মাদকমুক্ত ভোরের প্রত্যাশায় বাংলাদেশ

:: প্রভাষ আমিন ::

দেশে হঠাৎ হঠাৎ নানা অভিযান শুরু হয়। কখনও উচ্ছেদ, কখনও জঙ্গিবিরোধী, কখনও অস্ত্র উদ্ধার, কখনও ভেজালবিরোধী অভিযান। আবার কখনও ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশবিরোধী অভিযান, কখনও বা মাদকবিরোধী অভিযান। অভিযান কথাটি শুনলেই মনে হয়, শুধু অভিযানের সময় এই কাজগুলো করা যাবে না। অভিযান শেষ হলেই আবার শুরু করা যাবে। অথচ আইনি কাঠামোর মধ্যে একটি রাষ্ট্রে সব ধরনের বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে সবসময় অভিযান চলমান থাকার কথা। অভিযান থাকুক আর নাই থাকুক, কখনোই মাদক নেওয়া যাবে না, দখল করা যাবে না, অস্ত্র বহন করা যাবে না, ভেজাল দেওয়া যাবে না। এটুকু পড়ে মনে হতে পারে, আমি বুঝি এ ধরনের অভিযানের বিরুদ্ধে। সবসময় চললে ভালো, তবে বিশেষ অভিযানেও আমার আপত্তি নেই। বরং এই বিশেষ অভিযান অপরাধীদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তৈরি করে। সেই আতঙ্কটা বহাল রাখতে হবে সবসময়। আর এ ধরনের বিশেষ অভিযানের অনেক সুফল আমরা পেয়েছি। জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযানের ফলে বাংলাদেশে জঙ্গিরা এখন অনেক নিয়ন্ত্রিত। বছরের পর বছর ভেজালবিরোধী অভিযানের ফলে বাজার পরিস্থিতি এখন অনেকটা ভালো। ফরমালিনের গল্প এখন আর শোনা যায় না। আমি জানি, বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। কিন্তু মানুষ বেশি, তাই সমস্যাও বেশি। তাই সবসময় সব বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সমান মনোযোগ দিয়ে অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। এ কারণে সময় সময় যে সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তার বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান অবশ্যই দরকার।

এখন দেশে যে অভিযান চলছে, সেটিই সবচেয়ে দরকারি। অবশ্য আমাদের সমস্যাগুলো এত জটিল, সব অভিযানকেই সবচেয়ে দরকারি মনে হয়। তবু মাদকের বিরুদ্ধে যে অভিযান, তাকেই আমি প্রাধান্য দিয়ে এক নম্বরে রাখতে চাই। কারণ মাদক ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের সম্ভাবনা। এই যে বাংলাদেশ এমন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে, তার ড্রাইভিং ফোর্স কিন্তু বিপুল সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেশি। কিন্তু এই জনসংখ্যাকে আপনি সমস্যা ভাবতে পারেন, সম্ভাবনাও ভাবতে পারেন। তবে ভাবলেই তো হবে না, সেই জনসংখ্যাকে সম্পদে বদলে দিতে চাই, সঠিক পরিকল্পনা।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাদকাসক্ত ৭০ লাখ, এরমধ্যে বড় একটি অংশ তরুণ। ভাবা যায়! বিশ্বের অনেক দেশের জনসংখ্যাই এরচেয়ে কম। আর আমাদের ৭০ লাখ মানুষই কিনা মাদকাসক্ত! একবার ভাবুন তো এই ৭০ লাখ মানুষ যদি মাদক ফেলে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তো, আমাদের উন্নয়ন আরও কতটা গতি পেতে পারতো। তবে এটা ঠিক, মাদক না খেলেই যে তাদের সবাইকে কাজ দেওয়া সম্ভব, তা হয়তো নয়। কিন্তু মাদকাসক্ত না হলে, তারা কোনও না কোনও উপায়ে কাজ খুঁজে নিতো, দেশ গঠনে অবদান রাখতে পারতো।

মানুষ কৌতূহলে প্রথম মাদক নেয়, এরপর জড়িয়ে যায় জালে। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পেলে হতাশা গ্রাস করে তাকে, এরপর মাদকের জাল তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। পরে চাইলেও আর বেরুতে পারে না। আর একজন মাদকাসক্ত শুধু নিজেকে নয়, ধ্বংস করে দেয় পরিবারকেও। তাই কর্মক্ষম মানুষের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের ক্ষেত্র তৈরি করাটা খুব জরুরি। সবাইকে যে সরকারি চাকরিই করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। নানারকম ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগেও কাজের ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব।

কেউ মাদকে জড়িয়ে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা অনেক কঠিন। দীর্ঘ পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাকে ফিরিয়ে আনতে হয়। অনেক সময় চেষ্টা করেও ফেরানো যায় না। তাই সবচেয়ে আগে চাই মাদকে জড়ানোর আগেই তাকে সতর্ক করা। সব অভিভাবকের উচিত তার সন্তানের দিকে খেয়াল রাখা; সে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কোনও ফাঁদে পড়লো কিনা। সন্তানই কিন্তু আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই এই সম্পদ রক্ষায় আপনাকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। সন্তানকে ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখুন। এমনকী মাদকাসক্ত হয়ে গেলেও ভালোবাসা তুলে নেবেন না। তখন ফেরার জন্য তার আরো বেশি ভালোবাসা দরকার।

