মায়ের গল্প

:লিনু ফারজানা:

নাজিম হিকমত বলেছিলেন শোকের আয়ু একবছর। আমার তখন মনে হয়েছিল একবছর না শোকের আয়ু আরো কম।

জুম্মায় জুম্মায় আটদিনও যায় না আমরা কষ্ট ভুলে যাই। আসলে কষ্টগুলো যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ভুলে যাওয়া উচিত। আগামী কাল বিশ্ব মা দিবস। মা দিবস হোক আর বাবা দিবস হউক কোন দিবস কে আলাদা গুরুত্ব দিতে আমার ভালো লাগেনা।

আরো অনেক কিছু ভালো লাগেনা, ভালো লাগেনা ব্যাক্তিগত দুঃখ নিয়ে বিলাসিতা করা।

চব্বিশ বছর পরও আম্মা বা আম্মার স্মৃতি আমার কাছে ঝাপসা হয়নি হবেও না । সবার মা কে নিয়ে স্মৃতিচারণ আমার স্মৃতির ফাইলকেও একটু নাড়া দিল, ভাবলাম একটু লিখি আমার মারে নিয়া। আট দশজন মায়ের মত আমার মা ও ছিলেন অতি সাধারণ,আটপৌরে (যদিও আমার কাছে অসাধারণ)।
খেলতে গিয়ে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো তো সেরেছে, মাগরিবের নামাজের পর এক দফা উত্তম মধ্যেম মিস নাই। কান্নার শব্দ হুরুদাদির কান পর্যন্ত পৌছালে কোন মতে রক্ষা, তা ও আবার অনির্দিষ্ট কালের জন্য খেলা বন্ধের মুচলেকা দিয়ে। আম-কাঠালের বন্ধের লম্বা দিনের নির্জন দুপুর বেলায় খুব বেশি রান্না-বাটি আর কুতকুত খেলা হত। কুতকুত খেলার উপযুক্ত জায়গা ছিল লিলি ফুফুদের পেছনের উঠান বা ছায়াময় যে কোন উঠান।

