মানবিক শিক্ষালয় চাই

আনিসুল হক :: কথা ছিল, স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে মানুষ তার জীবনের সেরা সময়টা কাটাবে। অথচ সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কি উদার, মানবিক না হয়ে জাঁতাকল হয়ে উঠছে?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতা-কাহিনী’তে রাজা তাঁর মন্ত্রীকে ডেকে বলেন, ‘পাখিটাকে শিক্ষা দাও।’ তোতা পাখিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রথম একটা খাঁচা বানানো হলো। সোনার খাঁচা। তারপর চেষ্টা চলতে লাগল সেই খাঁচাটার উন্নতি সাধনের। আর খাঁচায় ‘দানা নাই, পানি নাই, কেবল রাশি রাশি পুঁথি হইতে রাশি রাশি পাতা ছিঁড়িয়া মুখের মধ্যে ঠাসা হইতেছে। গান তো বন্ধই, চিৎকার করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা।’

তারপর সেই দুঃখের লাইনটা রবীন্দ্রনাথ নিরাবেগে বলে গেছেন, ‘পাখিটা মরিল।’

আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কি আমরা তোতা-কাহিনীর খাঁচা বানাচ্ছি? আমাদের পরিবার-সমাজ, কোচিং সেন্টার, দেশ-রাষ্ট্র, মূল্যবোধ—সবটা মিলিয়ে যে ব্যবস্থাটা আমরা দাঁড় করিয়েছি, তা কি পাখি মারার খাঁচা হয়ে উঠছে না?

সম্প্রতি বেশ কজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের হয়তো একটা বড় ধাক্কা দিয়েছে—এই কথাগুলো বলার উপলক্ষ নতুন করে তৈরি হয়েছে।

প্রতিষ্ঠান মানে জেলখানা
আজ থেকে বছর পনেরো আগে আমাদের এক লেখক বন্ধু আমাকে ধরে বসলেন। তাঁর মেয়েকে একটা স্কুল ‘বহিষ্কার’ করেছে। মেয়েটি পড়ত ক্লাস ফোরে, তার এক সহপাঠী তাকে কতগুলো ভিউকার্ড রাখতে দিয়েছে, সে তার ব্যাগে সেগুলো রেখেছে, এবং শিক্ষকের কাছে ধরা পড়েছে। ভিউকার্ডের ছবিগুলো ছিল আপত্তিকর। এই অপরাধের শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। আমি স্কুলের অধ্যক্ষকে ফোন করলাম, বললাম, ‘আপা, ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চাকে মূল্যবোধ নৈতিকতা শেখানোর জন্যই তো আপনার স্কুল, আপনি তাকে সুশিক্ষা না দিয়ে শাস্তি দিচ্ছেন কেন? এটা তো হয় না।’ অধ্যক্ষ বললেন, ‘আপনার নরমসরম ভাব দিয়ে আমি প্রতিষ্ঠান চালাতে পারব না।’ শিশুটিকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠান কথাটা মনে হলেই আমার মিশেল ফুকোর কথা মনে পড়ে। মিশেল ফুকো বলেন, আমাদের সমাজটা হলো বিশাল কারাগার। প্রতিটা প্রতিষ্ঠান কারাগার। জেলখানায় যেমন ওয়াচ টাওয়ার থাকে, তেমনি স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, কারখানায় থাকে স্তরে স্তরে নজরদারির ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাকে তিনি বলেছেন, প্যান-অপটিক সমাজ।

আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা কি জেলখানা বানিয়ে ফেলছি?