মাদকাসক্তরা নিশ্চয়ই আকাশ থেকে মাদক পায় না। ৭০ লাখ মাদকসেবীকে মাদক সরবরাহ করার জন্য দেশজুড়ে রয়েছে বিশাল মাদক সিন্ডিকেট। সরকারের চলমান অভিযান এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। চলমান মাদকবিরোধী অভিযানকে নিছক অভিযান না বলে যুদ্ধ বলাই ভালো। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই অভিযানটা আরও আগে থেকেই শুরু করতে পারলে ভালো হতো। তবে বেটার লেট দ্যান নেভার। দেরিতে শুরু হলেও এই অভিযান যেন মাদক শেষ না হওয়া পর্যন্ত শেষ না হয়।

বলা হয়, চাহিদা থাকলেই সরবরাহ থাকে। কিন্তু মাদকের চাহিদাটা কিভাবে তৈরি হয়? মাদক তো ভাত নয় বা পানি নয়; যে না পেলেই মানুষ মরে যাবে। এই চাহিদাটা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়। কয়েকবছর আগেও তো দেশে কেউ ইয়াবার নামই জানতো না। তাহলে ইয়াবার চাহিদা কিভাবে তৈরি হলো? ফেনসিডিল আসার আগে এর চাহিদা তৈরি হলো কিভাবে? তার মানে মাদক সিন্ডিকেট আগে কৃত্রিমভাবে চাহিদা তৈরি করে। এরপর সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। পত্রিকায় পড়ি, দেশে খালি ইয়াবার বাজারই নাকি হাজার কোটি টাকা। ইয়াবা বেঁচে অনেক লোক কোটিপতি হয়ে গেছে। অনেকে এমপিও হয়ে গেছেন। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে মাদকবিরোধী অভিযানে ‌‘জিরো টলারেন্স’এর কথা বলা হচ্ছে। খুব ভালো কথা। কিন্তু এই জিরো টলারেন্স নীতি যেন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হয়। মাদকের চুনোপুটি বিক্রেতাদের ধরে-মেরে সমস্যা সমাধান হবে না। একটি বড় বিষাক্ত গাছের সব ডালপালা ছেটে দিলেই গাছটি মরে গেছে ভাবার কোনও কারণ নেই। আবার নতুন ডালপালা গজাবে। তাই উপড়াতে হবে শিকড় থেকে। সেটা অনেক কঠিন। কিন্তু সত্যি সত্যি মাদক নির্মূল করতে হলে সেই কঠিন কাজটাই আপনাকে করতে হবে। শুধু চুনোপুটিদের ধরে-মেরে কাজ হবে না, ধরতে হবে রাঘব বোয়ালদের। অনেক সময় একজন বড় কারও বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিলেই সতর্ক হয়ে যান অনেকে। সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্য বদির বিরুদ্ধে ইয়াবা সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগ এতটাই প্রচারিত, অনেক মানুষ এটাকে সত্য বলে মনে করেন। সত্য-মিথ্যা আদালত নির্ধারণ করবেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার বলছেন, সংসদ সদস্য বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও প্রমাণ নেই। খুব ভালো কথা, আইনের কথা। কিন্তু চলমান অভিযানে যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে কি সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে? যে কোনও সমাজে অপরাধ হবে। কিন্তু অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় কিনা, সেটাই বিবেচ্য। এই সরকার অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনেক কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে উদাহরণ তৈরি করেছে। সরকারি দলের একজন এমপি এখন খুনের দায়ে কারাগারে আছেন। খুনের মামলায় কারাগারে আছেন আরেক এমপির ছেলে। এ ধরনের ব্যবস্থা নিলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থা তৈরি হয়। আপাতত অভিযোগের ভিত্তিতে সাংসদ বদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে চলমান মাদকবিরোধী অভিযান আরো অনেক আস্থা অর্জন করবে।

তবে চলমান মাদকবিরোধী অভিযান এমনিতেই জনমানুষের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। সবাই সরকারের কাজের সমর্থন করছে। কিন্তু এই অসাধারণ কাজে একটা বড় খুঁত থেকে যাচ্ছে, তাহলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, অভিযানের প্রথম ৯ দিনে ৪২ জন ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছেন। তবে এই ‘ক্রসফায়ার’ও সাধারণ মানুষ সমর্থন করছেন। অভিযানের গ্রহণযোগ্যতা, প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। তবে অবশ্যই একে আইনের আওতায় রাখতে হবে। দল-মত নির্বিশেষে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সব মানুষকে ধরতে হবে, আইনের আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে আলাদা আদালত করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই বিনা বিচারে মেরে ফেলা সমর্থনযোগ্য নয়। ক্রসফায়ার এই অসাধারণ অভিযানের নৈতিকতাকে দেশে-বিদেশে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। আমরা চাই না, এই অতি প্রয়োজনীয় অভিযানটি এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হোক। আমরা যেকোনও মূল্যে এই অভিযানের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সাফল্য চাই।

শুরুতে যেটা বলছিলাম। প্রয়োজনীয় অভিযানগুলো সময় সময় না করে চলমান রাখা হোক। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কাউন্টার টেররিজমের মতো মাদক, উচ্ছেদ, ভেজালের জন্য আলাদা আলাদা উইং খোলা হোক, যেন তারা বছরজুড়েই নজরদারি জারি রাখতে পারে এবং আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ চালাতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই শুরু হয়েছে এই মাদকবিরোধী অভিযান। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ। এই অভিযান সফল হলে (সফল হতেই হবে) তার সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হবে আরেকটি পালক। দেশের হাজারো অভিভাবক, লাখো মানুষ শেখ হাসিনাকে আশীর্বাদ করবে। তাই এ অভিযানের সাফল্য নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই যেন এ অভিযান থেমে না যায়, প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। মাদকমুক্ত বাংলাদেশের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা সবাই।

লেখক: সাংবাদিক

Advertisement