দিন-দুনিয়া ভুলে বিরামহীন কুতকুত খেলা হত। চুলের ঝুটিতে টান খেয়ে সম্বিৎ ফিরতো। চুলের গোছা ধরে টেনে আনা হত ঘরে। আবারও পথে হুরুদাদির সাথে দেখা হলে এ যাত্রা রক্ষা। কিন্তু পরের দিন খেলার সাথীরা খেলায় রাখতে চাইতো না। ওদের সাফ উত্তর তুমার মা এসে খেলার মাঝখান থেকে ধরে নিয়ে যাবেন। আগের দিনের অসমাপ্ত, পরিত্যক্ত কুত কুত ম্যাচের শাস্তি কদিন ধরে চলতো। খেলা থেকে বহিষ্কৃত হয়ে খুব রাগ লাগতো, ভাবতাম আমার ছেলেমেয়েরা ইচ্ছামত কুতকুত খেলবে, আমি কিচ্ছু বলবো না। যদিও বাস্তবে আম্মার চেয়ে তিনকাঠি এগিয়ে আছি আমি। একই অবস্থা রান্না-বাটি খেলায় ডিমের চুকলার(খোসা) ভেতর ভাত রান্না করতে গিয়ে হাত একটু পুড়ে গেলে, বা হাত কেটে গেলে সহানুভূতির বদলা কিছু উত্তম-মধ্যেম বরাদ্ধ থাকতো। বেশির ভাগই বেচে যেতাম হুরুদাদি আর মতি ফুফুর বদান্যতায়। ডানপিটে বলতে যা বোঝায় তা আমি ছিলাম না তবে নিমরা, অঘটন ঘটনপটিয়সী ভালোই ছিলাম। আমি আর জোছনা মিলে পুকুরে নামলে সহজে উঠার নাম নিতাম না।মাঝেমাঝে হুরুদাদি লম্বা কুটা এনে বাড়ি দিয়ে তুলতেন। আম্মার দুপুরের রান্নাবান্না শেষ হওয়ার আগে পুকুর থেকে না উঠলে খবর ছিল। একবার চৈত্র মাসে দক্ষিণের পুকুর সেচা হয়েছে। মাছ ধরা শেষ, নিচে ঘন কাদাপানি। আশপাশের বাড়ির বাচ্চারা নেমেছে মাছ ধরতে। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ উপভোগ করলাম মাছধরা, কোনকিছু চিন্তা না করে হঠাৎ করে নেমে গেলাম বুক সমান কাদাপানিতে। আফিয়া ফুফু থাকতো আমাদের ঘরে, অনেক করে বোঝালো….. জলদি উঠো তোমার মা দেখলে পিঠের চামড়া ছিলে ফেলবে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাদায় মাখামাখি, এর মধ্যে আম্মা এক চক্কর মেরে গেছেন,কাদামাখা মুখ চিনতে পারেন নাই। পায়ের নিচ থেকে একটা মাঝারি সাইজের শোল মাছ ধরে এভারেস্ট জয়ের অনুভুতি নিয়ে যখন বাড়িতে ঢুকলাম তখন আর হুরুদাদি ও রক্ষা করতে পারলেন না।কাটাগোলাপের বেতের কয়েক খুব আরামে পিঠের উপড় পড়লো। অতিমাত্রায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আম্মা আমারে গরম পানি আর সাবান সিদ্ধ করে ধুয়ে দিলেন।পরিনামে ১০১ ডিগ্রি জ্বর, যা পড়াশুনায় খানিক বিরতি দিলেও চিমটি চিমটি খোটা……….. বাপ আসলে পড়াশুনা বন্ধ, কলার তলিপারে বিয়ে, ঘরের কাম কাজ করানো ইত্যাদি ইত্যাদি। পুকুরে নেমে মাছ ধরার কারনে আম্মার পাশাপাশি মেঝো ভাইয়েরও উস্কানি মুলক ও পীড়াদায়ক কিছু বিশেষণ ও যোগ হয়েছিল।
আমার শৈশবে আম্মার চুলের ঝুটি ধরে টানাটানির অথবা কাটা গোলাপের বেতের বাড়ির স্মৃতিগুলো আমারে বড়ই কষ্ট দিত। যেদিন বাক্স পেটরা নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম আম্মা একেবারে বাড়ির সামনের আমগাছের তলা পর্যন্ত আসলেন, যতক্ষণ আমারে দেখা যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন একটু পরপর চোখ ও মুছলেন। আমিও বারবার পেছন ফিরে তাকালাম ভাবলাম ভালো হইছে……….. এইবার বুঝো মজা, এখন ইচ্ছামত ঘুমাবো, অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাবো। অনেক সময় নিয়ে গোসল করবো…… কেউ আর খোটা দিবেনা………”এই রসে এই দিন যাইতো নায়, এত লম্বা সিনান(গোসল) করলে দিন চলতো নায়”।