আমাদের বহু স্কুল-কলেজে এখনো শারীরিক শাস্তি আছে, বেত আছে। বহু প্রতিষ্ঠানে মৌখিক শাস্তি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, ভব্যতার সীমাকে পায়ে দলে।

অনেক দিন আগে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আর আমি মিলে একটা টেলিভিশন নাটক বানিয়ে ছিলাম, ইন্টারভিউ। স্কুলের ভর্তি পরীক্ষার বিরুদ্ধে লিখেছিলাম নাটকটি। তাতে নিজে ক্যামেরার সামনে হাজির হয়ে বলেছিলাম, ‘স্কুলে বাচ্চারা শিখতে আসবে, তারা তো জজ-ব্যারিস্টার হয়ে এসে ভর্তি পরীক্ষা দেবে না। আর স্কুল হতে হবে সবার জন্য, সেখানে কালো-ফরসা, ধনী-গরিব, আইকিউ বেশি, আইকিউ কম, কথা বলতে পারে, কথা বলতে পারে না—সবার সমান সুযোগ থাকবে, কোনো ধরনের বৈষম্য করা যাবে না। ইউরোপ-আমেরিকায় এলাকা ধরে স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয়। আমাদের দেশেও ক্লাস ওয়ানে ভর্তির জন্য অ্যাডমিশন টেস্ট-ইন্টারভিউ নেওয়া বন্ধ করতে হবে।’ সরকার অবশ্য এই নিয়ম চালু করার আদেশ দিয়েছিল।এমনই হাসিখুশি হোক ক্লাসরুম। স্বপ্ন নিয়ের অনুরোধে মডেল হয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের প্রভাষক ইনজামামুল সারোয়ার ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরামানবিক শিক্ষালয় চাই
আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিক হতে হবে। শিক্ষকেরা হবেন বন্ধু। হায়, কোচিং-বাণিজ্যের এই যুগে এই চাওয়া অরণ্যে রোদন মাত্র। আমাদের প্রতিটা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিদ কাউন্সেলর লাগবে, যাঁরা শিক্ষার্থীদের সমস্যায় পাশে এসে দাঁড়াবেন। উন্নত বিশ্বে কাউন্সেলর ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কল্পনাও করা যায় না।

শুধু পরীক্ষার ফলের ওপরে গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে খেলাধুলা, বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে। এটা শুধু বিজয়ের জন্য নয়, পরাজয় মেনে নিতে শেখার জন্য। দুনিয়ায় চলার পথে কখনো ভালো সময় আসে, কখনো খুব খারাপ সময় আসতে পারে। খেলা বা বিতর্কের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন জয়কে ধারণ করা শিখি, তেমনি পরাজয়কে বরণ করাও শিখি। দ্বিতীয়টা বরং বেশি মূল্যবান।

আরেকটা কথা খুব জোর দিয়ে বারবার বলছি। পরীক্ষার ফলের সঙ্গে জীবনের ফলের সম্পর্ক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব সামান্য। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় যে ২০ জন আছেন, তাঁদের মধ্যে ১৮ জনেরই পরীক্ষার ফল খারাপ কিংবা তেমন ভালো নয়। বাংলাদেশের সেরা ২০ জন ধনী মানুষের তালিকা করলে দেখা যাবে, একজনও ফার্স্ট বয় নেই। বিল গেটস নিজে হার্ভার্ডের পড়া শেষ করেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। অমর্ত্য সেন একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, ভারতের ফার্স্ট বয়দের নিয়ে। তিনি এই ফার্স্ট বয় সংস্কৃতির ঘোরবিরোধী। তিনি বলেছেন, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ঢাকার স্কুল সেন্ট গ্রেগরি তাঁর পরীক্ষার খাতা খুঁজে বের করে হতাশ হয়েছিল। কারণ তিনি পরীক্ষায় বেশ খারাপ করেছিলেন। তিনি পরে শান্তিনিকেতনে পড়েন, সেখানকার উদার পরিবেশ তাঁকে স্বস্তি দিয়েছিল, ওই স্কুলে কোনো প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিল না।

প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড় নয়
আমাদের বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ লাখ। বিসিএসে পদ যখন প্রায় দুই হাজার। মানে যত ভালোভাবেই প্রস্তুতি নিক, ৩ লাখ ৯৮ হাজার পরীক্ষার্থীকে অকৃতকার্য হতেই হবে। এই সহজ অঙ্কটা আগেভাগে বুঝে নিলেই তো হয়। বিসিএসে পাস করলেও জীবনে সফল হওয়া যায়, ফেল করলেও সফল হওয়া যায়। কিন্তু সবকিছুতে এত প্রতিযোগিতা ভালো নয়। বরং আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ভালো মানুষ হওয়ার।

