বিকল্প ধারার বি. চৌধুরী, এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমদও যোগ দেন। কিন্তু নির্বাচন করেন পৃথকভাবে।

বাংলাদেশে জোটের রাজনীতিতে সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ঐক্যফ্রন্টের গঠন বেশ জটিল। কারণ এই জোটে বিভিন্ন দল এক হয়েছে, যাদের রাজনৈতিক আদর্শে ভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দল। আবার বিএনপির ২০-দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামী রয়েছে, যাদের নিবন্ধন নেই এবং ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল দলটি। এই দলের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের সাজা কার্যকর হয়েছে। মূলত ঐক্যফ্রন্ট হচ্ছে ভোটের জোট। দেশের রাজনীতিতে সব সময়ই জোট গঠিত হয়েছে ভোটের রাজনীতিকে চিন্তা করে। বড় বড় জোটে নানা মতের ও আদর্শের দলগুলোর সম্মিলন ঘটেছে কেবলই ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

সামরিক শাসক বাদে কেবল ১৯৭০ ও ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ ও ১৯৯১ সালে বিএনপি এককভাবে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। এর বাইরে প্রতিবারই রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন ও নির্বাচন করেছে এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকারও গঠন করেছে। জোট করতে গিয়ে কখনো কখনো আদর্শের সঙ্গেও সমঝোতা করতে হয়েছে। বাংলাদেশে জোট গঠনের ক্ষেত্রে ক্ষমতায় আরোহণই মূল কথা। যেমন নব্বইয়ের দশকে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলে আওয়ামী লীগ সর্বশক্তি দিয়ে এ আন্দোলনকে সমর্থন করে। কিন্তু পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এই ঘাতকদের সঙ্গেই যুগপৎ আন্দোলন করতে গিয়ে একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনও করেছে তারা। ক্ষমতার জন্যই জোট হয়, ক্ষমতার ভাগ না পেয়ে আবার জোট পরিত্যাগ করে নতুন জোটে যায়। এ কারণে এক দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে উপনীত হয়ে রাজনৈতিক অবস্থা। অতীতের জোটগুলো ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া সাধারণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। নতুন নতুন যে জোট তৈরি হচ্ছে তার কি কেবলই ক্ষমতায় যাওয়ার জোট হিসেবে থাকবে না স্বাধীনতার অপ্রাপ্তি পূরণ করবে, তা সময়ই বলে দেবে।

Advertisement