ভাবতে ভাবতে রেলষ্টেশনে কোন ফাকে চলে এসেছি বুঝি নাই।
লাতুর ট্রেনে সবকিছু নিয়ে গোছগাছ করে বসার পর যেই ট্রেনের ছাড়ার হুইসেল দিল অমনি আমার চোখ ভরে কান্না আসতে লাগলো। এমন কান্না থামতেই চায়না। সাথের সিনিয়র দুই আপা শাহানা আপা ও শোভা দিদি অনেক সান্তনা দিলেন। সিলেটে আসার পর আরোও বেশি মন খারাপ হলো। প্রতিদিন দিন গুনি কবে বাড়ি যাব? প্রতি সপ্তাহে চিঠি আসতো, রান্না করা খাবার আসতো। টিফিনবক্স খোলার পর কি সুন্দর রান্না করা খাবারের ঘ্রাণ বের হত! খাবার দাবারের প্রতি অতি বিরক্ত আমি জানতামই না আমার আম্মার রান্নায় এত সুঘ্রাণ আছে। আমার রুমমেট শাপলা বলতো বাড়ি গেলে তোমার আম্মার হাতের রান্নার রেসিপিটা নিয়ে আসিও।
মাত্র কয়েক মাস স্থায়ী হয়েছিল এই সুখ, আম্মা চলে গেলেন বড়ই অসময়ে। কেউ খোটা দেয়না, চুলের ঝুটি ধরে টানেনা,চিঠিও লিখেনা,খাবার রান্না করেও পাঠায় না,বাড়ি যাওয়ার জন্যও অপেক্ষায় থাকেনা। চারিদিকে শুন্যতা, হাহাকার আর অসহায়ত্ব। জলে ভাসা পদ্ম আমরা দুই বোন মেঝো ভাইয়ের কাছে পেলাম শিকড় গজানো আশ্রয়। সেই আশ্রয়ে আমাদের বাকি দুই ভাইও পদ্মপুকুরের পাড়ে দাড়ালো বিশাল বটবৃক্ষের ছায়া নিয়ে। এখন সেই ছায়ার ডালপালা বিস্তৃত হয়ে সাথে যুক্ত হয়েছে ভাইয়ের বউরা তাদের সন্তানেরা। ছোট বেলা থেকে যে ছোট ভাইয়ের সাথে আমার একটুও বনিবনা হত না, বছরে ছ’মাস কথা বন্ধ থাকতো, সেই ছোট ভাই জীবনের চরম দুঃসময় গুলোতে ছায়ার মত মাথার পাশে দাঁড়ায়, ভাইজান যার উৎসাহ, সহযোগীতা প্রতিটা পদে পদে সাহস যোগায়, মেঝো ভাইয়েরও সেই মায়াময় বন্ধন একটুও কমে নাই বেড়েছে। এতসব খালি আমার আম্মার দোয়ায়। আম্মা খালি চিন্তা করতেন শেষ বয়সের মেয়েদের কে দেখবে?? আম্মা যদি দেখতেন….. ভাইদের মমতার হাত কত প্রসারিত…. অনেক খুশি হতেন। আমাদের বোনদের খারাপ লাগা ভালো লাগাকে কত সহজে আপন করে নেন ভাইরা।
আমাদের সবার সব কিছু আছে, শুধু আম্মা নেই আমাদের মাঝে। তিব্বত ট্যালকম পাউডারের কৌটায়, লক্ষি বিলাস তেলের শিশিতে সুচিত্রা সেনের সাদাকালো ছবিতে ছাড়াও যে কোন মায়াময় অবয়বে খুজি আম্মারে। আম্মার মত দেখতে এক মহিলারে লুকিয়ে দূর থেকে দেখতেন মেজো ভাই।শুনে দিলাম এক ধমক….. বাচ্চাদের মত এইগুলা কি? ভাইজান একদিন বড়ভাবির খালাতো বোনকে দেখিয়ে বললেন দেখতো উনারে আম্মার মত লাগে। আমি দেখি মেঘলা আমার ভাইজি কে। আসলে আমরা সবাই আম্মার ছায়া খুজি।
আম্মার মৃত্যুর পর থেকে আমার সিরিয়াস পানি ভীতি কাজ করে, আমি সমুদ্রে গেলে পা ভিজাই না,আমি জাফলং, রাতারগুল,বিছনাকান্দি যেতে চাইনা। আর পুকুরে সেই কবে নেমেছিলাম মনে করতে পারিনা। আম্মা জানলেন না আমি লম্বা সময় নিয়ে গোসল করতে পারিনা, চাইলেও অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনা।ছুটির দিনেও ঘুম ভেঙে যায় খুব ভোরে।
ঘুম থেকে উঠার জন্য ছেলেমেয়েদের আম্মার চেয়েও জোরে ধমক দেই। আরো বেশি বিধিনিষেধ আরোপ করি। আমার বেশির ভাগ কৃতকর্ম জানান দেয় আম্মার অস্তিত্ব।
কেবল এই মা দিবসে নয় জীবনের প্রতিটা দিন প্রতিটা ক্ষণ হউক মমতাময়ী মা দের।জীবিত, প্রয়াত সকল মায়ের জন্য অনেক শুভ কামনা থাকলো।
শুভরাত্রি।

(লিনু ফারজানা গল্পকার মুক্ত চিন্তার মানুষ )

Advertisement