সে জন্য কী করতে হবে, সফল মানুষেরা প্রায় সবাই একই পরামর্শ দিয়ে আসছেন।

১. যা ভালো লাগে, তা করো। ২. নিজের কাজকে উপভোগ করো। ৩. চেষ্টা করো, পরিশ্রম করো। ৪. প্রচুর বই পড়ো। ৫. সংস্কৃতির চর্চা করো। ৬. খেলাধুলা করো। ৭. নৈতিকতার চর্চা করো।

প্রতিটা জীবন সুন্দর। প্রতিটা জীবন মূল্যবান। কোনো জীবনই ব্যর্থ নয়। এই হাসিকান্নাভরা জীবনে এক অপূর্ব মাধুর্য আছে। জীবন প্রত্যেকের জন্যই সোনার মেডেল রেখে দিয়েছে। আমরা যে যা করছি, করব, সেটাই মূল্যবান। কাজেই ফার্স্ট হতেই হবে, মেডিকেলে চান্স পেতেই হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে—এই ধরনের গোঁয়ার্তুমির মানে হয় না।

চাই পারিবারিক ছায়া
সন্তানের সুখে-দুঃখে তার পাশে বন্ধুর মতো থাকতে হবে। তাকে সময় দিতে হবে। তাকে মূল্যবোধ দিতে হবে। শুধু এটা কোরো না, ওটা কোরো না বললে চলবে না। সবচেয়ে বড় কথা, তার দুঃসময়ে তার লজ্জার সময়ে তার হয়ে তাকে অভয় দিতে হবে। ইন্দিরা গান্ধী বিলেতে যে প্রতিষ্ঠানে পড়তেন, তাতে কালোদের জন্য আলাদা গেট ছিল, সাদাদের জন্য আলাদা। ইন্দিরা গান্ধী একদিন সাদাদের গেট দিয়ে ঢুকেছেন বলে তাঁকে জরিমানা দিতে হয়। তা জেনে তাঁর বাবা জওহরলাল নেহরু লেখেন, তুমি রোজ সাদাদের গেট দিয়ে ঢুকবে আর রোজ জরিমানা দেবে। অভিভাবকদের বলি, সন্তান যা হতে চায়, তাই তাকে হতে দিন। আপনার অপূর্ণ চাওয়া তার ওপরে চাপাবেন না। তাকে নিজের পায়ে চলতেও দিন। তাকে নৈতিক মূল্যবোধ অবশ্যই দেবেন। ভালোমন্দ চিনতে দেবেন। আত্মমর্যাদাবোধ দেবেন। সে নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারবে।

মানবিক শিক্ষক চাই
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সম্বন্ধ অত্যন্ত সত্য হওয়া দরকার…বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তি-স্নেহের সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে তাহলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারাও হতভাগ্য।’ নিজেকে যেন হতভাগ্য মনে না হয়।

হাল ছেড়ো না
রবীন্দ্রনাথের ‘বোঝাপড়া’ কবিতাটা পড়তে বলি সবাইকে। নিজেও পড়ি—‘মনেরে আজ কহ যে, ভালোমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।…মরণ এলে হঠাৎ দেখি মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।’

এসো, লড়াই করি। বাঁচি। সমাজব্যবস্থা সুন্দর নয়। কিন্তু সুন্দর করার চেষ্টা তো সুন্দর। নদী সরলরেখার মতো সোজা নয়। তাকে সোজা করার চেষ্টা না করাই সুন্দর। আর মিশেল ফুকোর ভাবনাটা এ রকম, সমাজটা কারাগার, প্রতিষ্ঠানগুলো কারাগার; কিন্তু প্রগতিশীলের কর্তব্য হবে সেই কারাগারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়াই করে যাওয়া।

আল মাহমুদের কবিতার এই লাইনও আমার খুব প্রিয়, ‘তোমরা যখন শিখছ পড়া মানুষ হওয়ার জন্য, আমি না হয় পাখিই হব, পাখির মতো বন্য।’ আমরা না হয় পাখিই হলাম। অন্তত তাতে আমরা কিছু সুন্দর মানুষ পাব।

Advertisement